আমার মিয়াভাই ও বুজি

11432

Published on আগস্ট 1, 2019
  • Details Image

শেখ কবির হোসেনঃ

আগস্ট মাস আমাদের জীবনে এক বেদনা-বিধুর, শোকের মাস। এই দিনেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের একদল দুর্বৃত্ত বিপথগামী সেনাসদস্য নির্মমভাবে হত্যা করে। পৃথিবীতে যত বাঙালি আছে, প্রত্যেকের জন্য এই মাসটি শোকাবহ বলে আমি মনে করি। এত শোক, এত নিষ্ঠুরতর, কাপুরুষোচিত হত্যাকাণ্ড দুনিয়ার ইতিহাসে বিরল!

আগস্ট মাস এলে বুকের ভেতরটা টনটন করে ওঠে। নিকটজন হারানোর বেদনার এক ভয়াবহ শূন্যতা ভর করে এই দিনে। আমি হারিয়েছি আমার পরিবারের ঘনিষ্ঠজনদের, বাঙালি হারিয়েছে তাদের প্রাণপ্রিয় নেতাকে ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের; আর বিশ্ব হারিয়েছে এক মহান নেতাকে। যাঁর নেতৃত্বে নানা প্রতিকূলতা, জেল-জুলুম-অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করেও দুর্বার গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হলো।

যে নেতার জন্ম না হলে বাংলাদেশের জন্ম হতো না- যে নেতার জন্ম না হলে একটি জাতিসত্তা হারিয়ে যেত চিরতরে; সেই মহান নেতাকে এই আগস্ট মাসেই একদল দুর্বৃত্ত সেনাসদস্য সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। আজ তাদের অনেকেরই বিচার হয়েছে। কিন্তু এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যে সব চক্রান্তকারী গোপনে-পেছনে ষড়যন্ত্র করেছে, তাদের বিচার হয়নি, তারাও একদিন বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াবে- এ আমার বিশ্বাস। ষড়যন্ত্রকারীদের বিচার হলে জাতিও গর্বিত হবে।

হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একক নেতৃত্বে দীর্ঘ ৯ মাসের সশস্ত্র যুদ্ধের পর দেশ স্বাধীন হলো। মৃত্যুর মুখ থেকে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের বন্দিদশা থেকে স্বমহিমায় ফিরে এলেন তাঁর প্রিয় জন্মভূমিতে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পুঞ্জীভূত সমস্যা সমাধানে তিনি অসামান্য দূরদর্শিতা, দৃঢ়তা ও সাহসের পরিচয় দেন। এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য তাঁর আহ্বানে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সদ্য প্রত্যাগত মুক্তিযোদ্ধা ও অন্যদের অস্ত্র সমর্পণ করানো, চিন্তাতীত স্বল্প সময়ের মধ্যে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সহায়তাদানকারী ভারতীয় সেনাবাহিনীর বাংলাদেশ ভূখণ্ড ত্যাগ করানো ও দ্রুত সময়ের মধ্যে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য একটি আধুনিক, উন্নত, প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক, জনকল্যাণমুখী সংবিধান প্রণয়ন করা। সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য চার মূল স্তম্ভের কথা বলা হয়েছে। জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র- ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর বাংলাদেশ গণপরিষদে খসড়া সংবিধান অনুমোদিত হয়। সে সময়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে গণপরিষদে দাঁড়িয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু তাঁর স্বভাবসুলভ উদাত্ত কণ্ঠে বলেছিলেন- 'ভাষাই বলুন, শিক্ষাই বলুন, সভ্যতাই বলুন, আর কৃষ্টিই বলুন; সকলের সাথে একটা জিনিস রয়েছে। সেটা হলো অনুভূতি। এই অনুভূতি যদি না থাকে তাহলে কোনো জাতি বড় হতে পারে না এবং জাতীয়তাবাদও আসতে পারে না।'

স্বজন হারানোর বেদনায় আজ আমি পাথর। অনেক সাংবাদিক বন্ধু ১৫ আগস্টের এই দিন উপলক্ষে অনেক রকম মতামত ও অনুভূতি জানতে চান আমার কাছে। আমি কী অনুভূতি প্রকাশ করব। আমি তো হারিয়েছি আমার আপনজনকে, জাতি হারিয়েছে তাদের নেতা। তাই শোকাতুর বাঙালির অনুভূতির সঙ্গে আমার অনুভূতির ভিন্নতর কিছু নেই।

আমরা পারিবারিকভাবে কেউ কেউ বঙ্গবন্ধুকে 'বড়দাদা/মিয়াভাই' ডাকতাম। আর বঙ্গবন্ধুর স্ত্রীকে ডাকতাম 'বুজি'। প্রায় সময়ই তো বঙ্গবন্ধু জেলে থাকতেন। যখন জেল থেকে ছাড়া পেতেন, তখন আমাদের গ্রামের বাড়ি টুঙ্গিপাড়া যেতেন বঙ্গবন্ধু। আমরা গ্রামের সবাই অধীর আগ্রহে বসে থাকতাম- কখন মুজিব ভাই (বড়দাদা) আসবেন! যেই না এসে পড়তেন, আমাদের আনন্দের সীমা থাকত না। প্রিয় মুজিব ভাই এলে গ্রামে উৎসবের আমেজ বইত। গ্রাম্য নানা খেলা উপভোগ করতেন মুজিব ভাই। তার মধ্যে 'লাঠি খেলা', 'ঢালি পাক' খেলা ছিল ভাইজানের প্রিয়। আমাদের বড় এজমালি (একত্রিত) উঠোন ছিল। চাঁদনি রাত অথবা অন্ধকার রাতে হেজাক বাতি জ্বালিয়ে এই উঠোনের চারপাশে লোকজন দাঁড়িয়ে-বসে এই খেলা আমরা ও গ্রামবাসী উপভোগ করতাম। এসব কথা মনে হলে চোখের কোণে পানি আসে। আজ সেই দিন নেই- সেই 'বড়দাদা' নেই, 'বুজি' নেই; কামাল-জামাল আর তাদের স্ত্রীরাও নেই। নেই রাসেল, মনি ও তার স্ত্রী। সবাইকে খুনিরা নির্মমভাবে হত্যা করেছে।

তাই ১৫ আগস্ট তথা আগস্ট মাস আমার জন্য বিষাদ ও বেদনার একটি মাস। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের সেই বিভীষিকাময় রাতের অনেক স্মৃতি, অনেক ঘটনা এখনও চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। শুধু একটা প্রশ্নই মনের মধ্যে জাগে- কী অন্যায় বঙ্গবন্ধু করেছিলেন? আমি আজও এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাইনি। খুনিরা হয়তো জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানকে হত্যা করতে পেরেছে, কিন্তু তার আদর্শকে হত্যা করতে পারেনি। তাই তো জাতির পিতার সুযোগ্য উত্তরসূরি, আমাদের প্রাণপ্রিয় নেত্রী, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ় নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ সর্বক্ষেত্রেই এগিয়ে যাচ্ছে। খাদ্য, বিদ্যুৎ, শিক্ষা, বস্ত্র, চিকিৎসা, যোগাযোগ, তথ্যপ্রযুক্তি ও অর্থনীতিতে দেশ এগিয়ে চলেছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার পরপর চট্টগ্রামের বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র স্থাপন করেন। সেই অনুপ্রেরণায় ২০১৮ সালে বাংলাদেশের প্রথম স্যাটেলাইট 'বঙ্গবন্ধু-১' মহাশূন্যে উৎক্ষেপণ তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে এক বিপ্লব ঘটিয়েছে। নিম্ন-আয়ের দেশ থেকে সম্প্রতি আমরা উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হয়েছি। ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে এবং ২০৪১ সালে আমরা উন্নত দেশে পরিণত হবো, ইনশাআল্লাহ। এ সবই ছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন আজ পূরণ করছেন জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী, মাদার অব হিউম্যানিটি, জননেত্রী শেখ হাসিনা। আগামী ১১তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যাতে নৌকা প্রতীক নিয়ে তিনি আবারও জয়যুক্ত হয়ে উন্নয়নের এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে পারেন, সে জন্য দেশবাসীর কাছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর জন্য দোয়া কামনা করি। মহান আল্লাহ যেন আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে সুস্থ ও কর্মক্ষম রাখেন।

পরিশেষে আজ শুধু দুই হাত তুলে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের এই দিনে হারানো আমার সেই স্বজনদের রুহের মাগফিরাত কামনা করি- মহান আল্লাহতালা যেন তাদের সবাইকে জান্নাতবাসী করেন। আমীন।

লেখকঃ বঙ্গবন্ধুর চাচাতো ভাই

সৌজন্যেঃ দৈনিক সমকাল

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত