স্বাধীনতা অর্জনে বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব

7156

Published on আগস্ট 12, 2018
  • Details Image

ফরিদা ইয়াসমিনঃ

বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব। যার জন্ম এই আগস্ট মাসেই। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের দীর্ঘ প্রেক্ষাপটে যার ছিল অসাধারণ নেপথ্য ভূমিকা। তিনি দুঃসময়ে বঙ্গবন্ধুকে প্রেরণা জুগিয়েছেন, পরামর্শ দিয়েছেন, সাহস জুগিয়েছেন। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহধর্মিণী হয়ে প্রতিটি কাজের প্রেরণার উৎস হয়েছেন। জন্ম মাসেই ১৫ আগস্ট জাতির জনকের সঙ্গে বুলেটের নির্মম আঘাতে জীবন দিতে হয়েছে বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবকে।

খুব অল্প বয়সেই বিয়ে হয় বেগম ফজিলাতুন নেছার। শ্বশুর-শাশুড়ি ও দেবর-ননদের সঙ্গেই তিনি বেড়ে ওঠেন। বেগম ফজিলাতুন নেছার জন্ম দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর মা সম্পর্কে বলেন, ‘তিনি স্বামীকে খুব কম সময়ই কাছে পেতেন। আমি যদি আমাদের জীবনটার দিকে ফিরে তাকাই এবং আমার বাবার জীবনটা যদি দেখি কখনো একটানা দুটি বছর আমরা কিন্তু বাবাকে কাছে পাইনি। স্ত্রী হিসেবে আমার মা ঠিক এভাবে বঞ্চিত ছিলেন। কিন্তু কখনো কোনো দিন কোনো অনুযোগ-অভিযোগ তিনি করতেন না। তিনি সব সময় বিশ্বাস করতেন, তার স্বামী দেশের জন্য কাজ করছেন, মানুষের জন্য কাজ করছেন, মানুষের কল্যাণের জন্য কাজ করছেন। মায়ের দাদা যে সম্পত্তি দিয়ে গেছেন প্রচুর জমিজমা। জমিদার ছিলেন। সব সম্পত্তি মায়ের নামে। এর থেকে যে টাকা আসত আমার দাদা সব সময় মায়ের হাতে দিয়ে দিতেন। একটি টাকাও মা নিজের জন্য খরচ করতেন না, সব জমিয়ে রাখতেন। কারণ জানতেন যে, আমার বাবা রাজনীতি করেন। তার টাকার অনেক দরকার। আমার দাদা-দাদি সব সময় দিতেন। দাদা সব সময় ছেলেকে টাকা দিতেন, তার পরেও মা তার ওই অংশটুকু, বলতে গেলে নিজেকে বঞ্চিত করে টাকাটা বাবার হাতে সব সময়ই তুলে দিতেন। এভাবেই তিনি সহযোগিতা শুরু করেন, তখন কতইবা বয়স। পরে যখন ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন হয়, সে নির্বাচনে নির্বাচনী কাজে সবাই সম্পৃক্ত আমার মাও সে সময় কাজ করেছেন।’

বঙ্গবন্ধু বারবার গ্রেফতার হয়েছেন, জেল-জুলুমের শিকার হয়েছেন। কিন্তু ভেঙে পড়েননি বেগম মুজিব। নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর মন্ত্রিসভার সদস্য হলেন শেখ মুজিব। মন্ত্রিসভা ভেঙে যাওয়ার পর গ্রেফতার হন বঙ্গবন্ধু। পুরো পরিবারকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়। শেখ হাসিনা সেই দিনের কথা স্মরণ করে বলেন, ‘১৪ দিনের নোটিস দিয়ে আমাদের বের করে দিল। কোথায় যাবেন, কেবল ঢাকায় এসেছেন, খুব কম মানুষকে মা চিনতেন। মন্ত্রী থাকা অবস্থায় ওই বাসায় মানুষে মানুষে গমগম করত। কিন্তু ওইদিন সব ফাঁকা, আমার আব্বার ফুফাতো ভাই, আমার এক নানা তারা এলেন, বাড়ি খোঁজার চেষ্টা। নাজিরাবাজার একটা বাড়ি পাওয়া গেল, সে বাসায় আমাদের নিয়ে উঠলেন। এভাবেই একটার পর একটা ঘাত-প্রতিঘাত এসেছে। কিন্তু একটা জিনিস বলব, মাকে কখনো ভেঙে পড়তে দেখিনি। যত কষ্টই হোক, আমার বাবাকে কখনো বলেননি যে, তুমি রাজনীতি ছেড়ে দাও বা চলে আসো বা সংসার কর বা সংসারের খরচ দাও। কখনো না। সংসারটা কীভাবে চলবে, সম্পূর্ণভাবে তিনি নিজে করতেন। জীবনে কোনো প্রয়োজনে আমার বাবাকে বিরক্ত করেননি। মেয়েদের অনেক আকাঙ্ক্ষা থাকে স্বামীদের কাছ থেকে পাওয়ার। শাড়ি, গয়না, বাড়ি, গাড়ি কত কিছু। এত কষ্ট তিনি করেছেন জীবনে কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলেননি। কিছু চাননি। ১৯৫৪ সালের পরেও বাবাকে বারবার গ্রেফতার হতে হয়েছে। তারপর ১৯৫৫ সালে তিনি আবার মন্ত্রী হন, মন্ত্রিসভায় যোগ দেন। আমরা ১৫ নম্বর আবদুল গণি রোডে এসে উঠি।’

বারবার শেখ মুজিব পরিবারকে ঘরছাড়া হতে হয়েছে। বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব দৃঢ়চিত্তে সব কিছু মোকাবিলা করেছেন। ছোট ছোট ছেলেমেয়ে নিয়ে নতুন আশ্রয়ের খোঁজ করেছেন কিন্তু ছিল না কোনো অনুযোগ-অভিযোগ। বর্তমানের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, ‘আইয়ুব খান যেদিন মার্শাল ল ডিক্লেয়ার করলেন আব্বা করাচিতে ছিলেন। তাড়াতাড়ি চলে এলেন। তার পরই ১১ অক্টোবর দিবাগত রাতে অর্থাৎ ১২ তারিখে আব্বাকে গ্রেফতার করা হলো। আমার দাদি আমাদের সঙ্গে ছিলেন, গ্রেফতার করার সঙ্গে সঙ্গে বাড়িতে যে নগদ টাকা ছিল, আমাদের গাড়ি ছিল সব সিজ করে নিয়ে যাওয়া হলো। অত্যন্ত ধৈর্যের সঙ্গে আমার মাকে দেখেছি সে অবস্থা সামাল দিতে। মাত্র ছয় দিনের নোটিস দিয়ে আমাদের বাড়ি থেকে বের করে দিল। মালপত্তর নিয়ে রাস্তার ওপর আমরা ছোট ছোট ভাইবোন। তখন রেহানা খুবই ছোট। একজন একটা বাসা দিল। দুই কামরার বাসাতে আমরা গিয়ে উঠলাম। দিনরাত বাড়ি খোঁজা। আব্বার বিরুদ্ধে তখন একটার পর একটা মামলা দিচ্ছে, এই মামলা-মোকদ্দমা চালানো, কোর্টে যাওয়া এবং বাড়ি খোঁজা সমস্ত কাজ আমার মা অত্যন্ত ধৈর্যের সঙ্গে করতেন।’

শুধু নিজের পরিবার-পরিজন নয়। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের অসুখ-বিসুখে তাদের পরিবারের খোঁজখবর নেওয়া, যারা জেলখানায় আটক ছিল তাদের পরিবারকে প্রয়োজনে বাজার-সদাই করে দিতেন। এসব করতে গিয়ে কখনো কখনো তাঁর গহনা বিক্রি করতে হয়েছে। এমনকি নিজের পরিবারের অভাব-অনটন তিনি খুব হাসিমুখেই মেনে নিয়েছেন এবং বিভিন্ন সময়ে অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে তা কাটিয়ে উঠেছেন। তিনি কখনো তা ছেলেমেয়েদের বুঝতে দেননি। জাতির জনকের কন্যা শেখ হাসিনা সেই দিনগুলোর কথা স্মরণ করে বলেন, ‘এমনও দিন গেছে বাজার করতে পারেননি। আমাদের কিন্তু কোনো দিন বলেননি আমার টাকা নাই, বাজার করতে পারলাম না। চাল-ডাল দিয়ে খিচুড়ি রান্না করেছেন, আচার দিয়ে বলেছেন প্রতিদিন ভাত ভালো লাগে নাকি; আজকে আমরা গরিব খিচুড়ি খাব। এটা খেতে খুব মজা। আমাদের সেভাবে তিনি খাবার দিয়েছেন। একজন মানুষ তার চরিত্র দৃঢ় থাকলে যে কোনো অবস্থা মোকাবিলা করার মতো ক্ষমতা ধারণ করতে পারে। অভাব-অনটনের কথা, হা-হুতাশ কখনো মার মুখে শুনিনি।’ উত্তাল দিনগুলোতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে ছায়ার মতো ছিলেন বেগম মুজিব। শেখ হাসিনার স্মৃতিচারণে সেসব দিনের কথা উঠে আসছে, ‘১৯৬২ সালে আবার আব্বা গ্রেফতার হলেন, ১৯৬৪ সালে আবার গ্রেফতার হলেন। আমি যদি হিসাব করি কখনো আমি দেখিনি দুটো বছর তিনি একনাগাড়ে কারাগারের বাইরে ছিলেন। জেলখানায় থাকলে সেখানে যাওয়া, আব্বার কী লাগবে সেটা দেখা, তার কাপড়-চোপড়, খাওয়া-দাওয়া, মামলা-মোকদ্দমা চালানো সবই কিন্তু মা করে গেছেন। পাশাপাশি সংগঠনের সঙ্গে সব সময় যোগাযোগ তাঁর ছিল। বিশেষ করে ছাত্রলীগ তো তিনি নিজের হাতেই গড়ে তোলেন। ছাত্রলীগের পরামর্শ, যা কিছু দরকার তিনি দেখতেন।’ বিভিন্ন হামলা-মামলা, বিশেষ করে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিষয়ে বেগম মুজিবকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল। শেখ মুজিব যখন গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে নেতাদের সঙ্গে বসতেন, বেগম মুজিব সবসময় খেয়াল রাখতেন কী সিদ্ধান্ত হচ্ছে। তিনি সময়মতো তার মতামত দিতেন কিন্তু কখনো তাদের সঙ্গে বৈঠকে বসতেন না। তিনি তার বার্তাটি পৌঁছে দিতেন। মায়ের জন্মদিন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আইয়ুব খান গোলটেবিল বৈঠক ডাকল সেখানে যেতে হবে। না গেলে সর্বনাশ হবে। মা খবর পেলেন। আমাকে পাঠালেন, বললেন আমার সঙ্গে কথা না বলে কোনো সিদ্ধান্ত যেন তিনি না দেন। আমাদের বড় বড় নেতারা সবাই ছিলেন, তারা নিয়ে যাবেন। আমার আব্বা জানতেন, আমার উপস্থিতি দেখেই বুঝে যেতেন যে, মা কিছু বলে পাঠিয়েছেন। মা খালি বলে দিয়েছিলেন, আব্বা কখনো প্যারোলে যাবে না, যদি মুক্তি দেন তখন যাবেন। সে বার্তাটাই আমি পৌঁছে দিয়ে এসেছিলাম, আর তার জন্য আমাদের নেতারা বাসায় এসে বকাঝকা। তুমি কেমন মেয়ে, তুমি চাও না তোমার বাবা বের হোক জেল থেকে। ভাবিকে বলত, আপনি তো বিধবা হবেন। মা শুধু বলেছিলেন আমি তো একা না। এখানে তো ৩৪ জন আসামি, তারা যে বিধবা হবে এটা আপনারা চিন্তা করেন না? আমার একার কথা চিন্তা করলে চলবে? আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় ৩৫ জনের মধ্যে ৩৪ জনই তো বিবাহিত। মামলা না তুললে তিনি যাবেন না। তার যে দূরদর্শিতা রাজনীতিতে, সেটাই কিন্তু আমাদের স্বাধীনতার পথ খুলে দিয়েছে। কারণ সেদিন যদি প্যারোলে যেতেন তাহলে কোনো দিনই আর বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না। এটা হলো বাস্তবতা। এরপর অসহযোগ আন্দোলনসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে আমি দেখেছি মায়ের দৃঢ় ভূমিকা।’

৭ মার্চের ভাষণ সম্পর্কে শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘বেগম মুজিব বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, তুমি তোমার মনের কথাই সে সময়ে বলবে। তোমার স্বপ্নের কথা বলবে।’

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ আজ সারা বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ভাষণ। বঙ্গবন্ধু তাঁর মনের কথাগুলো বলেছিলেন বলে আজ এটিই শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদায় শ্রেষ্ঠতম স্থানে পৌঁছেছে। স্বাধীনতা ঘোষণার পর বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার এবং মুক্তিযুদ্ধের শুরু। তারপর একরকম বন্দীজীবন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও তিনি বিলাসী জীবনে ফিরে যেতে পারতেন। কিন্তু নিজের গড়া ৩২ নম্বরের বাড়িতেই থেকে যান। সারা জীবন ছায়ার মতো স্বামীর পাশেই ছিলেন। ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তিনি বলেছিলেন, ‘ওনাকে যখন মেরে ফেলেছো আমাকেও মেরে ফেল’। প্রচারবিমুখ মহীয়সী নারী বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব। পর্দার অন্তরালে থেকে দেশের স্বাধীনতা-সংগ্রামে নিরন্তর প্রেরণা জুগিয়েছেন।

বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্নে নিজের স্বপ্ন মিলিয়েছেন। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের পাশে ছায়ার মতো থেকে শক্তি জুগিয়েছেন। একটি স্বাধীন দেশের জন্মের ইতিহাসের সঙ্গে যে নামটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত তা ফজিলাতুন নেছা মুজিব। দীর্ঘ সংগ্রামে অনন্য ভূমিকার জন্য তিনি ক্রমেই হয়ে উঠেছেন বঙ্গমাতা।

লেখক : সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় প্রেস ক্লাব।

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত