রোজ গার্ডেন থেকে বঙ্গবন্ধু এভিনিউ

11266

Published on জুন 22, 2019
  • Details Image

আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ২৩ জুন। ১৯৪৯ সালের এই দিনে পুরান ঢাকার রোজ গার্ডেনে এক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে জন্ম নেয়া দলটির এদিন ৭০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। দীর্ঘ ৭০ বছর পার করে ৭১ বছরে পা দিয়েছে ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী এ রাজনৈতিক দল। যা বর্তমানে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দল। ‘রোজ গার্ডেন থেকে বর্তমান ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের (আওয়ামী লীগের বর্তমান কেন্দ্রীয় কার্যালয়) সুরম্য ভবন’ একটি ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দলের দীর্ঘ উত্থান-পতনের ধারাবাহিতার ইতিহাস। পাকিস্তান আমলে বাঙালির স্বাধিকারের আন্দোলন থেকে বর্তমান আধুনিক বাংলাদেশ, এই প্রতিচ্ছবিতে দেশের অন্যতম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান আওয়ামী লীগ। বাঙালি জাতির স্বাধীনতাসহ অনেক অর্জন এসেছে আওয়ামী লীগের হাত ধরে।

১৯৪৯ সালে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে লিখেছেন- ‘কোথাও হল বা জায়গা না পেয়ে শেষ পর্যন্ত হুমায়ুন সাহেবের রোজ গার্ডেনের বাড়িতে সম্মেলনের কাজ শুরু হয়েছিল।’ আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা (তৎকালীন আওয়ামী মুসলিম লীগ) প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু আরও লিখেছেন- ‘আমি মনে করেছিলাম, পাকিস্তান হয়ে গেছে। সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের দরকার নাই। একটা অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হবে, যার একটা সুষ্ঠু ম্যানিফেস্টো থাকবে।’

আওয়ামী লীগ নামটির আগে জন্মের সময় (১৯৪৯ সালের ২৩ জুন) রোজ গার্ডেনে দলটির নাম দেয়া হয় ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’। শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকসহ তৎকালীন রাজনৈতিক নেতারা সেদিন রোজ গার্ডেনে উপস্থিত ছিলেন। সেসময়ের প্রেক্ষাপটে তা প্রাসঙ্গিক ছিল বলেই মনে করেন রাজনীতি বিশ্লেষকরা।

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর তৎকালীন মুসলিম লীগ জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। সেসময় জনগণের বিভিন্ন দাবি বাস্তবায়নেই আওয়ামী লীগের জন্ম হয়। রাজনীতি বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমেদের ‘আওয়ামী লীগ-উত্থানপর্ব ১৯৪৮-১৯৭০’ বই থেকে জানা যায়, আওয়ামী লীগ নামটি দিয়েছিলেন দলের প্রথম সভাপতি মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। সেসময় রাজনৈতিক বাস্তবতায় ও কর্মীদের দাবির প্রেক্ষিতে মুসলিম শব্দটি থেকে গেলেও দল আত্মপ্রকাশের ছয় বছরের মাথায় ১৯৫৫ সালে দলের নাম থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দেয়া হয়। এর উদ্দেশ্য- দলে ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চ্চা এবং অসাম্প্রদায়িকতা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ। ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে আওয়ামী লীগ। স্বাধীনতার পর ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’ নাম নেয় দলটি।

এই দীর্ঘ সময় (৭০ বছর) পাড়ি দিতে আওয়ামী লীগকে কখনও সহ্য করতে হয়েছে শাসকের রক্তচক্ষু, কখনও দলটির নেতাকর্মীদের উপর এসেছে অসহ্য নির্য়াতন। কিন্তু বাংলাদেশের জন্ম দেয়া দলটি কখনও দমে যায়নি। বাংলাদেশের মানুষের মানসচিন্তাকে ধারণ করেই আওয়ামী লীগ যুগ-যুগান্তরে হয়ে ওঠে জনগণের দল। রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ সবসময় সম্পৃক্ত থেকেছে। দীর্ঘ ৭০ বছরে ৫০ বছরই আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে ছিল। কিন্তু তাতে দলের রাজনৈতিক আদর্শের কোনো ক্ষতি-বৃদ্ধি হয়নি। নেতারাও আদর্শচ্যুত হননি। বরং আরো কঠিনভাবে দলের ঐক্য ধরে রেখেছেন।

রাজনীতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, দল হিসেবে আওয়ামী লীগের সংগ্রাম ও দেশের রাজনৈতিক সংগ্রাম- যুগপদভাবে আওয়ামী লীগকে উভয় সংগ্রামেই শামিল হতে হয়েছে। ফলে, জাতিরাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের জন্ম ও বেড়ে ওঠার ইতিহাস ও রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের জন্মবৃত্তান্ত সমান্তরাল কিন্তু অবিচ্ছেদ্য। গণতন্ত্র ও অসাম্প্রাদায়িকতাই আওয়ামী লীগের মূল উপজীব্য। মওলানা ভাসানী, শামসুল হক ও শেখ মুজিবুর রহমানের পথ ধরেই আজকের আওয়ামী লীগ।

১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠাকালে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী আওয়ামী লীগের সভাপতি, শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক এবং কারাবন্দি শেখ মুজিবুর রহমান যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫২ সালে শেখ মুজিবুর রহমান সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান। পরের বছর ঢাকার ‘মুকুল’ প্রেক্ষাগৃহে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত ১৩ বছর সংগঠনের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন বঙ্গবন্ধু।

প্রতিষ্ঠার পর থেকে রাজনৈতিক সংগ্রাম, যুক্তফ্রন্ট গঠন ও ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে বিজয়সহ বিভিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে ’৫০-এর দশকেই আওয়ামী লীগ হয়ে ওঠে পূর্ব পাকিস্তানের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল তথা প্রধান রাজনৈতিক শক্তি। তবে প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি আব্দুল হামিদ খান ভাসানী রাজনৈতিক মতভিন্নতার জন্য ১৯৫৭ সালে দল ছেড়ে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠন করেন।

প্রতিষ্ঠার পর থেকেই প্রাদেশিক স্বায়ত্ত্বশাসনের ওপর বিশেষ গুরুত্বসহ ৪২ দফা কর্মসূচি গ্রহণ করে আওয়ামী লীগ। শুরুর দিকে দলটির প্রধান দাবিগুলোর মধ্যে ছিল- রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার স্বীকৃতি, এক ব্যক্তির এক ভোট, গণতন্ত্র, সংবিধান প্রণয়ন, সংসদীয় পদ্ধতির সরকার, আঞ্চলিক স্বায়ত্ত্বশাসন এবং তৎকালীন পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের মধ্যে বৈষম্য দূরীকরণ।

১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর কৃষক শ্রমিক পার্টি, পাকিস্তান গণতন্ত্রী দল ও পাকিস্তান খেলাফত পার্টির সঙ্গে মিলে যুক্তফ্রন্ট গঠন করে আওয়ামী মুসলীম লীগ। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য অন্যান্য দলকে সঙ্গে নিয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠন করতে আওয়ামী মুসলিম লীগ মুখ্য ভূমিকা পালন করে। ওই বছরের মার্চের ৮ থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান পরিষদের নির্বাচনে ২৩৭টি আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট ২২৩টি আসন পায়। এর মধ্যে, ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ পেয়েছিল ১৪৩টি আসন। ২৪ বছরের পাকিস্তান শাসনামলে আওয়ামী মুসলিম লীগ আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে দু’বছর প্রদেশে ক্ষমতাসীন ছিল এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে কেন্দ্রে ১৩ মাস কোয়ালিশন সরকারের অংশীদার ছিল।

পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ে মতপার্থক্যের কারণে ১৯৫৭ সালে দলে ভাঙন দেখা দেয়। ওই বছরের ৭ ও ৮ ফেব্রুয়ারি কাগমারি সম্মেলনে দলে বিভক্তির ঘটনা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এ অবস্থায় মাওলানা ভাসানী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন।

১৯৬৬ সালেই (৬ষ্ঠ কাউন্সিলে) বঙ্গবন্ধু দলের সভাপতির দায়িত্ব কাঁধে নেন। সাধারণ সম্পাদক হন তাজউদ্দীন আহমদ। সপ্তম ও অষ্টম কাউন্সিলে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক অপরিবর্তিত থাকে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বেই দেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয় যার নেতৃত্ব দেন তাজউদ্দীন আহমদ। এভাবে এক দীর্ঘ রাজনৈতিক পথপরিক্রমায় বাংলাদেশ, আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধু- অবিচ্ছিন্নভাবে লীন হয়ে যায় একে অপরের মাঝে।

১৯৭১ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব দেয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে। পাকিস্তানে কারাবন্দি বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর বিশ্ব মানচিত্রে অভ্যূদয় ঘটে বাংলাদেশের। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা এবং ৩ নভেম্বর কারাগারের অভ্যন্তরে চার জাতীয় নেতাকে হত্যার পর সামরিক শাসনের নির্যাতন আর নিপীড়নের মধ্যে পড়ে ঐতিহ্যবাহী এই সংগঠনটি। নেতাদের মধ্যেও দেখা দেয় বিভেদ। দলের কঠিন দুঃসময়ে দলের ঐক্য ধরে রেখেছেন দুঃসময়ের সৈনিকরা। মহিউদ্দিন আহমেদ, সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন, আবদুল মালেক উকিল ও আবদুর রাজ্জাক আওয়ামী লীগের ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ সময়ের দুঃসাহসী কাণ্ডারী। কঠিন হাতে তারা দলের হাল ধরে রেখেছেন। ১৯৮১ সালের ১৭ মে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দলীয় সভাপতি হিসেবে দেশে ফিরে কয়েকভাগে বিভক্ত আওয়ামী লীগকে ঐক্যবদ্ধ করেন, আন্দোলন শুরু করেন সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের বিরুদ্ধে।

দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। ৫ বছর শাসনের পর ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পরাজিত হয়। কিন্তু, দলটির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়, কারচুপির মাধ্যমে তাদের হারানো হয়েছে। পরবর্তীতে দেশে রাজনৈতিক সংকটের পর ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে পুনরায় সরকার গঠন করে। আর ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়ে ক্ষমতায় যায়। সর্বশেষ ২০১৮ সালে দেশের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পুনরায় নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতাসীন হয় আওয়ামী লীগ।

রোজ গার্ডেন ও ৯১ নবাবপুর রোড :

দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার নেতৃত্বে টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগ এবার জমকালোভাবে দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন করতে যাচ্ছে। এবার দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে নতুনের সঙ্গে থাকছে দলের ঐতিহ্য স্মরণ। এরই ধারাবাহিকতায় এবারের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পুরান ঢাকার রোজ গার্ডেনে দলীয় নেতাকর্মীদের পদচারণায় উৎসবের আমেজ তৈরি হবে।

ঢাকার মধ্যে যে কয়টি প্রাচীন স্থাপনা আছে এর মধ্যে একটি রোজ গার্ডেন। রোজ গার্ডেনের অবস্থান টিকাটুলির কে এম দাস রোডে। ১৯৭০ সালে চলচ্চিত্র নির্মাণ প্রতিষ্ঠান ‘বেঙ্গল স্টুডিও’-কে এটি লিজ দেয়া হয়। এসময়ে চলচ্চিত্রের শুটিং স্পট হিসেবে এই ভবনটি ব্যবহৃত হতো। এখানে চিত্রায়িত কাহিনীচিত্র ‘হারানো দিন’-এ রোজ গার্ডেনের সেই সময়কার চিত্র সংরক্ষিত আছে। প্রায় ২২ বিঘা জমির ওপর নির্মিত দোতলা এই প্রাসাদের চারদিক ঘিরে ছিল দেশি-বিদেশি গোলাপের চারা। এই গোলাপ বাগানের জন্যই বাগানবাড়িটি সেসময় বিখ্যাত হয়ে ওঠে ‘গোলাপ বাগ’ নামে, যা আমাদের কাছে এখন ‘রোজ গার্ডেন’ নামে পরিচিত। বর্তমানে চারপাশ ঘেরা সেই গোলাপ বাগান না থাকলেও প্রাসাদের সামনে কৃত্রিম ফোয়ারা ও ভাস্কর্যগুলো রয়েছে।

আওয়ামী লীগের পুরনো দলীয় কার্য়ালয় ছিল- ৯১, নবাবপুর রোডে। দলের ৭০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে আলোকসজ্জায় সাজানো হবে সেই কার্যালয়টিও। এই কার্যালয়েই ১৯৬৪ সালের ২৫ জানুয়ারি আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করা হয়। এখানেই বসতেন দলের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এর কিছুদিন পর অস্থায়ীভাবে সদরঘাটের রূপমহল সিনেমা হলের গলিতে কিছু দিন বসে অফিস করেছেন নেতারা। পরে পুরানা পল্টনে দুটি স্থানে দীর্ঘদিন দলের অফিস ছিল। ১৯৮১ সালের দিকে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দলের দায়িত্ব নেয়ার পর ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের নতুন ঠিকানা হয়।

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত