জন্মের ঠিকানায় স্বদেশ ও বিএনপির হারাকিরি - মোস্তাফা জব্বার

4451

Published on জানুয়ারি 6, 2019
  • Details Image

 

আমি এই লেখাটি লিখতে শুরু করেছিলাম ৩০ ডিসেম্বর রাত সোয়া ৯টায়। সেই থেকে ৪ জানুয়ারি অবধি সদ্য অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ধারাবাহিকতা দেখে মনে হচ্ছে, দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি একটি হারাকিরি বা আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। একদিকে বাংলাদেশ তার জন্মের ঠিকানায় প্রতিস্থাপিত হবার পথে অসাধারণ একটি অগ্রগতি সাধন করেছে এবং অন্যদিকে বিএনপি মুসলিম লীগে পরিণত হবার পথে আরও একধাপ এগিয়েছে। এই নির্বাচন কেবল বিএনপিকেই লাল কার্ড দেখায়নি; শেকড় উপড়ে ফেলেছে বাংলাদেশবিরোধী জামায়াত-শিবিরের। সংসদে যোগ না দিয়ে কেবল দলটি নয় পুরো ফ্রন্টটি বিলুপ্ত হবার প্রক্রিয়ার দিকে ধাবিত হচ্ছে। একে অন্য অর্থে বলা যেতে পারে রাজনৈতিক আত্মহত্যা-জাপানীরা একে বলে হারাকিরি বা স্বেচ্ছামৃত্যু।

এখন ১৮ সালের নির্বাচনের ফল স্পষ্ট। ৩০০টি আসনের মাঝে ১টির নির্বাচন হয়নি-অন্য একটি আসনের নির্বাচন স্থগিত থাকার ফলে মোট ২৯৮টি আসনের মাঝে ঐক্যফ্রন্ট পেয়েছে ৭টি, যার মধ্যে ৫টি বিএনপির। এরই মাঝে মহাজোটের সংসদ সদস্যরা শপথ নিয়েছেন। শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের নেতা হিসেবে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সরকার গঠনের আহ্বান পেয়েছেন। ৭ জানুয়ারি বিকেলে নতুন মন্ত্রিসভা শপথ নিতে যাচ্ছে। ঐক্যজোট তাদের সংসদ সদস্যদের শপথ নিতে দিচ্ছে না। নির্বাচনের পর পরই তারা নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে এবং পুনর্নির্বাচন দাবি করে। সর্বশেষ সিদ্ধান্ত অনুসারে ঐক্যফ্রন্টের নেতারা তাদের প্রার্থীদের আদালতে মামলা করার নির্দেশ দিয়েছে। জাতীয় পার্টি একটি ক্ষুদ্র সংসদীয় দলে পরিণত হয়েছে এবং বিরোধী দল হিসেবে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারা সরকারে থাকবে না বলেও জানিয়েছে, যেমনটি দ্বিতীয় সংসদে ছিল। জাতীয় পার্টির প্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।

স্বাধীনতার ৪৭ বছর পার করা এবং এই সময়ে বেশ কয়েকবার সামরিক আইনের দাসত্ব অতিক্রম করেও আমরা একাদশতম সংসদ নির্বাচনে পৌঁছতে পেরেছি সেটা অবশ্যই গর্বের বলে মনে করি। যারা দেশটির ইতিহাস জানেন এবং আমার বয়সী তারা দেশের জাতীয় সংসদের প্রথম নির্বাচন থেকে দশমটি পর্যন্ত সব নির্বাচনের কথাই স্মরণ করতে পারবেন। কারও কারও স্মৃতিতে ’৭০-এর নির্বাচনও মনে থাকতে পারে। এজন্য মাত্র অর্ধশতাব্দীর একটু বেশি বয়স দরকার। ’৭০-এর সংসদীয় নির্বাচন বাংলাদেশের জন্ম দেয়। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ। সেই নির্বাচনে ৩০০টি আসনের মাঝে ২৯৩টি আসন পেয়েছিল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সময়কালে সেটিই একমাত্র সংসদ নির্বাচন। দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি। বিএনপি সেই নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে ২০৭টি পায়। তৃতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ৭ মে ’৮৬। সেই নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ৩০০ আসনের মাঝে ১৫৩টি আসন পায়। বিএনপি সেই নির্বাচন বর্জন করে। চতুর্থ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ৩ মার্চ ’৮৮। আওয়ামী লীগ-বিএনপিসহ প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো সেই নির্বাচন বর্জন করে। ফলে জাতীয় পার্টি ৩০০টির মাঝে ২৫১টি আসন দখল করে। পঞ্চম জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ’৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি। নির্বাচনে বিএনপি ১৪০টি আসনে জয়লাভ করে জামায়াতের সহায়তায় সরকার গঠন করে। ষষ্ঠ জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ’৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি। বিএনপি তখন প্রায় সকল আসনেই জয়ী হয়। সেই সংসদটিই সম্ভবত বাংলাদেশের সবচেয়ে ক্ষণস্থায়ী সংসদ। ৭ম জাতীয় সংসদের নির্বাচন হয় ১২ জুন ১৯৯৬। সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১৪৬টি আসনে জয়লাভ করে। ১ অক্টোবর ২০০১ সালে অনুষ্ঠিত হয় অষ্টম জাতীয় সংসদের নির্বাচন। সরকার গঠন করে বিএনপি। নবম জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২৯ ডিসেম্বর ২০০৮। এই নির্বাচনে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। দশম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ৫ জানুয়ারি ’১৪। এই নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। ৩০ ডিসেম্বর ২০১৮ অনুষ্ঠিত হয় একাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচন। এসব নির্বাচনের মাঝে ’৭৫ পরবর্তী ’৯১ অবধি সামরিক শাসন বা তার আড়ালে গণতন্ত্র বহাল থাকার বিষয়টি সকলেরই জানা। এর পর ২০০৭-০৮ সময়কালে সামরিক বাহিনী সমর্থিত অনির্বাচিত সরকার ছিল। তবে একনাগাড়ে এক দশক একটি দলের নির্বাচিত সরকার এবারই প্রথম আমরা দেখলাম।

 

এবার যেভাবে নির্বাচনটা হয়েছে সেটাও একটু বৈচিত্র্যময়। যদিও বলতে গেলে বাংলাদেশের সব সংসদ নির্বাচনই কোন না কোনভাবে ভিন্ন ভিন্ন মাত্রার হয়েছে তবুও এবারের নির্বাচনটি ঘিরে এমন কিছু বিষয় যুক্ত হয়েছে যা এর আগের নির্বাচনগুলোতে কখনও ছিল না। নির্বাচন বিশ্লেষক, টক শোর আলোচক, সাংবাদিক, রাজনৈতিক ও সাধারণ মানুষের মাঝে এবারের নির্বাচনটি সেই কারণেই বহুল আলোচিত। আমি এর সাধারণ বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করতে চাই না। ভোটের রাজনীতি, ভোটের পরিবেশ, রাজনৈতিক বক্তব্য-পাল্টা বক্তব্য ইত্যাদি এরই মাঝে এত আলোচিত হয়েছে যে রাজনীতিপ্রিয় বাঙালী আবারও দেখিয়েছে যে, এটি তার দৈনন্দিন জীবনের ডাল-ভাত। তবে এবারের নির্বাচনের বড় নতুনত্ব হচ্ছে জোট-মহাজোট ও তার রাজনৈতিক মেরুকরণ। ’৭৫ এ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করার পর বাংলাদেশের রাজনীতির মৌলিক পরিবর্তনটা আসে। বস্তুত বাংলাদেশের জন্মের সময় যে মেরুকরণটা ছিল সেটি খুব স্পষ্ট করে উল্টে যায় বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর। তখন বাংলাদেশের পায়ের পাতাটা ঘুরিয়ে দেয়া হয় পাকিস্তানের দিকে। পাকিস্তানের অনুসরণে কেবল বাংলাদেশ জিন্দাবাদ নয়, রেডিও পাকিস্তানের মতো রেডিও বাংলাদেশ নয়, যুদ্ধাপরাধী বা দালালদের মুক্তি দেয়া থেকে শুরু করে তাদেরকে রাজনৈতিকভাবে পুনর্বাসন করাটা হয়ে দাঁড়ায় স্বাভাবিক ঘটনা। যুদ্ধাপরাধীদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা তুলে দেয়াটা ছিল এই জাতির জন্মের প্রতি চরম হতাশার প্রকাশ। কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ ছাড়াও বাংলাদেশ বিরোধীদের মন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রী বানিয়ে হাত দেয়া হয় সংবিধানে। ’৭২ সালের সংবিধানের মূল চরিত্র ছিন্নভিন্ন করা হয়। একটি বাঙালী জাতীয়তাবাদী, গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক ও সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশকে একটি সাম্প্রদায়িক, পুঁজিবাদী ও স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করার সকল আয়োজন সম্পন্ন করা হয়েছিল। ’৯৬ সালে যদি বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পরিবর্তন না হতো তবে বাংলাদেশ ’৭৫ পরবর্তী পাকিস্তান হিসেবে বেড়ে ওঠার সকল কাজটাই সম্পন্ন হতো। এমনও হতে পারত পাকিস্তান ও বাংলাদেশ কনফেডারেশন হয়ে পড়তে পারত। একাত্তরে খোন্দকার মোশতাক যে প্রক্রিয়াটি সফল করতে পারেননি মরহুম জিয়া ও তার উত্তরসূরিরা সেই কাজটিই সম্পন্ন করার চেষ্টা করেছিল। আমরা যদি এখন ইসলামিক রিপাবলিক অব বাংলাদেশের বাসিন্দা হতাম তবে অবাক হবার কিছু থাকত না। অনেকেই মনে করেন, জিয়া পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থা কর্তৃক মুক্তিযুদ্ধে অনুপ্রবেশকারী। ’৭৫-এর পর জিয়া তাই স্বমূর্তিতে আবির্ভূত হয়। যুদ্ধাপরাধী দালাল পুনর্বাসন এবং কর্নেল তাহেরকে হত্যা করা ছাড়াও একটি প্রতিবিপ্লবের নেতৃত্ব দেয় জিয়া। লক্ষণীয় যে বাংলাদেশের এই পাকিস্তানীরা দেশটাকে পাকিস্তান বানানোর জন্য তাদের আন্তর্জাতিক দোসরদেরও সহায়তা পেয়েছিল। সেই কারণেই আল বদর-আল শামস, যুদ্ধাপরাধী ও বঙ্গবন্ধুর খুনীরা সেসব দেশে আশ্রয় নেবার উন্মুক্ত পথ পেয়েছে।

 

এবারের নির্বাচনের বিশেষত্ব এটাই যে, ১৯৭০ সালে যেমনি নির্বাচনের মৌলিক বিষয়টা পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে হয়েছিল এবারও তেমনটাই মেরুকরণ হয়েছে। একদিকে শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলাদেশ আর অন্যদিকে ড. কামালের পক্ষপুটে পাকিস্তানী-রাজাকার-আলবদর ও আল শামসের বাহিনী। জিয়ার হাত ধরে এই মেরুকরণটাই চলে আসছিল। তবে এবার আরও দুঃখজনক বিষয় ছিল যে, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কাজ করতেন এমন ব্যক্তি ড. কামাল হোসেন বাংলাদেশবিরোধী পাকিস্তানপন্থী এই শিবিরের তথাকথিত নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এতদিন কেবল জামায়াত-শিবির-বিএনপি পাকিস্তানপন্থী বাংলাদেশী রাজনৈতিক শিবিরের জোটে ছিল, এবারের নির্বাচনে সেই সীমানা এতটাই বেড়েছে যেÑ একাত্তরে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনকারী আসম আব্দুর রব, জাসদের এককালীন নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না, বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে খ্যাত কাদের সিদ্দিকী, মরহুম অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়ার ছেলে রেজা কিবরিয়া বা আওয়ামী লীগ নেতা সুলতান মুহম্মদ মনসুরও পাকিস্তানপন্থীদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়েছেন। তারা সবাই নির্বাচন করেছেন জামায়াতের হাতে হাত ধরে ধানের শীষে। এখন গবেষণা চলছে, ঐক্যফ্রন্ট কোন্ উদ্দেশ্য নিয়ে নির্বাচনে এসেছিল।

এবারের নির্বাচনে এটি খুব স্পষ্ট হয়েছে যে, ’৭০ এর নির্বাচনের স্বাধীনতার মার্কা নৌকা যেমন স্বাধীনতার প্রতীক হিসেবে সুস্পষ্ট হয়েছিল এবং মুসলিম লীগের হারিকেন তার বিপরীতে ছিল তেমনি নৌকা সেই স্বাধীনতার মার্কা থেকেই সকল স্বাধীনতাবিরোধীদের মার্কা হয়েছে ধানের শীষ। বাংলাদেশের স্বাধীনতাপরবর্তী ইতিহাসে এমন অদ্ভুত রাজনৈতিক সমীকরণ আর হয়েছে বলে আমি অন্তত স্মরণ করতে পারি না। এটি মোটেই কাকতালীয় নয় যে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই সশরীরে ও অর্থ নিয়ে নৌকাবিরোধীদের বিপক্ষে কাজ করেছে। ২৮ ডিসেম্বর রাতে সময় টিভিতে একাধিকবার প্রচারিত খবরে জানতে পারলাম, একাত্তরে আমাদের বিরোধিতা করেছিল এমন কিছু দেশ তাদের গোয়েন্দা সংস্থাকে দিয়ে নৌকার বিপক্ষে কাজ করে যাচ্ছে। তারা নানা অজুহাত তুলছে। তারা বলছিল, দেশে নাকি গণতন্ত্র, মানবাধিকার, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ইত্যাদি কিছুই নেই। বস্তুত বাংলাদেশের বর্তমান সরকারকে অপবাদের অধিকারী করার জন্য সেই একই কথা বলেছে কামাল-রব-ফখরুল গং। অথচ বাংলাদেশের এমন কোন মিডিয়া নেই যাতে বিরোধী বক্তব্য বা সমালোচনা তো বটেই এমনকি অসত্য-অপপ্রচারও প্রকাশিত হচ্ছে না। সোস্যাল মিডিয়ার কথা বিবেচনা করলে সেই পরিধিটা আরও বিস্তৃত। এখানে কেমন করে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয় বা সুশাসনের অভাব কোথায় রয়েছে সেটি বের করাই তো কঠিন।

 

দেশের কোন মানুষ মিডিয়ার স্বাধীনতায় কোন ধরনের বাধা দেখছে তেমনটি আমি কোনভাবেই শনাক্ত করতে পারছি না। আমি যখন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংসদে পেশ ও পাস করি তখন সাংবাদিকদের একটি অংশ প্রবল সমালোচনা করেছে। অথচ আইনটি পাস হবার সাড়ে তিন মাসেও সেই আইনের আওতায় কোন সাংবাদিক বা সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে নির্বাচনে মিথ্যা খবর প্রকাশের জন্য দায়ের করা একটি মামলা ছাড়া আর কোন মামলা হয়নি। কিন্তু আইনটি নিয়ে আন্তর্জাতিক লবিইংও হয়েছে। ঐক্যফ্রন্ট আইনটি বাতিলের ইশতেহারও প্রকাশ করেছিল।

’১৮ সালের নির্বাচনে প্রতিপাদ্য বিষয় বা কেন্দ্র কিসে ছিল সেটি নিয়ে এখন গবেষণা চলছে। যদি প্রাথমিকভাবে ভোটারের বয়সের বিষয়টি বিবেচনা করা হয় তবে ৩৫ বছর বয়সী ভোটার প্রায় অর্ধেক। বাকি যে অর্ধেক ভোটার তাদের বিবেচনায় বস্তুত বাংলাদেশের স্বাধীনতার পুরো ইতিহাসটিই স্মৃতিতে কাজ করে। এই সময়কালে দেশব্যাপী যে রাজনৈতিক মেরুকরণ হয়েছে তার ফলাফল বস্তুত এমন যে তারা প্রায় সবাই নিজেরা স্থির করে রেখেছে যে কোন্ মার্কায় ভোট দেবে। ’৭০ সালের নির্বাচনে এমন বিষয়টি ছিল যে প্রার্থী কে সেটি বড় কথা নয়, বড় বিষয় ছিল প্রার্থী বঙ্গবন্ধুর এবং তার মার্কা নৌকা। সেই সময়ে মানুষ এজন্যই নৌকায় ভোট দিয়েছে এমনকি প্রার্থীকে না চিনলেও। এবার প্রার্থীরা স্থানীয় পর্যায়ে পরিচিত। তাদের আমলনামাও আছে। কিন্তু সার্বিক পরিস্থিতিটা এবার মার্কায় গিয়ে ঠেকেছে। গ্রামে গ্রামে পথে, প্রান্তরে আলোচ্য বিষয় নৌকা না ধানের শীষ। আমার কোন সন্দেহ নেই যে, নৌকায় যিনি ভোট দিতে অভ্যস্ত তিনি নৌকাতেই দিয়েছেন।

অন্য যে অর্ধেক জনগোষ্ঠীর কথা আলোচনায় এসেছে তারা স্বাধীনতা-উত্তর প্রজন্ম। তাদের স্মৃতিতে যেমনি করে ২০০১ থেকে ’০৫, ২০১৩ সহ অন্যান্য সময়ে বাংলাদেশে জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাস ছড়ানোর স্মৃতিগুলোর কিছুটা হলেও আছে, তেমনি আছে গত দশ বছরে বাংলাদেশের অভাবনীয়, অদম্য সমৃদ্ধির চিত্রও। মাত্র দশ বছর আগের একটি আমাজনের জঙ্গলের আদি বাসস্থানের মতো বাংলাদেশের এমনটা ডিজিটাল রূপান্তর এবং সমৃদ্ধির সকল সূচকে অগ্রগতির ছবিগুলো তারা নিজেদের চোখের সামনেই জন্ম নিতে দেখেছে। মাথাপিছু আয় থেকে পদ্মা সেতু, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট, ৪জি, বিদ্যুতের অসাধারণ প্রবৃদ্ধি বা ফাইবার অপটিক্স কানেকটিভিটি কিংবা শিক্ষা ও পেশার ডিজিটাল রূপান্তর তাদেরকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে। গ্রামের যে বধূটি এখন স্কাইপিতে তার স্বামীকে দেখতে পায় বা নবজাতককে-স্বামীকে দেখাতে পারে বা যে কৃষক ঘরে বসে জমির পরিচয়টা পায় তার ওপর উন্নয়নের ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। দেশে ১৫ কোটি ৯০ লাখ মোবাইল কানেকশন, শতকরা ৪০ ভাগ আর্থিক লেনদেন এবং দিনে ১০২০ কোটি টাকা মোবাইলে পারাপার পুরো দেশের মানুষকে চোখে আঙুল দিয়ে ডিজিটাল বাংলাদেশকে দেখিয়ে দিয়েছে। মাত্র ২৩ মিলিয়ন ডলারের আইটি খাতের রফতানি ১ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হওয়াটা নতুন প্রজন্মকে দারুণভাবে আশাবাদী করেছে। দেশে ডিজিটাল যন্ত্র বানানো ও রফতানি নতুন প্রজন্মকে স্বপ্ন দেখিয়েছে। অন্যদিকে পাকিস্তানের চাইতে বাংলাদেশের সকল সূচকে এগিয়ে থাকা আমাদের নতুন প্রজন্মকে আত্মবিশ্বাসী করেছে। তারা এটি উপলব্ধি করেছে যে পাকিস্তানের মতো সন্ত্রাস জঙ্গীবাদকে লালন করে দেশ সামনে যেতে পারে না-ফলে বাংলাদেশ যে স্বপ্ন নিয়ে জন্ম নিয়েছিল তাকেই বাস্তবায়ন করতে হবে। আমি বিশ্বাস করি যে, এবারের নির্বাচন ’৭০-এর নির্বাচনই হয়েছে এবং জয় বাংলাই জয়ী হয়েছে।

 

সার্বিকভাবে আমি নিজে মনে করি, বাংলাদেশের আজকের নির্বাচনে মানুষ আবারও ’৭০ সালের মতো জয় বাংলার পক্ষে শেখ হাসিনাকে আরও একবার প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছে। তবে এই নির্বাচন ও তার পরবর্তী সময়ের সিদ্ধান্তসমূহ পর্যালোচনা করে এটি অনুভব করতে পারছি যে বিএনপি-জামায়াত ও তাদের দোসর কামাল গং ইতিহাসের অনিবার্য পরিণতি হিসেবে বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে মুছে যাবার পর্যায়ে পৌঁছেছে। এবার যদি অন্তত ৭টি আসন নিয়েও সংসদে তারা যেত তবে পুরো এক পৃষ্ঠা সাদা কাগজে একটি বিন্দু হলেও চোখে পড়ত। তাদের সংসদ বর্জনের সিদ্ধান্তের ফলে আমাদের লাল সবুজের পতাকাটাই দেখা যাবে; এতে আর কোন কালো বিন্দুও থাকল না।

সৌজন্যেঃ জনকণ্ঠ 

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত