যে দিনটি ভুলতে বসেছিII মুজিবনগর সরকারঃ অধ্যাপক ড. আবু সাইয়িদ

2276

Published on এপ্রিল 11, 2018
  • Details Image

২৫ মার্চ '৭১। পাকিস্তান সামরিক বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালি জাতি ও বাঙালি সেনা-অফিসার, ইপিআর, পুলিশ বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালিয়ে নির্মম হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। শুরু হয় জনযুদ্ধ। প্রতিরোধ গড়ে ওঠে সর্বত্র। কিন্তু অপরিহার্য ছিল সরকার প্রতিষ্ঠার। পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীর আক্রমণে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ প্রতিবেশী ভারত সীমান্ত অতিক্রম করেন। 

২. দিল্লিতে ৪ এপ্রিল ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সরকারি বাসভবনে তাজউদ্দীন আহমদের সাক্ষাৎ হয়। তাজউদ্দীন আহমদ ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে বলেন, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অস্ত্র এবং অন্যান্য সামরিক উপকরণ, সহযোগিতা ও সংশ্নিষ্ট সাহায্যাদি প্রয়োজন। পিএন হাকসার, কে রুস্তমজী, গোলক মজুমদার প্রমুখ উচ্চপদস্থ ব্যক্তি সরকার গঠন প্রসঙ্গে তাজউদ্দীনের কাছে জানতে চান। সে জন্য তাজউদ্দীন সরকার গঠনের বিষয়ে পূর্বেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার পর তাজউদ্দীন আহমদ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠনের আনুষ্ঠানিক প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভব করেন। কারণ ইন্দিরা গান্ধীর কাছে তিনি নিজেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে উপস্থাপন এবং ২৬ মার্চেই শেখ মুজিব হাইকমান্ডারদের নিয়ে সরকার গঠন করেছিলেন বলে ইন্দিরা গান্ধীকে জানিয়েছিলেন। এই অবস্থায় ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল তাজউদ্দীন আনুষ্ঠানিক ঘোষণায় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। ১০ এপ্রিল ১৯৭১ সালে নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা মুজিবনগরে স্বাধীনতার সনদ ঘোষণা করেন। ঘোষণাপত্রে বলা হয়, 'বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশে জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ তারিখে ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করেন।' ওই ঘোষণায় আরও বলা হয়, 'বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী জনগণ কর্তৃক আমাদিগকে প্রদত্ত কর্তৃত্বের মর্যাদা রক্ষার্থে, বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করণার্থে সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রীরূপে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা ঘোষণা এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ইতিপূর্বে ঘোষিত স্বাধীনতা দৃঢ়ভাবে সমর্থন ও অনুমোদন করা হয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি থাকবেন এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রজাতন্ত্রের উপ-রাষ্ট্রপতি থাকবেন এবং রাষ্ট্রপতি প্রজাতন্ত্রের সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক' এবং অন্যান্য মন্ত্রী নিয়োগ করবেন। নির্বাহী, আইন প্রণয়ন, করারোপ, অর্থ ব্যয় এবং বাংলাদেশের জনগণকে একটি নিয়মতান্ত্রিক ও ন্যায়ানুগ সরকার প্রদানের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সব কার্য সম্পাদন করতে পারবেন। শুধু তাই নয়, স্বাধীনতার ঘোষণায় জাতিসংঘ সনদ মেনে চলার প্রতিশ্রুতি প্রদান করা হয়। এই ঘোষণাকে কার্যকর করার জন্য ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শপথ অনুষ্ঠিত হয়।

৩. ১০ এপ্রিল ১৯৭১ সরকার গঠিত হয় এবং ১৭ এপ্রিল মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলা গ্রামের মুক্তাঞ্চলে এই সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ গ্রহণ করে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বৈদ্যনাথতলার নতুন নামকরণ করেন মুজিবনগর। মুজিবনগর নামকরণ হলেও রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম চলেছে কলকাতা থেকে। শপথ অনুষ্ঠানের পরপরই অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ উপস্থিত সাংবাদিকদের সামনে এই স্থানটিকে বাংলাদেশ সরকারের রাজধানী মুজিবনগর হিসেবে উল্লেখ করায় বিশ্বব্যাপী এই সরকার মুজিবনগর সরকার হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশ সরকার নিজেকে কখনই প্রবাসী হিসেবে স্বীকার করেনি। শপথ অনুষ্ঠানের পরে ভারত সরকারের স্বীকৃতি চেয়ে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী যে পত্র এবং সংশ্নিষ্ট আইনানুগ দলিলাদি প্রেরণ করেন, তার ঠিকানা ছিল মুজিবনগর। এ কথা আজ প্রমাণিত যে, বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের লক্ষ্যে প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে পূর্বেই যোগাযোগ স্থাপন করেছিলেন। পৃথিবীর যেসব দেশে গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে দেশের মুক্তিসংগ্রাম পরিচালিত হয়, সেসব দেশের জন্য পার্শ্ববর্তী দেশের সহযোগিতা অনিবার্য হয়ে পড়ে। সে লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু ১৯৬৯ সালের ২৪ অক্টোবর লন্ডন গমন করেন। লন্ডনে তার আগমন ও কার্যক্রম পর্যালোচনায় তিনটি দিক থেকে ঐতিহাসিক ও তাৎপর্যপূর্ণ- এক. লন্ডনে প্রবাসী বাঙালি, ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সদস্য, নেতৃবৃন্দ এবং গণমাধ্যমের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ; দুই. যুক্তরাজ্যে বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনায় উজ্জীবিত জনগোষ্ঠীকে রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক কাঠামোয় শক্তিশালীকরণ; তিন. বাংলাদেশের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে ও গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী বাধা সৃষ্টি করলে বহির্বিশ্বের, বিশেষ করে প্রতিবেশী দেশ ভারতের সমর্থন ও সহযোগিতা পাওয়া যাবে কিনা তা নিশ্চিত হওয়া। এ সময় ভারত সরকারের প্রতিনিধির সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ হয়। এ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুকন্যা ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘটনার ওই সময়ে লন্ডনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে থাকায় বিষয়টি তার অজ্ঞাত নয়।

৪. সত্তরের নির্বাচনের আগেও বঙ্গবন্ধু তাঁর প্রতিনিধিকে ভারতে পাঠিয়েছিলেন। নির্বাচনের পর পাঠান ডাক্তার আবু হেনাকে, প্রাদেশিক আইনসভার সদস্য হয়েছিলেন সিরাজগঞ্জ থেকে। আর আগে যিনি গিয়েছিলেন তিনি আমাদের জন্য আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেন। সে জন্য লক্ষ্য করা যায়, সীমান্ত অতিক্রম করার পরেই ভারত সরকারের সহযোগিতায় মুজিবনগর সরকার গঠন যেমন দ্রুত হয়েছে, তেমনি মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং ও যুদ্ধ সরঞ্জাম ইত্যাদি প্রাপ্তি এবং রেডিও সম্প্রচার হয়। 

৫. ১০ এপ্রিল ১৯৭১ সাল। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন বরাবর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান কর্তৃক লিখিত পত্রটি অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা এম এম আহমদ বরাবর হস্তান্তর করেন। পত্রে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বলেন, দীর্ঘ ১১ দিন তিনি ঢাকায় অবস্থান করে পাকিস্তানের অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ণ রেখে একটি শাসনতান্ত্রিক সমাধানের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করেন। কিন্তু একটি দেশপ্রেমহীন গোষ্ঠীর জন্য তা একটি ট্র্যাজিক পরিস্থিতির দিকে ধাবিত করে। তিনি পত্রে লেখেন যে, বর্তমান সংকট যে পাকিস্তানের 'অভ্যন্তরীণ বিষয়' এ কথাটি যুক্তরাষ্ট্র স্পষ্টভাবে নীতি হিসেবে ঘোষণা করায় তিনি অত্যন্ত সন্তুষ্ট ও কৃতজ্ঞ। তিনি পত্রের শেষাংশে উল্লেখ করেন, 'পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক হয়ে আসছে।' ওই দিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট থেকে প্রেরিত একটি পত্রে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার গঠন সম্পর্কে বলা হয়, ভারত তার ভূখণ্ডে অস্থায়ী সরকার পরিচালনার অনুমতি দিয়েছে এবং অর্থ সাহায্য দিচ্ছে। বাংলাদেশের প্রতিনিধিবৃন্দ তাদের সরকারকে সহযোগিতার জন্য বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে, যাদের ইতিমধ্যেই পাকিস্তান সরকার রাষ্ট্রদ্রোহ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এই অবস্থায় সিনিয়র রিভিউ গ্রুপের মিটিং অনুষ্ঠিত হয় ১৯ এপ্রিল বিকেল ৩টা ১০ মিনিটে। হেনরি কিসিঞ্জার মিটিংয়ে সভাপতিত্ব করেন। সভায় পরিস্থিতি পর্যালোচনায় হেনরি কিসিঞ্জারের প্রশ্নের জবাবে সিআইএ প্রধান লে. জেনারেল রবার্ট কুশমান বলেন, 'কুষ্টিয়ার নিকট চুয়াডাঙ্গায় বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কিনা এ নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। তবে তারা ইতিমধ্যেই শেখ মুজিবকে প্রধান করে সরকার গঠন করেছে। ভারত আপাতদৃষ্টিতে সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়টি ভাবছে; কিন্তু ওই সরকারের দখলে কোনো ভূখণ্ড নেই।'

৬. সিআইএ প্রধান বলেন, এই সরকারের স্বীকৃতি সম্পর্কে সোভিয়েত রাশিয়ার কাছে এর স্থায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে; যদিও সোভিয়েত রাশিয়া পূর্ব পাকিস্তানের 'ব্যাপক রক্তপাত' যা তারা 'গণহত্যা' বলে উল্লেখ করেছে, এর নিন্দা এবং অবিলম্বে তা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে। চীন প্রকাশ্যে পাকিস্তানকে সমর্থন করেছে এবং দ্ব্যর্থহীন ভাষায় পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন, ভারতের হস্তক্ষেপের নিন্দা জানিয়েছে। কিসিঞ্জার বলেন, স্বীকৃতির প্রশ্নই আসে না। তবে একটি বিষয় বিবেচনায় নিতে হবে, ৩০ হাজার সৈন্য যতই শক্তিশালী হোক না কেন ৭৫ মিলিয়ন লোককে তারা কীভাবে পদানত রাখবে, যদি না তাদের মধ্যে ভাঙন সৃষ্টি করা না যায়! 

৭. আন্তর্জাতিকভাবে বিভাজিত পরাশক্তির ঘৃণাবর্তের মধ্যেও আদর্শের পতাকা সমুন্নত রেখেই মুজিবনগর সরকার এগিয়ে যায়। আদর্শিক লক্ষ্য নির্ধারিত হয়েছিল 'বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করা'। স্বাধীনতার সনদ ছিল জেনেসিস অব দ্য কনস্টিটিউশন। এই সনদকে সামনে রেখেই ১০ এপ্রিল সরকার গঠিত হয়। ১৭ এপ্রিল প্রকাশ্যে হাজারো জনগণের মাঝে প্রতিনিধিবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ সদস্য হিসেবে শপথ অনুষ্ঠানে লেখক উপস্থিত থাকার বিরল সৌভাগ্যের অধিকারী। সেদিনের উদ্দীপিত দিনের কথা ইতিহাস অন্তর্গত। কিন্তু ভুলবার নয়।

৮. মুজিবনগর সরকারের কার্যক্রম পরিচালনা করলে স্বাধীনতা সনদের কয়েকটি মূল লক্ষ্য ও আদর্শ বেরিয়ে আসবে- এক. স্বাধীন বাংলাদেশের স্বীকৃতি আদায়ের লক্ষ্যে কার্যক্রম গ্রহণ; দুই. গেরিলা বাহিনী গড়ে তোলা ও সামরিক বাহিনীকে জোরদার করা; তিন. কূটনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধি করা এবং পাকিস্তানে কর্তব্যরত কূটনীতিকদের বাংলাদেশ সরকারের আনুগত্যে নিয়ে আসা; চার. জনগণের সরকার গঠন কাঠামোতে নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের আস্থা গ্রহণ এবং দায়িত্ব প্রদান; পাঁচ. সব জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্ত মোকাবেলা করে বন্দি মুজিবের মুক্তি ত্বরান্বিত করা। এই লক্ষ্যে জল, স্থল ও অন্তরীক্ষ অবরোধ করে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করা। জনগণের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা ১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়েছিল বলেই শত চক্রান্তের জাল ছিন্ন করে লাখো শহীদের রক্তের মাধ্যমে অভ্যুদয় ঘটেছে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের। জননেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের সংবিধানে 'স্বাধীনতার সনদ'কে সন্নিবেশিত করে এই দিনটিকে অমলিন করে রেখেছেন।

সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী ও '৭২ সালের খসড়া সংবিধান প্রণেতা

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত