২৩ জুন, ১৯৭১- শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের নেতা

4583

Published on জুন 23, 2019
  • Details Image

১৯৭১ সালের ২৩ জুন দিনটি ছিল বুধবার। দীর্ঘ চব্বিশ বছরের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, অত্যাচারী পাকিস্তান সরকারের অতীত ও বর্তমান রাজনীতির প্রধান হাতিয়ার সাম্প্রদায়িকতা। আজ বাংলাদেশের মুক্তির প্রচেষ্টায় যে ঐক্যবদ্ধ শক্তির বিকাশ ঘটেছে তা বানচাল করার উদ্দেশ্যে প্রতিক্রিয়াশীল সরকার বাঙালীদের মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টির জন্য হন্যে হয়ে উঠেছে। তারা অবাঙালীদের হাতে প্রচুর অস্ত্র দিয়ে গ্রামে গ্রামে পাঠিয়ে দিচ্ছে, সেখানে তারা নতুন করে অত্যাচার শুরু করেছে, রাস্তায় রাস্তায় এসব অবাঙালীরা টহল দিচ্ছে।

বাঙালীরা কোন প্রকার উস্কানিতে কান না দিয়ে পশ্চিমা কুচক্রীদের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দিনের পর দিন মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য নিজেদের তৈরি করছে। সংগ্রাম যত কঠিন ও দীর্ঘ হোক না কেন তা চালিয়ে যাওয়ার জন্য তৈরি সমগ্র বাঙালী জাতি। এইদিন বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচএম কামরুজ্জামান এক বিবৃতিতে বাংলাদেশ প্রশ্নে একটি রাজনৈতিক সমঝোতা না হওয়া পর্যন্ত পাকিস্তানকে সাহায্যদানকারী কনসোর্টিয়াম কর্তৃক পরবর্তী সাহায্য ও ঋণ স্থগিত রাখার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানান। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের জনগণ আশা করে দখলদার সেনাবাহিনীকে প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত কনসোর্টিয়াম পাকিস্তানকে সাহায্য প্রদান বন্ধ রাখবেন। চট্টগ্রামে হেয়াকোর কাছে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি এ্যামবুশ দল পাকবাহিনীর খাদ্যবাহী একটি ছোট কনভয়কে এ্যামবুশ করে। এ আক্রমণে পাকবাহিনীর একজন সামরিক অফিসার ও তিনজন সৈন্য নিহত এবং দুজন আহত হয়।

কুমিল্লার পাকসেনাদের চতুর্দিক থেকে এ্যামবুশ করার জন্য চতুর্থ বেঙ্গলের ‘ডি’ কোম্পানির তিনটি প্লাটুন ইয়াকুবপুর, কুয়াপাইনা এবং খৈনলে অবস্থান নেয়। পাকবাহিনীর একটি টহলদার দল মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের কাছাকাছি এলে মুক্তিযোদ্ধারা সাঁড়াশি আক্রমণ চালায়। এ আক্রমণে ৮ জন পাকসেনা নিহত ও ৩ জন আহত হয়। কুমিল্লায় আপানিয়াপুল এলাকায় কয়েকজন দালালসহ দুজন পাকসেনার ওপর মুক্তিযোদ্ধা নায়েক সুবেদার শামসুল হক ও হাবিলদার মন্তাজ আক্রমণ চালায়। এতে পাকসেনা দুজন নিহত হয় ও দালালরা পালিয়ে যায়। মাদারীপুরের নড়িয়া থানা এলাকায় থানার দক্ষিণ পূর্ব এবং পশ্চিম দিকে মুক্তিযোদ্বারা অবস্থান নেয়। আক্রমণ করার পূর্বে শত্রু বাহিনীকে আত্মসমর্পণের জন্য বলা হয়। কিন্তু তারা আত্মসমর্পণ না করে পাল্টা গুলি ছোড়ে। শুরু হয় তুমুল যুদ্ধ।

এই যুদ্ধে পাক দোসর, রাজাকারসহ ৭-৮ জন নিহত হয়। এখানে ৭টি রাইফেলসহ ৩৫০ রাউন্ড গুলি মুক্তিযোদ্বারা দখল করে নেয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক এ আর মল্লিক কলকাতায় স্থানীয় বুদ্ধিজীবীদের এক সমাবেশে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নৈতিক সমর্থন দানের জন্য ভারতীয় জনগণ ও বুদ্ধিজীবীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, ‘বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে এই সাহায্য সহযোগিতা চির ভাস্বর হয়ে থাকবে।’

ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এক অনুষ্ঠানে বলেন, শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের নেতা। বাংলাদেশ প্রশ্নে রাজনৈতিক মীমাংসার জন্য অন্য কোন পক্ষের সঙ্গে নয়, তাঁর সঙ্গেই আলোচনা করা উচিত। শ্রীমতি গান্ধী এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আলোচনা করার জন্য পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের প্রতি আহ্বান জানান। যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথ বিষয়কমন্ত্রী এ্যালেক ডগলাস হিউম কমন্স সভায় বলেন, পাকিস্তানে পুরো প্রকল্পগুলোর জন্য ব্রিটিশ অনুদান অব্যাহত থাকবে তবে সেখানে কোন রাজনৈতিক সমাধান না হওয়া পর্যন্ত নতুন করে সাহায্য দান বন্ধ থাকবে। পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো কোয়েটায় এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য পিপলস পার্টি, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছে কতিপয় সুপারিশ সংবলিত একটি প্রস্তাব পেশ করেছে। পাকিস্তান ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সহ-সভাপতি মাহমুদ আলী পাকিস্তান সরকারের বিশেষ দূত হিসেবে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ পরিস্থিতি সম্পর্কে বিশ্বকে অবহিত করার উদ্দেশ্যে মাসব্যাপী বিদেশ সফর শুরু করেন।

এইদিন ‘দৈনিক যুগান্তর’ মুক্তিফৌজের ভয়ে পাকসৈন্য সদা-সন্ত্রস্ত শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের বিভিন্ন খন্ডে মুক্তিফৗজের গেরিলা বাহিনীর ক্রমবর্ধমান তৎপরতায় পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যবাহিনীর টহলদার দলগুলো আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। মুক্তিফৗজ কমান্ডের জনৈক উচ্চপদস্থ অফিসার বলেছেন- মুক্তিফৗজ যে কোন মুহূর্তে আচমকা আক্রমণ চালাতে পারে মনে করে পাকিস্তানী সৈন্যরা আজকাল যতদূর সম্ভব সতর্ক হয়ে চলাফেরা করছে। মুক্তিফৗজ যাতে চিনতে না পারে সেজন্য পাকসৈন্যরা সময় সময় অসামরিক ব্যক্তির ছদ্মবেশে চলাফেরা করে থাকে। সৈন্যবাহিনী যখন সৈন্য ও সরবরাহ নিয়ে নদী পারাপারের জন্য বোট ব্যবহার করে তখন গেরিলাদের আক্রমণ রক্ষা পাওয়ার জন্য সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে নদী ও খালের উভয় তীরের রক্ষী মোতায়েনের ব্যবস্থা করে।

কুষ্টিয়া জেলার ভেড়ামারা থানার মহিষকুন্ডি অঞ্চলে এক কোম্পানি পাকসৈন্যের ওপর আক্রমণ চালিয়ে মুক্তিফৗজ অন্তত ২০ জন সৈন্যকে হত্যা ও বেশকিছুকে জখম করেছে। স্থানটি কৃষ্ণনগর থেকে ১৫০ কিলোমিটার দূরে ভারত মেঘনা সীমান্তের বিপরীত দিকে। মুক্তিফৌজ গত রবিবার মেহেরপুরের কাছে একটি সৈন্যবাহী ট্রাকের ওপর গুলিবর্ষণ করে ফলে প্রায় ২৪ জন পাকসৈন্য নিহত অথবা আহত হয়। ওই দিনই মেহেরপুরের প্রায় ১৫ মাইল উত্তর-পূর্বে একটি অঞ্চলে মুক্তিফৌজ একটি সৈন্যঘাঁটির ওপর গুলিবর্ষণ করে। এই আক্রমণে ১১ জন পাকসৈন্য নিহত হয়। রংপুরে লালমনিরহাট খ-ে মুক্তিফৌজ একটি সৈন্য শিবিরের ওপর আচমকা আক্রমণ চালিয়ে কিছু অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদসহ একটি ট্রাক দখল করে। এই আক্রমণে যেসব পাকসৈন্য আহত হয় তাদের মধ্যে একজন অফিসারও আছেন।

দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিংয়ের উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেন, তিনি গতকাল সন্ধ্যায় এখানে বলেন, গত এক পক্ষকাল হতে যে কয়েকটি দেশ তিনি সফর করেছেন সেই কয়েকটি দেশের সরকার পাকিস্তানকে সাহায্যদান বন্ধ করার কথা বিবেচনা করছেন। দুটি কারণে কয়েকটি রাষ্ট্র পাকিস্তানকে সাহায্যদান বন্ধের কথা বিবেচনা করছে। পাকিস্তান নিজের দোষে অর্থনৈতিক সঙ্কট তৈরি করেছে এই অবস্থায় সাহায্যদান সেখানে অকার্যকর হয়ে পড়েছে। দ্বিতীয়ত এই রাষ্ট্রগুলো মনে করে যে- বর্তমানে সাহায্য প্রদান করলে সংখ্যালঘু প্রশাসন সেই সাহায্য সংখ্যাগুরুকে দমনের কাজে লাগাবে। বর্তমান পরিস্থিতির উপর জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। উদ্বাস্তুদের বাংলাদেশে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে ইয়াহিয়া খান ২২ মে যে বিবৃতি দিয়েছিলেন, এরপরও ২০ লাখ উদ্বাস্তু ভারতে এসেছে।

এ থেকে বোঝা যায়, যে পরিস্থিতিতে উদ্বাস্তুরা বাড়িঘর ছেড়ে ভারতে এসেছে, সেই পরিস্থিতি এখনও বর্তমান। সেখানে এখনও আস্থার সঙ্কট রয়েছে। সুতরাং বর্তমান অবস্থায় যাদের হাতে বাংলাদেশের আইন ও শৃঙ্খলার ভার রয়েছে তাঁরা যদি জনগণের বিশ্বাস ও আস্থা অর্জন করতে পারেন তাহলেই উদ্বাস্তুদের আবার স্বদেশে পাঠিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তিনি বলেন, শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর আওয়ামী লীগ শুধু পূর্ববঙ্গেই নয়, সমগ্র পাকিস্তানেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। সুতরাং তাদের সঙ্গেই একটা রাজনৈতিক মীমাংসায় আসতে হবে, যাতে জনগণের প্রতিনিধিরা সরকার গঠন করতে পারেন। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষকে বাংলাদেশের অধিবাসীদের সঙ্গে একটা মীমাংসায় পৌঁছতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে বহির্বিশ্বের কর্তব্য হচ্ছে পাকিস্তানের ওপর সম্ভাব্য সর্বপ্রকার চাপ সৃষ্টি করা। পাকিস্তান সরকারকে সুস্পষ্টভাবে বলা যে বাংলাদেশে অত্যাচার চালানোর অর্থই জনগণের অধিকারের ওপর অত্যাচার এবং এই অত্যাচার বন্ধ করতে হবে। 

সৌজন্যেঃ দৈনিক জনকন্ঠ

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত