মাহমুদুর রহমান মান্না, এক হতাশার নাম!

12735

Published on সেপ্টেম্বর 23, 2018
  • Details Image

চিররঞ্জন সরকারঃ

নব্বইয়ের দশকে আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম, তখন টিএসসির সড়ক দ্বীপে এক সমাবেশে মাহমুদুর রহমান মান্নাকে প্রথম দেখি এবং তার বক্তব্য শুনি। বক্তা এবং ব্যক্তিত্ব হিসেবে তিনি অসাধারণ। সুন্দর গুছিয়ে কথা বলতেন। যুক্তি দিয়ে, উদাহরণ দিয়ে প্রাঞ্জল ভাষায়। তার বক্তব্য সবাই মনোযোগ দিয়ে শুনতেন।

চমৎকার চেহারা, পরিচ্ছন্ন পরিপাটি পোশাক, সুবিন্যস্ত কেশ, প্রজ্ঞাবান দৃষ্টি সব মিলিয়ে এক আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন তিনি। খুব সহজেই আর দশজনের থেকে আলাদা করা যেত। তাকে দেখলে তার কথা শুনলে যে কেউই মুগ্ধ হয়ে যেত। তার মধ্যে ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের একটা আভা অনেকেই লক্ষ করেছিলেন।

বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেখেছি মাহমুদুর রহমান মান্না রাজনীতিতে এগিয়ে যাচ্ছেন। তর তর করে উপরে উঠছেন। আমাদের দেশে রাজনীতিতে সফল হওয়ার সবচেয়ে কার্যকর যে তরিকা-আওয়ামী লীগ বা বিএনপিতে নাম লেখানো-তিনি সেই কাজটিও করেছেন। আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে তিনি ক্ষমতার সিঁড়িতে পা রেখেছেন। অল্পদিনের ব্যবধানে গুরুত্বপূর্ণ পদও পেয়েছেন। কিন্তু অধিক ‘তাড়াহুড়োয়’ কক্ষচ্যুতও হয়েছেন!

দল পরিবর্তনের ক্ষেত্রে মাহমুদুর রহমান মান্না অনেক সাফল্য দেখিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে তিনি মওদুদ আহমদের নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী। বগুড়ায় জন্ম নেওয়া মান্না ১৯৬৪ সালে ঢাকায় আসেন। ১৯৬৬ সালে এসএসসি পাস করেন আরমানিটোলা স্কুল থেকে। ঢাকা কলেজে থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন ১৯৬৮ সালে। ছাত্রজীবনেই ছাত্রলীগের সঙ্গে যুক্ত হন। স্বাধীনতার পর জাসদ গঠিত হলে রোমাঞ্চের নেশায় অনেক তরুণের সঙ্গে তিনিও ভেড়েন এই দলটিতে, ১৯৭৩ সালে ২২ বছর বয়সে চলে আসেন জাসদ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের পদেও।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ১৯৭২ সালে জাসদ ছাত্রলীগ থেকে চাকসুর জিএস নির্বাচিত হন মান্না। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে ১৯৭৯ সালে জাসদ ছাত্রলীগ থেকে ডাকসুর ভিপি নির্বাচিত হন। এরপরই জাসদ ভেঙে খালেকুজ্জামান ও আ ফ ম মাহবুবুল হকের নেতৃত্বে বাসদ গঠিত হলে মান্না থাকেন তাদের সঙ্গে। বাসদ ছাত্রলীগ থেকে ১৯৮০ সালে নির্বাচন করে দ্বিতীয় দফায় ডাকসুর ভিপি নির্বাচিত হন তিনি। দুবারই তার সঙ্গে জিএস ছিলেন বর্তমানে আওয়ামী লীগ নেতা আকতারুজ্জামান।

১৯৮৩ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত সময়ে বাসদের কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন তিনি। এরপর এক সময়ের জাসদ নেতা মীর্জা সুলতান রাজার নেতৃত্বে জনতা মুক্তি পার্টি গঠিত হলে ওই দলের নেতা হন মান্না। এই দলটি ১৯৯২ সালে আওয়ামী লীগে বিলুপ্ত হলে মান্না হয়ে যান আওয়ামী লীগের নেতা।

নিজের এলাকা বগুড়া-২ (শিবগঞ্জ) আসনে একাধিকবার নৌকা প্রতীক নিয়ে প্রার্থী হলেও জিততে পারেননি মান্না। ৯৬ এবং ২০০১ সালে পর পর দুবার তিনি আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে বগুড়া থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিএনপির প্রার্থীর কাছে পরাজিত হন। ২০০১ সালে সর্বশেষ আওয়ামী লীগের টিকিটে প্রার্থী হয়ে ৪৭ হাজার ভোট পেয়েছিলেন তিনি। সেবার বিএনপির প্রার্থী রেজাউল বারী ডিনা ১ লাখ ১৬ হাজার ভোট পেয়ে জয়ী হন।

ভোটে হারলেও কাউন্সিলে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকের পদে আসেন মান্না। ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা জারির সময়ও দলের ওই পদেই ছিলেন তিনি।

২০০৭ সালে রাজনীতিতে সেনা হস্তক্ষেপের পর দুই নেত্রীকে বাদ দেওয়ার চেষ্টা, যা মাইনাস টু ফর্মুলা হিসেবে পরিচিত, তাতে মান্নার সক্রিয় ভূমিকার কথা বেশ আলোচিত। এজন্য তাকে ওয়ান-ইলেভেনের ‘কুশীলব’ বলেন আওয়ামী লীগ নেতারা। ‘বিতর্কিত ভূমিকা পালনের’ অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে আওয়ামী লীগের কক্ষপথ থেকে তিনি ছিটকে পড়েন।

২০০৯ সালে অনুষ্ঠিত কাউন্সিলে সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ থেকে বাদ পড়ে কার্যত আওয়ামী লীগে অপাংক্তেয় হয়ে পড়েন মান্না। দলবিযুক্ত মান্না তখন থেকে বিভিন্ন আলোচনা অনুষ্ঠান ও টেলিভিশন টক শো-তে সক্রিয় হয়ে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখেন। এই সময়ে নাগরিক সমাজের হয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে প্রতিনিধিত্ব করতে দেখা যায় তাকে, ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে ড. কামাল হোসেনের সঙ্গেও। এর মধ্যে ২০১২ সালে নাগরিক ঐক্য নামে একটি সংগঠনের ঘোষণা দেন ৬২ বছর বয়সী মান্না।

এর পর ক্রমেই তিনি আওয়ামী বিরোধী ভূমিকায় ফিরে যান। অবশ্য ছাত্রজীবনে আওয়ামী বিরোধী ভূমিকা দিয়েই মান্নার জনপ্রিয়তার শুরু। উল্লেখ্য, স্বাধীনতা পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ উগ্র সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দল হিসেবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আবির্ভূত হয়েছিল। ঐ সময় মাহমুদুর রহমান মান্না জাসদ সমর্থিত ছাত্রলীগের অগ্রভাগে ছিলেন। তখন জাসদ নেতারা কথায় কথায় বঙ্গবন্ধুকে অপমান করতেন। ব্যঙ্গ করতেন। মান্নাও তখন সেই পথের পথিক ছিলেন।

প্রায় এক দশক তীব্র বিএনপি-জামায়াত বিরোধী ভূমিকা পালনকারী মান্না আওয়ামী বিরোধী ভূমিকা পালন করতে গিয়ে বিএনপির দিকে ঝুঁকে পড়েন। বিএনপি-জামায়াত জোট পরিচালিত বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে হিংস্র ও ভয়াবহ অবরোধ-হরতাল-পেট্রোল-বোমা সন্ত্রাসের সময় পরিস্থিতি যখন অস্থিতিশীল, তখনই আবার আলোচনায় আসেন মান্না; দুটি অডিও টেপে তার বক্তব্যকে কেন্দ্র করে। মান্নার সঙ্গে বিএনপি নেতা সাদেক হোসেন খোকার একটি এবং অজ্ঞাত পরিচয়ের একজনের আরেকটি অডিও ক্লিপে শোনা যায়, সেই সময়ের পরিস্থিতিতে সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপের বিষয়ে তাকে আগ্রহ প্রকাশ করতে। অডিওতে সরকার বিরোধী আন্দোলন চাঙ্গা করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লাশ ফেলার ব্যাপারেও আলোচনা করতে শোনা যায়।

এই ঘটনার পর পরই তাকে গ্রেফতার করা হয়। প্রায় ২২ মাস কারাগারে কাটিয়ে মুক্তি লাভের পর এখন আবার তিনি ফুল-টাইম আওয়ামী বিরোধী রাজনীতিতে মনোনিবেশ করেছেন।

মাহমুদুর রহমান মান্নার রাজনৈতিক জীবন পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, পদ-পদবির জন্য সব সময়ই ছিলেন মরিয়া। এ জন্য তিনি যখন যে দলে সুবিধা তখন সেই দলে যোগ দিয়েছেন। মানিয়েও নিয়েছেন চমৎকার। ‘আদর্শ’ এ ক্ষেত্রে কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেনি। পর পর দুইবার সংসদ নির্বাচনে বগুড়া থেকে পরাজিত হলে তিনি ঢাকা থেকে নির্বাচন করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। এ ব্যাপারে তিনি শেখ হাসিনার কাছে তার এই ইচ্ছার কথা নাকি তুলেও ধরেছিলেন। কিন্তু হাসিনা মান্নার আবদারে সন্মতি প্রকাশ করেননি। অনেকে বলেন এই কারণেই নাকি মাহমুদুর রহমান মান্না হাসিনার প্রতি মনক্ষুণ্ণ ছিলেন। সর্বশেষ তিনি ঢাকার মেয়র হওয়ার ইচ্ছে পোষণ করেছিলেন। শেখ হাসিনা তাতেও সম্মতি দেননি। ফলে মান্না আওয়ামী লীগ রাজনীতি থেকে দূরে সরে আসার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এমনকি তিনি সর্বশেষ ঢাকা সিটি করপোরশেন নির্বাচনের প্রাক্কালে বিএনপির সমর্থনের জন্য সাদেক হোসেন খোকাকে টেলিফোনও করেছিলেন।

মান্না বিভিন্ন টকশোতে অংশগ্রহণ করে সরকার বিরোধী নানা মতামত প্রকাশ করায় সরকারের কুনজরে ছিলেন। আর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে টকশোতে কথা বলতে গিয়ে তিনি ক্রমে বিএনপির রাজনীতির কাছাকাছি এসে পরেছিলেন। এক সময় শোনা গিয়েছিল তিনি বিএনপিতে যোগ দেবেন। ড. কামাল হোসেনকে সঙ্গে নিয়ে বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখাও করেছেন। কিন্তু রাজনীতিতে কোনঠাসা বিএনপির বর্তমান দুরাবস্থায় তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপিতে যোগ দেননি।

গত কয়েক বছর ধরে ড. কামাল হোসেন, বি চৌধুরী, কাদের সিদ্দিকীসহ আওয়ামী লীগ-বিএনপিতে টিকতে না পারা ‘ব্যর্থ রাজনীতিক’রা যে জোট গঠনের চেষ্টায় আছেন, মান্নাও এই উদ্যোগের সহযাত্রী। বর্তমানে এই লোকগুলোর কারুরই জনসমর্থন নেই। রাজনীতিতে তাদের নৈতিক ভিত্তিও দুর্বল। সঙ্গ কারণে সাধারণ মানুষের আস্থার জায়গায়ও তারা অর্জন করতে পারেননি। তারা প্রত্যেকেই আসলে একেকটা ‘শূন্য’। এখন শূন্যের সঙ্গে শূন্য যোগ করলে আদৌ কি রাজনৈতিক পরিবর্তন আনা সম্ভব?

ষাটের দশকের শেষ দিকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন মাহমুদুর রহমান মান্না। ঐ সময় তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সক্রিয় ছিলেন “অনেক সুর্যের আশা” নামের একটি সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে।

সেই ‘অনেক সুর্যের আশা’ মেটাতে গিয়ে তিনি নিজে ‘নক্ষত্র’ হয়ে রাজনীতির কক্ষপথে ছুটে বেড়িয়েছেন। কখনও সমাজতন্ত্র, কখনও পুঁজিতন্ত্র, কখনও মুজিব বিরোধী কখনও মুজিবপন্থী, কখনও রাজাকার বিরোধী কখনও রাজাকারের জোটের আশ্রয়প্রার্থী হয়েছেন। কিন্তু ভাগ্যের শিকে ছিঁড়তে ছিঁড়তে ছেঁড়েনি। না পেরেছেন এমপি হতে, না পেরেছেন মন্ত্রী হতে। এমনকি ঢাকার মেয়র হওয়ার খায়েশও পূরণ হয়নি! আর এখন তো তিনি কক্ষচ্যুত নক্ষত্র!

‘অনেক সুর্যের আশা’ মান্না এখন পুরোপুরিই এক হতাশার নাম!

সৌজন্যেঃ bdnews24.com

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত