উন্নয়ন দর্শনের বিশ্ব স্বীকৃতি জয়তু শেখ হাসিনাঃ ড. ইফতেখারউদ্দিন চৌধুরী

4956

Published on এপ্রিল 10, 2018
  • Details Image

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার উদ্ধৃতি দিয়ে নিবন্ধের সূচনায় দৃঢ়চিত্তে উচ্চারণ করতে চাই- ‘অসত্যের কাছে নত নাহি হবে শির, কাপুরুষ ভয়ে কাঁপে লড়ে যাবে বীর’। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র অর্জন করে বাঙালী বীরের জাতির মর্যাদায় নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। ফরাসী জাতির জীবনে ১৪ জুলাই যেমন ইতিহাস-ঐতিহ্যে অবিনাশী মহিমায় ভাস্বর, বাঙালী জাতির জীবনেও ২৬ মার্চ ও ১৬ ডিসেম্বর অমর অক্ষয় দিন।

১৬ ডিসেম্বরই বাঙালী জাতি শুধু তাদের জাগ্রত জাতীয়তাবোধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ জাতিসত্তার আলোকে একটি লাল সবুজের পতাকার দেশ প্রতিষ্ঠা করেনি, যে ভাষার জন্য এ জাতিকে প্রাণ দিতে হয়েছিল সেই বাংলা ভাষাকে একক রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বমহিমায় সমাসীন করতেও তারা সক্ষম হয়েছে। এই নান্দনিক অহংবোধেই বাঙালী জাতির শ্রেষ্ঠত্ব এবং এজন্যই অমর একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি লাভ করেছে।

এ মহান স্বাধীনতা অর্জনের অব্যতিত পরই ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানী কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী মহাকালের মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর আজীবন লালিত স্বপ্ন ও সংগ্রামের অমিত ফসল স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনের সূচনা থেকেই এই যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিকে নতুন করে নির্মাণের নিরলস কর্মকা-ে অফুরন্ত উৎসাহ-উদ্দীপনায় ঝাঁপিয়ে পড়েন।

দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্ত এবং পাকিস্তানের পক্ষে লড়াকু পরাজিত শত্রুদের কূটচক্রের অব্যাহত ষড়যন্ত্রের ফলে নানাবিধ অনাকাক্সিক্ষত সঙ্কটের মোকাবেলা করে যখন ‘এসো দেশগড়ি’ প্রত্যয়ে জোরালোভাবে এগিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন এসব অপশক্তি দেশকে বিশ্ব পরিম-লে হেয়প্রতিপন্ন করার জন্য ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’, অদক্ষ ও অযোগ্য রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি নেতি-বিশেষণে আখ্যায়িত করার অপচেষ্টা অব্যাহত রেখেছিল।

বস্তুতপক্ষে এই স্বাধীনতা অর্জনের ৪৭ বছর পর জাতির পিতার কালজয়ী ৭ মার্চের ভাষণে অর্থনৈতিক মুক্তির যে প্রাণদীপ্ত ঘোষণা, তা বাস্তবায়নের পথে বাংলাদেশ অনন্য উচ্চতায় অনেকদূর এগিয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বিনির্মাণের মূলে যে অমিয় বাণীটি ইতিহাসের অধ্যায়ে প্রণিধানযোগ্য তা হলো ‘আমার গরিব যেন মোটা ভাত খেয়ে ও মোটা কাপড় পরে শান্তিতে থাকতে পারে’। অর্থাৎ ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত আধুনিক গণতান্ত্রিক অসাম্প্রদায়িক মানবিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই ছিল বঙ্গবন্ধুর লালিত স্বপ্নের গভীর অবগাহন।

সামগ্রিক অর্থে দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুতনয়া নতুন যে দর্শন জাতির সামনে উপস্থাপন করেছেন তা যে শুধু বাচন-বাগ্মিতা ছিল না, অসাধারণ দূরদর্শিতা, নির্ভীক সাহসিকতা এবং নিরন্তর প্রজ্ঞার ভিত্তিতে এর বাস্তবতা আজ সমগ্র বিশ্ব উপলব্ধি করতে যথার্থ সার্থক হয়েছে। জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের উন্নয়ন নীতি বিষয়ক কমিটি (সিডিপি) ১৬ মার্চ ২০১৮ আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের অভিযাত্রায় যুক্ত করেছে, যা ২০২৪ সালে পরিপূর্ণতা পাবে।

আমরা জানি, মানুষ কঠোর প্রয়াস প্রচেষ্টা এবং নিরলস প্রতিযোগিতার মাধ্যমে স্বকীয় মর্যাদার উন্নিত ঘটায়। এটিকে অধ্যাপক লিনটন স্বোপার্জিত মর্যাদার অভিধায় ভূষিত করেছেন। পক্ষান্তরে অধ্যাপক ম্যাকাইভার একে মানুষের সামাজিক অবস্থানের ক্রিয়াবাদী নিয়ামক হিসেবে অভিহিত করেছেন। বিভিন্ন শিক্ষা কার্যক্রম বা জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্র থেকে ব্যক্তি কতটুকুু সাফল্য অর্জন করেছেন তা পরিমাপের জন্য যে বিশেষ পদ্ধতি অবলম্বন করা হয় তা হলো ‘কৃতী অভীক্ষা’। এই অভীক্ষার অন্যতম মূল উদ্দেশ্য অর্জিত সাফল্যেও মাত্রা নির্ধারণ। ঠিক একইভাবে রাষ্ট্রকে মর্যাদাসীন বা উন্নয়নের মাত্রাকে নির্ধারণ করার লক্ষ্যেই যে প্রধান তিনটি সূচক জাতিসংঘ বা সিডিপি তাদের ভিত্তি হিসেবে গণ্য করেছে তা হলো মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক ঝুঁকি।

আমরা জানি, মনীষী কার্ল মার্কসের দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের তত্ত্বই তাঁর সমগ্র দর্শনের কেন্দ্রবিন্দু। এর সারকথা হলো সমগ্র বস্তুর অথবা প্রপঞ্চের বিকাশ হয় দ্বন্দ্বের কারণে। সমাজ পরিবর্তনের মূলে রয়েছে এই দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ অর্থাৎ পুরনো অবস্থার (বাদ=ঃযবংরং) সঙ্গে দ্বন্দ্ব চলে তার বিপরীত অবস্থার ( প্রতিবাদ=ধহঃরঃযবংরং)। এই ঝুহঃযবংরং কালক্রমে পুরনো অবস্থায় পরিণত হয় এবং তার বিপরীত অবস্থার সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়ে পুনরায় একটি নব ঝুহঃযবংরং জন্ম নেয়। এই প্রক্রিয়ায় মার্কসের মতে ব্যক্তি-বস্ত-সমাজের উৎপত্তি, বিকাশ ও পরিবর্তন সাধিত হয়। এটি যেমন এক অসাধারণ দর্শনের ভিত্তি ঠিক তেমনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনারও একটি অনন্য উন্নয়ন দর্শন অতীব ক্রিয়াশীল, যা বাংলাদেশের অর্থ-সামাজিক অবস্থার উত্তরোত্তর অগ্রগতিতে অসামান্য অবদান রেখে চলেছে।

দেশরতœ শেখ হাসিনার উন্নয়ন দর্শনের কেন্দ্র ভিত্তি হচ্ছে জাতির পিতার সোনার বাংলা বিনির্মাণের স্বপ্ন, যার মৌলিক নির্যাস হচ্ছে ‘দলমত নির্বিশেষে সকলের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসে আগামী প্রজন্মের জন্য একটি উন্নত ও সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলা’। এই দর্শনকে পরিপূর্ণ কার্যকর করার লক্ষ্যে তিনি দুটি অভিনব রূপকল্প (ভিশন) উপস্থাপন করেছেন। ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে বিশ্বে একটি উন্নত-সমৃদ্ধ দেশে পরিণত করা। এই লক্ষ্য নির্ধারণ করে বিভিন্ন মিশন কর্মপন্থা বা কর্মসূচী বাস্তবায়নের প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। আত্মনির্ভরশীল, স্বয়ম্ভর ও আত্মসম্মানে উজ্জীবিত দেশ গঠনে আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে নির্ভীক নেতৃত্বে বিভিন্ন উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশের অবস্থানকে উঁচুমাত্রিকতায় সুদৃঢ় করার নিরলস উদ্যোগ এবং তার দৃশ্যমান কর্মযজ্ঞের প্রতিনিয়ত প্রকাশ ঘটাচ্ছেন।

বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ৪৭ বছরের অগ্রযাত্রায় বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কর্মযজ্ঞকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে প্রায় সকল ক্ষেত্রে উন্নয়ন পরিক্রমা তথা দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার মাধ্যমে সহ¯্রাব্দ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন, ২০১৫-২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য বাস্তবায়নের রোডম্যাপে অগ্রসরমান শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, লিঙ্গ সমতা, দরিদ্রতার হার হ্রাস, গড় আয়ু বৃদ্ধি, শ্রমঘন রফতানিমুখী শিল্পায়ন, বিশেষায়িত অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে কর্মসংস্থান ও রাজস্ব উন্নয়ন, পোশাক এবং ওষুধ শিল্পকে রফতানিমুখীকরণ ইত্যাদি আজ দেশের মানচিত্রে সমুজ্জ্বল। অন্যদিকে ভৌত অবকাঠামো, যাতায়াত ব্যবস্থা ইত্যাদিকে অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে বিদ্যুত, গ্যাস, জ্বালানি ইত্যাদির সরবরাহ নিশ্চিতকরণ, পদ্মা সেতু, পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র, গভীর সমুদ্রবন্দর, মেট্রোরেল, টানেল নির্মাণ, পরিকল্পিত নগরায়ণ ও জলাবদ্ধতা নিরসন, সুপেয় পানি-ব্যবহারযোগ্য পানি প্রকল্প ও সুয়ারেজ প্রকল্পের বাস্তবায়নসহ বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণের মতো সফলতা-সক্ষমতা অর্জন বাংলাদেশ আজ বিশ্ব দরবারে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে স্বীকৃত।

বাংলাদেশের বর্তমান জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৭.৬৫%, মাথাপিছ জাতীয় আয় ১৬১০ মার্কিন ডলার, মানবসম্পদ উন্নয়ন সূচক ৬৯.৫ এবং অর্থনৈতিক ঝুঁকির মান ২৫.০৩। উল্লেখিত সূচক তথা মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ উন্নয়ন সূচক ও অর্থনৈতিক ঝুঁকির মান স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার জন্য প্রয়োজনের তুলনায় (যথাক্রমে ১২৩০ ডলার, ৬৬ এবং ৩২) বাংলাদেশের অবস্থান অধিকতর উন্নত। এই বিবেচনায় জতিসংঘের এই মূল্যায়ন। তবে এতে আত্মসন্তুষ্টির আবেগ যেমন রয়েছে, তেমনি এর ফলে সৃষ্ট চ্যালেঞ্জসমূহ বিবেচনায় রেখে আমাদের এগোতে হবে, যাতে ২০২৪ সালে সিডিপির বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়নে বাংলাদেশ সত্যিকার অর্থে বিশ্বের ৫৬টি উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় নিজের অবস্থানকে সক্রিয়ভাবে সুদৃঢ় করতে পারে। এই প্রত্যাশা ব্যক্ত করে এসবের সফল রূপকার এবং বিশ্ব নন্দিত-বরেণ্য রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করছি এবং মহান স্রষ্টার দরবারে বাংলাদেশের সার্বিক শান্তি, অগ্রগতি ও মঙ্গল প্রার্থনা করছি। জয়তু শেখ হাসিনা।

লেখক : শিক্ষাবিদ এবং উপাচার্য,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত