সময়ের সঙ্গে তাল মিলাতে বিএনপি ব্যর্থ হয়েছে

6681

Published on ফেব্রুয়ারি 26, 2018
  • Details Image

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার রায় প্রকাশের আগের দিন ফেব্রুয়ারির ৭ তারিখে বিএনপি ও তার অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা লন্ডনে বাংলাদেশ দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভের নামে অফিসের ভিতরে ঢুকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি ভাঙচুর করে। লন্ডনে অবস্থানরত এবং বাংলাদেশের আদালতের খাতায় পলাতক ঘোষিত তারেক রহমান বেগম খালেদা জিয়ার বিকল্প হিসেবে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন হন। তাতে বোঝা যায় বেগম খালেদা জিয়া যে অবস্থাতেই থাকুন বিএনপির সব দায়িত্ব ও দায় এখন তারেক রহমানের ওপর। লন্ডনেই বঙ্গবন্ধুর ছবি ভাঙচুর হলো, অন্য কোনো দেশে তা ঘটেনি। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলা হলো ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়। রায় হলো ১০ বছরের মাথায় এসে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের সময়। বর্তমান সরকারের প্রতি, আদালতের প্রতি, এমনকি লন্ডনের দূতাবাস কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিএনপির অভিযোগ থাকতে পারে। তার জন্য ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশও তারা দেখাতে পারে, সেটি যৌক্তিক নাকি অযৌক্তিক তা এক প্রসঙ্গ। কিন্তু জাতির পিতার ছবি ভাঙচুর করা কেন? এই একটি মাত্র ঘটনা যে বিষয়টি প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট তা হলো, জিয়াউর রহমান কর্তৃক দল গঠনের ৩৯ বছরের মাথায় এসেও বিএনপির রাজনীতিতে কোনো পরিবর্তন আসেনি। শুরু থেকে তাদের রাজনীতির একমাত্র লক্ষ্য জাতির পিতার সব রকম অবমাননা করা। তার সম্পর্কে যথেচ্ছ কটূক্তি করা এবং বাংলাদেশের সব অঙ্গন থেকে জাতির পিতার নাম-নিশানা মুছে ফেলা। একজন ব্যক্তির প্রতি বিএনপির এত ক্ষোভ কেন? আর সেই ব্যক্তিটি অন্য কেউ নয়, জাতির পিতা, যার জন্ম না হলে বাংলাদেশের জন্ম হতো না। তারপর বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায় বিএনপির তো জন্মই হয়নি। বিএনপির কোনো ক্ষতি তো বঙ্গবন্ধু করেননি। তাই সংগত কারণেই প্রশ্ন ওঠে বঙ্গবন্ধুর প্রতি বিএনপির এত ক্ষোভের কারণ কী থাকতে পারে। এত ক্ষোভ শুধু পাকিস্তানের রয়েছে বঙ্গবন্ধুর প্রতি।

একাত্তরের পরাজয়ের প্রতিশোধ নেওয়াই পাকিস্তানের লক্ষ্য এটা সবাই বোঝে। কিন্তু এ ইস্যুতে পাকিস্তান আর বিএনপির অবস্থান একই রকম হওয়ার রহস্যটা প্রত্যেকের উপলব্ধি করা প্রয়োজন, যারা নিজেকে বাংলাদেশের নাগরিক ও বাঙালি হিসেবে গর্বিত মনে করে। বিএনপির সব বড় নেতাসহ এটা সবাই বোঝে বঙ্গবন্ধুর নাম-নিশানা ও মহান কীর্তি নেই করে দেওয়া হলে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ বলতে যা বোঝায় তার কিছুই আর থাকে না। বাংলাদেশ নামের খোলসে সেটা হয় আরেকটি পাকিস্তান। তাহলে ২৩ বছরের সংগ্রাম ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের কী প্রয়োজন ছিল। এই প্রকল্পের রাজনীতি বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান শুরু করেন। এ কথার দালিলিক প্রমাণ কেউ যাচাই করতে চাইলে তিনি যদি জিয়াউর রহমান কর্তৃক সামরিক আদেশ দ্বারা সংবিধানের বিভিন্ন ধারার পরিবর্তন ও বাতিল এবং পঞ্চম সংশোধনীতে সেগুলোর জায়েজিকরণের পর মুদ্রিত কপির সঙ্গে বাহাত্তরের সংবিধানের মুদ্রিত কপি মিলিয়ে দেখেন তাহলে উপরোক্ত কথার সঠিকতা পাবেন। এর জন্য সাংবিধানিক বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই। শব্দ ও লাইনগুলো মিলিয়ে দেখলেই যে কেউ সহজে বুঝতে পারবেন। শুধু ভৌগোলিক স্বাধীনতা নয়, রাজনীতি ও রাষ্ট্রকে সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয়করণের কুফল থেকে মুক্ত করার জন্যই দীর্ঘ মুক্তি সংগ্রাম, তারপর মুক্তিযুদ্ধ। ধর্মনিরপেক্ষতা সংবিধান থেকে বাতিল করার ফলে আমরা আবার ধর্ম ব্যবসায়ীদের শেকলে আবদ্ধ হয়ে গেলাম, মুক্ত হয়েও হতে পারলাম না। বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষ দর্শন ছিল একেবারে অনন্য। এর সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্ব, তুরস্কের কামাল আতাতুর্ক এবং কমিউনিস্ট বিশ্বের ধর্মনিরপেক্ষতার কোনো মিল নেই। সম্পূর্ণ বাংলাদেশি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ স্বতন্ত্ররূপে ধর্মনিরপেক্ষতা বঙ্গবন্ধু প্রবর্তন করেছিলেন, যাতে ২৩ বছর ধরে পাকিস্তান ধর্মকে রাজনীতিতে টেনে এনে ধর্ম ও রাজনীতি দুটোরই যেভাবে সর্বনাশ করেছে সেটি যেন বাংলাদেশে কেউ করতে না পারে। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের বিরোধী পক্ষ অপপ্রচার চালায় এই মর্মে যে, ধর্মনিরপেক্ষতা থাকলে নাকি সেই রাষ্ট্রে ধর্ম থাকে না। বঙ্গবন্ধু কর্তৃক প্রবর্তিত ধর্মনিরপেক্ষতার বেলায় এ কথাটি মোটেই ঠিক নয়। সে জন্যই এটা অনন্য। ইসলামিক ফাউন্ডেশন বঙ্গবন্ধু প্রতিষ্ঠা করেন। বঙ্গবন্ধুর লক্ষ্য ছিল রাষ্ট্র সব ধর্মকে সমানভাবে দেখভাল করবে। মূল কথা ছিল, ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে রাষ্ট্রের ভিতর কোনো বৈষম্য সৃষ্টি করা যাবে না। অনেক লেখাপড়া জানা মানুষকে বলতে শুনি, ভারতকে নকল করে বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতা প্রবর্তন করা হয়। এটাও সম্পূর্ণ অসত্য কথা ও অপপ্রচার। ভারতের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা সন্নিবেশিত হয় ১৯৭৬ সালে তাদের সংবিধানের ৪২তম সংশোধনীর মাধ্যমে। প্রেক্ষাপটের কথা ছেড়ে মূল প্রসঙ্গে আবার ফিরে আসি। মুক্তিযুদ্ধের দর্শন বিরোধী ও পাকিস্তানি বৈশিষ্ট্যের রাজনীতি জিয়াউর রহমান প্রবর্তন করেছিলেন ১৯৭৮-৭৯ সালে, এখন থেকে প্রায় ৩৮-৩৯ বছর আগে। জিয়াউর রহমান বোধহয় বুঝতে পেরেছিলেন তার রাজনীতিকে টিকিয়ে রাখতে হলে বঙ্গবন্ধুর সব অবদান, মহানকীর্তি এবং নাম-নিশানা বাংলাদেশের ইতিহাস ও রাষ্ট্রীয় অঙ্গন থেকে সম্পূর্ণভাবে মুছে ফেলতে হবে। কারণ, বঙ্গবন্ধু যত বেশি স্বমহিমায় সমোজ্জ্বল থাকবেন তত বেশি তাদের জন্য কঠিন হবে পাকিস্তানি বৈশিষ্ট্যের রাজনীতিকে বাংলাদেশে টিকিয়ে রাখা। জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর নাম-নিশানা মুছে ফেলার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। দ্বিতীয় সামরিক প্রশাসক জেনারেল এরশাদও জিয়ার পথেই একই চেষ্টা করেছেন। দুই সামরিক শাসকের সময়কাল ছিল ১৯৭৬ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত, মোট ১৪ বছর। রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডা এবং রাষ্ট্রীয় মেশিনারিজকে ব্যবহার করেও তারা পরিপূর্ণ সফল হতে পারেনি। তবে হ্যাঁ, কিছুটা যে সফল হয়েছিল তা বলতেই হবে। তবে বিগত ৩৮-৩৯ বছরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এবং বাংলাদেশের ভিতরে বিশাল পরিবর্তন ঘটে গেছে। আমরা এখন তথ্য বিপ্লবের যুগে আছি। সময়ের সঙ্গে নিজেদের মিলিয়ে নেওয়ার কৌশল গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক নেতৃত্বের দূরদর্শিতার পরিচয় পাওয়া যায়। এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের শেষ পর্যায়ে তিন জোটের রূপরেখা নামে আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ বাম দলগুলোকে নিয়ে একটা রাজনৈতিক সমঝোতাপত্র স্বাক্ষরিত হয়েছিল। তাতে স্পষ্টভাবে সবাইর অঙ্গীকার ছিল ১৯৯১ সালের নির্বাচনে জিতে যারা ক্ষমতায় আসবে তারা পরিপূর্ণভাবে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের রাজনীতি পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেবে।

তাই ১৯৯১ সালে ক্ষমতায় আসায় বিএনপির জন্য বিরাট সুযোগ এসেছিল দলের মতাদর্শকে সম্পূর্ণ ঢেলে সাজিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ধারায় নিয়ে আসা। এতে তাদের সব কুলই রক্ষা হতো। কারও চাপে বা বিপদে পড়ে এটা করেছেন এমন অপবাদ কেউ দিতে পারত না। একই সঙ্গে তাদের দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানকেও যথামর্যাদায় রাখতে পারতেন। বিশ্ব অঙ্গনে ঘটে যাওয়া রাজনৈতিক প্রবাহ থেকে অনেক শিক্ষা নেওয়ার সুযোগ ছিল। মাও সেতুংয়ের ১৯৫৮-৬১ মেয়াদের গ্রেট লিফ ফরওয়ার্ড এবং ১৯৬৬ সালের কালচারাল রেভ্যুলেশনের খোলনলচে সবকিছু চীনের নতুন নেতৃত্ব ত্যাগ করার পরেও মাও সেতুংকে শ্রদ্ধার জায়গায় রেখেছে। সময়ের চাহিদার সঙ্গে তাল মিলাতে পেরেছে বলেই চীন আজ বিশ্ব পরাশক্তি হওয়ার মহাসড়কে উঠতে পেরেছে। মাও সেতুংয়ের মিথ আঁকড়ে থাকলে চীনের এই উত্থান সম্ভব হতো না। সময়ের সঙ্গে তাল মিলাতে বিএনপি বারবার ব্যর্থ হচ্ছে। যার জন্য আজও তারা অকারণে বঙ্গবন্ধুর ছবি ভাঙচুর করে। জিয়া ও এরশাদ সে সময়ে যা পারেনি, এখন তথ্যবিপ্লব ও ডিজিটাল যুগে সেই চেষ্টা করে বিএনপি শুধু ব্যর্থই হবে না, নিজেদের বর্তমান সংকট থেকে উত্তরণও তাদের জন্য কষ্টকর হবে। পশ্চাৎপদতা থেকে বের হতে না পারলে দেশের অভ্যন্তরে শুধুম অন্ধ সমর্থকদের দিয়ে কাজ হবে না। ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনা বিএনপিকে এই সময়ে পুরো বিশ্ব থেকে এবং আঞ্চলিক শক্তি বলয়ের রাজনৈতিক সমীকরণের হিসাব-নিকাশের খাতায় একেবারে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। বিশ্ব এবং আঞ্চলিক শক্তি বলয়ের বিপরীত স্রোতে অবস্থান করে বিএনপি ভোটের রাজনীতিতেও সুবিধা করতে পারবে না। বিশ্ব পরিস্থিতির বিশাল পরিবর্তনের সত্যটি অনুধাবনে বিএনপি এখনো চরমভাবে ব্যর্থ হচ্ছে। তাদের বড় মিত্র পাকিস্তান এখন জঙ্গি এবং মোল্লা ও মিলিটারির কবলে পড়ে বিপর্যস্ত। আমেরিকা ডিভোর্স না দিলেও একই সঙ্গে আর বসবাস করছে না। সৌদি আরবেও বড় পরিবর্তন হচ্ছে। বিশাল ক্ষমতার অধিকারী যুবরাজ মুহম্মদ বিন সালমান ঘোষণা দিয়েছেন সৌদি আরব আধুনিক রাষ্ট্র হবে। ইতিমধ্যে মেয়েদের ফুটবল খেলার অনুমতি দিয়েছেন। তাই সৌদি আরবের কাছেও বিএনপির অবস্থান আগের মতো নেই। সত্তর ও আশির দশকের মতো ইসলাম গেল, ধর্ম গেল অপপ্রচার চালিয়ে আর কাজ হবে না। বিশ্বের সব কর্ণার থেকে সত্যকে সবাই প্রতি মুহৃর্তে দেখতে পাচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বহু আগেই বিএনপিকে জামায়াত ত্যাগ করার কথা বলেছে। বিএনপি হয়তো আমেরিকার দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু এই অঞ্চলে ভারতের বাইরে গিয়ে আমেরিকার কিছু করার সুযোগ নেই। ৩৯ বছর আগে জিয়াউর রহমানের প্রবর্তিত অচল মতাদর্শের রাজনীতিতে বিএনপি এখনো মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। অনেক সুযোগ পাওয়ার পরও সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে পারেনি। যার সর্বশেষ উদাহরণ ৭ জানুয়ারি লন্ডনে বঙ্গবন্ধুর ছবি ভাঙচুর।

 

লেখকঃ মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মাদ আলী শিকদার পিএসসি (অব.)

বাংলাদেশ প্রতিদিন 

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত