গ্রেনেড হামলা :দেশের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র

4181

Published on আগস্ট 22, 2019
  • Details Image

ড. এম এ মান্নানঃ

ঘটনাটি একেবারেই অকল্পনীয়। রাজনীতিতে যে বিশাল ঘুণপোকা ধরেছিল তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল এ ঘটনায়। রাষ্ট্রযন্ত্র কীভাবে প্রতিপক্ষ রাজনীতিবিদদের উপর দমন-নিপীড়ন চালাতে পারে তার নজিরবিহীন প্রমাণ সেদিন সৃষ্টি করেছিল তৎকালীন সরকার যার নেতৃত্বে ছিল আক্ষরিক অর্থেই স্বাধীনতাবিরোধীরা। এমন প্রতিহিংসাপরায়ণ আর মানবতাবিরোধী ঘটনা কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ ঘটাতে পারে তা একেবারেই অকল্পনীয়। কিন্তু অকল্পনীয় ঘটনাই ঘটে গেল ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগের কার্যালয়ের সামনের রাস্তায় আওয়ামী লীগ আহূত সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে, যার সামনের সারিতে ছিলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা যিনি তখন আওয়ামী লীগের দলীয় প্রধান এবং বিরোধীদলীয় নেত্রী। বিশ্বে নজিরবিহীন এ ঘটনাটি দৃশ্যতই ঘটানো হয়েছিল শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে চিরতরে সরিয়ে দিয়ে আওয়ামী লীগ তথা বিরোধী দলকে নেতৃত্ব শূন্য করে দেওয়ার লক্ষ্যে, যেমনটা তারা চেয়েছিল পঁচাত্তরে। সে বছরের ১৫ আগস্ট তারাই শেষ করে দিয়েছে জাতির জনককে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার রূপকারকে, এ দেশের ভবিষ্যত্ বিনির্মাণের উদ্যোগকারীকে। বিশ্বের কেউ ভাবতে পেরেছে বলে মনে হয় না এমন বর্বরোচিত আর নারকীয় ঘটনা কোনো রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থেকে ঘটাতে পারে। কিন্তু ক্ষমতাসীন দুর্বৃত্তরা এদেশে সেরূপটা ঘটিয়েছে; তাও ঘটিয়েছে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে এবং তাদের পেছনের ইন্ধনদাতা আর সরাসরি সাহায্যকারী পাকিস্তান থেকে সমরাস্ত্র আর্জেস গ্রেনেড এনে, যা যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। এরূপ বিধ্বংসী আর্জেস গ্রেনেড নামক বোমা-অস্ত্র ব্যবহার করে নির্বিচারে মেরে ফেলা হলো চব্বিশ জনকে আর আহত করা হলো পাঁচ শতাধিক মানুষকে। শরীরে স্প্লিন্টারের ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছে এখনও ১৫ বছর পরেও বহু আহত হওয়া নাগরিক যারা দেশকে ভালোবেসে গিয়েছিল স্বাধীনতার স্বপক্ষ শক্তির দলের কর্মপরিকল্পনার কথা শুনতে সেদিনের জনসভায়। তখনকার বিরোধীদলীয় নেত্রীকে হত্যাসহ তারা চেয়েছিল দেশে একটা অরাজক ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করতে যাতে মানুষ তখনকার দেশবিরোধী শক্তির তৈরি সরকারের বিরুদ্ধে কোনো টু শব্দটিও না করে। গণতন্ত্র তো অনেক আগেই তাদের পূর্বসুরি সামরিক সরকার হত্যা করে শুধু কঙ্কালটা রেখে গিয়েছিল।

তবে বিগত বছরের ১০ অক্টোবর সন্ধ্যায় বোমা হামলা সংক্রান্ত মামলার রায়ের বিষয়টি শোনার পর স্বস্তি পেলাম এই ভেবে যে, যাকে মূল টার্গেট বানানো হয়েছিল সেই বঙ্গবন্ধুর যোগ্য কন্যার হাতেই হামলাকারী আর ষড়যন্ত্রকারীদের বিচার হয়েছে, সকল আইন মেনে, দেশের প্রচলিত আইনের আওতায়।

অনেক দেরিতে হলেও বিচার হয়েছে এ মর্মান্তিক, পৈশাচিক ঘটনার। প্রমাণ হয়েছে, বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে সব সময় কাঁদে না। বিচার হয় এবং হবে এমন ধরনের হামলার, নৃশংসতার। তবে সে সময়কার সরকার কোনোভাবেই চায়নি বিচার হোক। কারণ তারাই তো ছিল নাটেরগুরু, তারাই তো ঘটিয়েছে পুরো ঘটনা, স্বেচ্ছায়, অবলীলায়। বরং মামলা না নিয়ে এবং জজ মিয়া নাটক সাজিয়ে সরকার পক্ষ ঘটনাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছে; এক সদস্যবিশিষ্ট কমিশন তৈরি করে জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় আসতে না পারলে তারা সফল হতো নিঃসন্দেহে। দুর্ভাগ্য তাদের। তাদের ইচ্ছা মাটিতে ডেবে গেল। ১৪ বছর পরে বিচার হয়েছে সেই শেখ হাসিনার আমলেই, যাকে তারা নির্মূল করতে চেয়েছিল। একেই বলে ম্যান প্রপোজেস, গড ডিসপোজেস। ষড়যন্ত্রকারীদের গডফাদার ও বোমা হামলার নির্দেশকারী তত্কালীন প্রধানমন্ত্রীর জ্যেষ্ঠ সন্তান দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানসহ ১৯ জনের যাবজ্জীবন আর ১৯ জনের ফাঁসির রায় দেশবাসীকে আশ্বস্ত করেছে।

হামলাকারীরা চেয়েছিল তারা সম্পূর্ণ নির্মূল করে দেবে বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে। আছেই তো মাত্র দুই জন। এ দুই জনকে শেষ করতে পারলেই তো তাদের পোয়াবার। ১৯৭৫ সালের একই মাসের সাত দিন আগেই তো শেষ করে দিয়েছে তাদেরই দোসররা জাতির জনককে। আসলে আগস্ট মাসটিই যেন দেশ বিরোধীদের আঁচলে বাঁধা একটি মাস। এ মাসকেই কেন তারা সব সময় বেছে নেয়? এজন্যই কি যে, এ মাসের চৌদ্দ আগস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস, ব্রিটিশদের সৃষ্ট একটি আজগুবি রাষ্ট্রের জন্মদিবস। পরবর্তীকালেও তারা এ মাসটিকে বেছে নিয়েছিল সারা দেশের সব জেলায় বোমা হামলার জন্য। সিরিজ বোমা হামলা। ধ্বংস করে দিতে চেয়েছিল সারা দেশের মেরুদণ্ড। জঘন্য মনোবৃত্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সারা দেশের মানুষের ওপর। কারো জানের মায়া নেই তাদের মধ্যে। আসলে তারা জনসাধারণের তোয়াক্কা করে না, কদর করে শুধু তাদের হীনস্বার্থকে। দেশকে তাদের কবজায় নিয়ে আসা, ক্ষমতা কুক্ষিগত করে দেশকে পাকিস্তানি ভাবধারায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টাকেই তারা গুরুত্ব দেয় সব সময়, জনমানুষের স্বার্থ নয়। তারা এখনো ভুলতে পারেনি তাদের একাত্তরের পরাজয়ের গ্লানি। এরা কিন্তু কখনোই চুপ করে থাকবে না। সুযোগ পেলেই তারা ফণা তুলবে। এদের ব্যাপারে সাবধানতা সব সময়ের জন্য। নতুবা সর্বনাশ হয়ে যাবে দেশের। বিপন্ন হবে জনমানুষের ভবিষ্যত্। সময় এসেছে এসব বর্বর ঘটনা থেকে শিক্ষা নেওয়ার।

বিচার শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত আমরা অনেকেই সবকিছু বিস্তারিত জানতাম না। বিচারের রায়ের বিবরণ থেকে জানতে পারি, ভালো মানুষের উর্দি গায়ে দেওয়া ক্ষমতাসীন ব্যক্তিদের জঘন্য আর নোংরা মনের পরিচয়। পত্রিকা থেকেই জানতে পারলাম, ষড়যন্ত্রকারী আর হামলাকারীদের মধ্যে ছিল তত্কালীন বিএনপি-জামায়াত সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী, হুজির আমির ও প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা এবং দেশ-বিদেশ থেকে জঙ্গিপনায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অনেক জঙ্গি। এরা সবাই পঁচাত্তরে জাতির জনককে হত্যার পর থেকে তাদের ষড়যন্ত্র আরো প্রসারিত করার লক্ষ্যে চক্রান্তের জাল বুনতেই থাকে। শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর তারা অনেক বেশি তত্পর হয়ে উঠে। আওয়ামী লীগকে সুসংগঠিত করার পর যখন তিনি সামনের দিকে দৃঢ়চিত্তে এগিয়ে যাচ্ছিলেন, তখনই তারা দিশেহারা হয়ে শুরু করে গভীর ষড়যন্ত্র।

বিচার হয়েছে। তাই বলে ষড়যন্ত্র থেমে যায়নি। বোমা হামলার কুশীলবরা ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখেছে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য। এরাই দেশে জঙ্গিপনাকে উসকে দিচ্ছে, নিজেরাও জঙ্গিদের সঙ্গে মিলেমিশে অরাজকতার জন্য ঘোঁট পাকাচ্ছে। তারই নজির আমরা পেয়েছি রায় দেওয়ার পরপরই। মাস্টারমাইন্ডের বাপের বাড়ির এলাকায় বগুড়াতে ষড়যন্ত্রকারীদের দোসররা নীলফামারী থেকে ঢাকাগামী বাসে পেট্রোলবোমা হামলা করে তিন জনকে আহত করে এবং অন্যান্য নাশকতার চেষ্টা চালায়। নারায়ণগঞ্জের তিনটি এলাকায়ও বোমা ছুঁড়ে ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরির চেষ্টা করে। পরের বছরই অর্থাত্ ২০০৫ সালের ১৭ আগস্টে দেশের ৪৫০টি স্পটে চালানো হয় বোমা হামলা। এ হামলার ঘটনায় জড়িত ৫০ জন জঙ্গিকে এখনও ধরা হয়নি এবং বিচার কার্যক্রম ১৪ বছরেও শেষ হয়নি। ৩৩টি মামলা এখনও বিচারাধীন। এসব দুর্বৃত্তরা বিগত কয়েক মাসের মধ্যে রাজধানীতে ট্রাফিক পুলিশসহ অন্যান্য পুলিশের ওপর বোমা হামলা করেছে।

আমরা চাই, এ দেশে এমনতরো নৃশংস বর্বরোচিত রাজনৈতিক হামলা চিরতরে নিপাত হোক; সুষ্ঠু রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরির মাধ্যমে তরুণদের মধ্যে রাজনীতির প্রতি শ্রদ্ধাভাব তৈরি হোক; আজকের এবং আগামীর প্রজন্ম রাজনীতির প্রতি উৎসাহী হয়ে উঠুক। আমরা মনেপ্রাণে কামনা করি, রাজনীতি করা মানুষদের প্রতি অশ্রদ্ধার ভাব দূর হোক; জনগণের মন থেকে রাজনীতি-আতঙ্ক সরে যাক। আমরা আরো চাই, দুর্বৃত্ত শ্রেণির লোকেরা রাজনীতিতে না আসুক, রাজনীতির নদীটার স্বচ্ছ পানিকে ঘোলা করে আপন স্বার্থসিদ্ধির জন্য জঙ্গিদের আশ্রয়-প্রশ্রয় আর অর্থের যোগান দিয়ে রাজনৈতিক পরিবেশ নষ্ট করার মতো পরিবেশ তৈরি না করুক; আর্জেস গ্রেনেডের মতো সমরাস্ত্র সরবরাহ করে রাজনৈতিক নেতাকর্মী আর জনগণকে হত্যার ধারা চালু রাখার সংস্কৃতি চিরতরে বিদূরিত হোক এবং ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা জনগণের কাছে আকর্ষণীয় ভাবমূর্তি নিয়ে হাজির হোক। আমরা সর্বান্তকরণে কামনা করি, জনগণ নিশ্চিন্ত মনে রাজনৈতিক সমাবেশে, সভায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করুক এবং রাজনৈতিক দলগুলোর আদর্শ, উদ্দেশ, কর্মসূচি ইত্যাদি বিষয়ে জ্ঞানলাভ করুক। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আমরা যে স্বাধীন বাংলাদেশ পেয়েছি, সে দেশের মাটি থেকে চিরতরে লুপ্ত হোক সকল প্রকার হানাহানি, অপরাজনীতি, জঙ্গিপনা আর সাধারণ মানুষ হত্যার ঘৃণ্য খেলা। আলো ছড়িয়ে পড়ুক বাংলার আকাশে, মেধাবী তরুণরা এগিয়ে আসুক রাজনীতিতে এবং তৈরি করুক উজ্জ্বল আলোদীপ্ত রাজনীতির পুষ্পধাম। প্রত্যাশা করি, ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করুক, চাকরিজীবীরা নিজ নিজ কর্মস্থলে দায়িত্ব পালন করুক, কৃষকরা মাঠে থাকুক, শ্রমিকরা কলকারখানায় নির্বিঘ্নে তাদের কর্মকাণ্ড নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটাক, মাঝি তার নৌকায় পাল তুলে দিয়ে মনের আনন্দে ভাটিয়ালী সুরের ঝলক তুলুক, আলেম-মাশায়েখরা মানুষের অন্তরে মহান সৃষ্টিকর্তার নুরানী আলোর দীপ্তি ছড়িয়ে দিক আর রাজনীতির ময়দানে থাকা ব্যক্তিরাই শুধু রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত থাকুক, ঠিক যেমনটি হয় উন্নত দেশগুলোতে। এ দেশের জনগণ উন্নয়ন চায়; চায় দেশ এগিয়ে যাক চলমান প্রগতির পথ ধরে আর প্রতিষ্ঠিত হোক সুশাসনের সঙ্গে সঙ্গে বৈষম্যহীন অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ।

লেখক :কলামিস্ট, উপাচার্য, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

সৌজন্যেঃ দৈনিক ইত্তেফাক

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত