ঝড়ের খেয়ায় অর্ধেক জীবন

3225

Published on সেপ্টেম্বর 12, 2019
  • Details Image

নূহ-উল-আলম লেনিনঃ

“আমি মারের সাগর পাড়ি দেব
ভয়হারা এক নেয়ে…।”
- রবীন্দ্রনাথ

শেখ হাসিনা যখন আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্বভার নেন তখন তার বয়স ছিল মাত্র ৩৪ বছর। এই গত ৩৬ বছর ধরে নিরবচ্ছিন্নভাবে তিনি এই দায়িত্বভার বহন করে চলেছেন। এখন তার বয়স ৭২ পূর্ণ হতে চলেছে। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ৩টি মেয়াদ পূর্ণ করে চতুর্থ মেয়াদের প্রথম বছর চলছে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী সাপ্তাহিক News Week-এর মতে, বিশ্বের ১০ জন ক্ষমতাধর ব্যক্তির অন্যতম শেখ হাসিনা। দৃশ্যত বাংলাদেশে তিনি ‘একমেবাদ্বিতীয়ম’। সামরিক শাসকদের মতো হঠাৎ করে তিনি এই জায়গায় পৌঁছন নি। এ জন্য একটা দীর্ঘ ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ পথ তাকে পাড়ি দিতে হয়েছে। অন্য যে ৯ জন ক্ষমতাধরের কথা News Week বলেছে, তাদের মতোও নন শেখ হাসিনা। তার মতো রক্তরঞ্জিত পিচ্ছিল পথ তাদের পেরুতে হয়নি। হাতের মুঠোয় জীবন নিয়ে, জীবন বাজি রেখে তাকে চলতে হয়েছে। অন্তত ১৯ বার আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুকে পরাভূত করেছেন তিনি। তিনি শেখ হাসিনা। একাধারে মহাকাব্যের এবং ট্র্যাজেডির নায়িকা।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট একমাত্র বোন রেহানা ছাড়া আর সবাইকে হারালেন তিনি। তাঁর পিতা, বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মমতাময়ী মা বাঙালির জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের নেপথ্যের প্রেরণাদাত্রী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, ভাই শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেল, ভ্রাতৃবধূদ্বয় সুলতানা ও রোজী, চাচা শেখ নাসের-সহ নিকটজনকে, সেই আলো-আঁধারির প্রত্যুষে নিষ্ঠুর ঘাতকদের হাতে প্রাণ দিতে হয়। বিদেশে থাকায় অলৌকিকভাবে বেঁচে যান তারা দুই বোন। তারা দেশে থাকলে তালিকাটা দীর্ঘ হতো। ঘটনাটি বিধ্বংসী ভূমিকম্পের মতো। ভূমিকম্পের কোনো পূর্বাভাষ থাকে না। বাঙালি জাতির জীবনের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি, বিয়োগান্তক ঘটনাটি সেই প্রত্যুষে ঘটে গেল; যা শেখ হাসিনা বা আমাদের কারও কল্পনায়ও ছিল না।

পঁচাত্তরের সেই প্রত্যুষেই কালো গিলাপে ঢেকে গেল বাংলাদেশ। সূর্যোদয়ের সময়েই সূর্যগ্রাস, সূর্যাস্তের অন্ধকার নেমে এলো বাঙালির জীবনে; শেখ হাসিনা, রেহানার জীবনে।

কত বয়স ছিল তখন শেখ হাসিনার? মাত্র ২৮ বছর! তিনি কি ভেবেছেন তিনি হবেন আওয়ামী লীগের সভাপতি? বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী? আমরা কি ভেবেছি? না, তিনি বা আমরা কেউই ভাবিনি।

কেউ কি ভেবেছেন, এত বড় বিয়োগান্তক ঘটনার পর আওয়ামী লীগ আবার উঠে দাঁড়াবে? বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়াবে? গ্রিক ট্র্যাজেডির মতোই বঙ্গবন্ধুকে ইতিহাসের মহানায়ককে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে হয়েছে। ট্র্যাজেডিতে তো তা-ই হয়। অথচ ঘটনাক্রমে বেঁচে যাওয়া, এই মহাকাব্যের, ট্র্যাজেডির নায়িকা হতে হলো বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনাকে।

বিষয়টা আনন্দের না। বিষয়টা উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া না। বিষয়টা নিয়মতান্ত্রিক বা রাজতান্ত্রিক ক্ষমতা হস্তান্তরের মতো না। বিষয়টি ঝড়ের খেয়ার মতো। রবীন্দ্রনাথের গানে যেমন আছে, “ওরে ভীরু, তোমার হাতে নাই ভুবনের ভার, হালের কাছে মাঝি আছে করবে তরী পার” তেমন নয়। হালের মাঝি নেই। ‘ভীরু’ যাত্রীদের মধ্যে দায়িত্ব নেওয়ার মতো কেউ নেই, যে শক্ত হাতে হাল ধরে ঝড়ের খেয়াটিকে তীরে ভেড়াতে পারে। অবশ্য ১৯৭৬ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত পুনরুজ্জীবিত আওয়ামী লীগে সেই পরীক্ষা-নিরীক্ষাও হয়েছে। দল ও দেশ বাঁচাতে একাধিক জনের মধ্যে মূল দায়িত্বের অদল-বদল হয়েছে। কিন্তু অথৈ সাগরে নৌকা ঘুরপাক খেয়েছে। আগায় নি।

’৭৫-এর শূন্যতার সুযোগ নিয়েছে মোশতাক-জিয়া-সাত্তার-এরশাদ-খালেদা। তাদের মদত দিয়েছে তাদের আন্তর্জাতিক মুরব্বিরা। সবাই চেয়েছেন ইতিহাসের পীঠে সওয়ার হয়ে ‘অমরত্ব’ লাভ করতে। কিন্তু ইতিহাস কাঁধ থেকে সবাইকে নামিয়ে দিয়েছে। ঝেঁটিয়ে বিদায় করেছে। ইতিহাস অপেক্ষা করেছে একজন নির্মাতার। যে ইতিহাসের পীঠে সওয়ার না হয়ে ইতিহাস নির্মাণ করবেন।

১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগ সেই কাজটি করেছে। তার অনুপস্থিতিতে শেখ হাসিনাকে দলের কা-ারি রূপে গ্রহণ করেছে। ঐ যে বললাম, উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া নয়। বলেছি বিষয়টি আনন্দের ছিল না। প্রস্তাবটি এসেছে অপারগতা থেকে। প্রস্তাবটি এসেছে অসহায়ত্ত থেকে। শেখ হাসিনা রাজি না হলে কী হতো? যে দেশে রাষ্ট্রের স্থপতি, বঙ্গবন্ধুর মতো স্বাধীনতার মহানায়কের জীবনের নিরাপত্তা নেই, যেখানে রাসেলের মতো একটি অবুঝ শিশুর জীবনের নিরাপত্তা নেই, সেই দেশে সবার আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু আওয়ামী লীগের দায়িত্বভার নেওয়ার সাহস কী করে হয়? যে দেশ তার জাতির পিতাকে রক্ষা করতে পারেনি, সেই দেশ কি জাতির পিতার কন্যাকে রক্ষা করবে? এই নিশ্চয়তা কোথায়?
কোন ভরসায় তাহলে দায়িত্ব নেওয়া? কেন নেওয়া? এটা কী হঠকারিতা নয়? সহজ সারল্যে অনেকেই বিষয়টা এভাবে ভেবেছেন। বাস্তবেও দেখা গেছে এই ভাবনা অমূলক ছিল না। ১৯ বার জীবননাশের লক্ষ্যে হামলা, কথা দিয়ে, তত্ত্ব দিয়ে হয়নি। হয়েছে গুলি বন্ধুক গ্রেনেড প্রভৃতি মারণাস্ত্র দিয়ে।

১৯৮১ সালে শেখ হাসিনার বয়স ছিল মাত্র ৩৪ বছর। দুটি শিশুসন্তানকে বিদেশে রেখে তিনি ইতিহাসের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে দেশে চলে এসেছিলেন। কেন? না, কোনো ব্যক্তিগত প্রতিশোধ গ্রহণ করতে না। না, তিনি কোনো থ্রিলারের হিরোইন ছিলেন না। এসেছিলেন জাতির পিতার রক্তের ঋণ পরিশোধ করার জন্য। এসেছিলেন ’৭৫-এর রাজনৈতিক প্রতিশোধ গ্রহণ করার লক্ষ্যে। ক্ষমতার মোহে নয়, এসেছিলেন পিতার অসমাপ্ত কর্তব্যভার পালন করার প্রতিজ্ঞা নিয়ে। এসেছিলেন বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের ধারায় ফিরিয়ে নিতে। এসেছিলেন বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতিকে ভালোবেসে। এসেছিলেন এই কথা ভেবে, “ও আলোর পথযাত্রী, এ-যে রাত্রি এখানে থেম না” অন্তরের অন্তস্তল থেকে উৎসারিত এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে। যারা তাকে কথায় বা ইঙ্গিতে জীবনের ঝুঁকির কথা, সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, তাদের কথার উত্তরে নিজেকে প্রবোধ দিয়েছেন,

“আমি ভয় করবো না ভয় করবো না
দু’বেলা মরার আগে মরব না ভাই মরব না।”

তারপর “জীবন-মৃত্যুকে পা’য়ের ভৃত্য করে, চিত্তভাবনাহীন শেখ হাসিনা এগিয়ে গিয়েছেন।” আর ইতোমধ্যে পার করে দিয়েছেন অর্ধেক জীবনেরও বেশি।

দল বা দেশ চালাবার কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না। ছিল না কোনো পূর্ব-প্রস্তুতি। যখন তিনি আওয়ামী লীগের দায়িত্ব নিয়েছেন, তখন পরিস্থিতি ছিল চরম প্রতিকূল। আওয়ামী লীগ করাটাই সে-সময়ে ভয়ের কারণ ছিল। বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ করা যেত না। সামরিক শাসকদের রক্তচক্ষু। সামরিক-বেসামরিক গোয়েন্দা বাহিনীর হস্তক্ষেপ, দল-ভাঙার খেলা। দলের অভ্যন্তরে নানা উপদলীয় কোন্দল। জনগণের মধ্যে অপপ্রচার ও বিভ্রান্তি। বড় নেতাদের কারও কারও উদ্যোগে একাধিকবার দল ভেঙে দল করা।

সর্বোপরি গ্রেফতার, নির্যাতন ও ২১ আগস্টে গ্রেনেড হামলায় ২৩ জনের জীবনহানি। সংখ্যালঘু নির্যাতন। নির্বাচনের নামে মিডিয়া ক্যু (১৯৮৬), বিনা ভোটের পার্লামেন্ট (১৯৮৮), সূক্ষ্ম কারচুপির মাধ্যমে আওয়ামী লীগের নিশ্চিত বিজয় ছিনিয়ে নেওয়া (১৯৯১), ভোটার ও দলবিহীন নির্বাচন (ফেব্রুয়ারি ১৯৮৬) এবং ষড়যন্ত্রমূলক কারচুপির নির্বাচন (২০০১)।

পিতার মতোই সাহস, অসীম ধৈর্য এবং দূরদৃষ্টি নিয়ে এসব পরিস্থিতি তিনি মোকাবিলা করেছেন। পদে পদে প্রতিপক্ষের চক্রান্ত, ব্যক্তি স্বার্থে দল ও দেশের স্বার্থকে বিকিয়ে দিয়ে নিজ দলের ‘সংস্কারবাদী’ বলে খ্যাত প্রভাবশালীদের কারও কারও চক্রান্তের ফাঁদে পা দেওয়া, ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলার নামে রাজনীতি থেকে কার্যত শেখ হাসিনাকে নির্বাসিত করা এবং প্রিয় মাতৃভূমিতে ফেরা নিষিদ্ধ করা, আন্তর্জাতিক বৈরী শক্তির নানামুখী চাপ, দেশের তথাকথিত এলিট শ্রেণির একটি অংশের কারসাজি ইত্যাদি ব্যর্থ করে দিয়ে শেখ হাসিনাকে দৃঢ় পদক্ষেপে এগুতে হয়েছে।

তার জীবনাচার ও স্বভাবের লোক ঐতিহ্য, সহজ সারল্য, একদিকে যেমন বাংলার গরিব মেহনতি মানুষ ও মধ্যবিত্ত সমাজকে ভাবিয়েছে যে, ও তো আমাদেরই লোক, আমাদের ঘরের মেয়ে; তেমনি এই সহজ সারল্যকে অনেকে দুর্বলতাও ভেবেছে। এজন্য এলিট শ্রেণির লোকেরা কটু কাটব্য করেছে। কিন্তু দিনের শেষে বিজয়ের বরমাল্য তিনিই পেয়েছেন।

যেমন দল পরিচালনায়, তেমনি রাষ্ট্র পরিচালনায় তাকে অনেক কিছু শিখতে হয়েছে। জানতে হয়েছে। বুঝতে হয়েছে। সহকর্মীদের ও কর্মীদেরও শেখাতে, জানাতে ও বোঝাতে হয়েছে। ১৯৮১ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত কালপর্বটি ছিল তার জন্য Learning Period। এই সময়ের মধ্যে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনগুলো হৃত জনপ্রিয়তা ফিরে পেয়েছে। নতুন করে দৃঢ় ভিত্তির ওপর শক্তিশালী সংগঠন হিসেবে পুনঃপ্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। উপদলীয় প্রবণতা দূর হয়েছে। দলের মধ্যে তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা হিসেবে সকলের মন জয় করতে সক্ষম হয়েছেন। অন্যদিকে লাগাতার গণসংগ্রামের মধ্য দিয়ে জনগণের ভোটাধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা, এরশাদ-খালেদা স্বৈরাচারের দুঃশাসনের অবসান এবং গণতান্ত্রিক মানবিক সমাজ গঠনের প্রধান বাধাসমূহ দূর করা তার নেতৃত্বের গৌরবোজ্জ্বল সাফল্য।

রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাফল্যের বর্ণনা দিতে হলে এক মহাভারত রচনা করতে হবে। কেবল সামান্য কয়েকটি উদাহরণ দিলেই বোঝা যাবে, বাংলাদেশকে তিনি কোথা থেকে কোথায় টেনে এনেছেন। মোটা দাগে তিন মেয়াদের সাফল্য ও অর্জনগুলো হলো ১. মুক্তিযুদ্ধের ধারা পুনঃপ্রতিষ্ঠা ২. ’৭২-এর সংবিধানে ফিরে (পঞ্চদশ সংবিধান সংশোধনী) যাওয়া ৩. বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের বিচার সম্পন্ন ও রায় কার্যকর করা ৪. যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ৫. খাদ্যে আত্মনির্ভরশীলতা অর্জন ৬. দারিদ্র্যের হার ২২ শতাংশ নামিয়ে আনা ৭. প্রবৃদ্ধির হার ৮ শতাংশ ছাড়িয়ে যাওয়া ৮. পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি সম্পাদন ও কার্যকর করা ৯. ভারতের সাথে (ক) গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি (খ) স্থল সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন (গ) সমুদ্রসীমা নির্ধারণ (ভারত ও মিয়ানমার) এবং (ঘ) বহুমুখী অর্থনৈতিক সহযোগিতাকে নতুন পর্যায়ে উন্নীতকরণ ১০. মাথাপ্রতি আয় ১৬০০ ডলার ছাড়িয়ে যাওয়া এবং বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার প্রথম সোপান অতিক্রম ১১. নারীর ক্ষমতায়ন ১২. শিক্ষার হার ৭৩.৯ শতাংশে উন্নীতকরণ ১৩. জনগণের গড় আয়ুষ্কাল ৭২ বছরে উন্নীতকরণ ১৪. মহাকাশে নিজস্ব উপগ্রহ প্রেরণ ১৫. বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সমস্যার সমাধান ১৬. নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু ও কয়েকটি মেগা প্রজেক্ট বাস্তবায়নে অগ্রগতি ১৭. সামাজিক সুরক্ষার বহুমুখী কর্মসূচি বাস্তবায়ন ১৮. মিয়ানমার কর্তৃক বিতাড়িত ১০ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে বাংলাদেশ ঠাঁই দিয়ে তাদের প্রাণরক্ষার ব্যবস্থা করে মানবিকতার উজ্জ্বলতম নজির স্থাপন এবং ১৯. আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের সম্মান ও মর্যাদাকে শিখর চূড়ায় নিয়ে যাওয়া প্রভৃতি।

শেখ হাসিনার সাফল্য হচ্ছে, বাংলাদেশকে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর সামনে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। প্রায় সবার আগে এলডিজি বাস্তবায়ন এবং এসডিজি বাস্তবায়নে চমকপ্রদ সাফল্য অর্জন। আর এসব সাফল্য তার জন্য বয়ে এনেছে অসংখ্য আন্তর্জাতিক পুরস্কার ও সম্মাননা।

কেউ কেউ মনে করেন ‘ক্ষমতা’ হচ্ছে ‘ভোগ’ করার বা Enjoy করার বিষয়। যারা এটা মনে করেন তাদের কাছে এদেশে খালেদা-এরশাদের মতো অসংখ্য নজির আছে। ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও গোষ্ঠীস্বার্থে রাষ্ট্রক্ষমতার অপব্যবহারের যে দৃষ্টান্ত ওরা স্থাপন করেছেন, তা থেকেই মানুষের এই ধারণা সৃষ্টি হয়েছে। দুর্নীতির পঙ্কে নিমজ্জিত এসব একদার ক্ষমতাবানদের বিপুল সম্পদ, বিলাসী জীবনযাপন, দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের ব্যাপক বিস্তার ‘ক্ষমতা’ সম্পর্কে জনগণের নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি করেছে।

কিন্তু শেখ হাসিনা এক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম। খালেদা জিয়া ক্ষমতায় থাকাকালে বহুভাবে চেষ্টা করেছেন, চেষ্টা করেছে এক-এগারোর পরের তত্ত্বাবধায়ক সরকার, শেখ হাসিনার এবং তার পরিবারের ‘অবৈধ বিষয়-আশয় সহায়-সম্পদ’ খুঁজে বের করতে। দেশে-বিদেশে তন্নতন্ন করে খুঁজেছেন। কিন্তু তারা হতাশ হয়েছেন। যা নেই তা তারা খুঁজে পাবেন কীভাবে? কোনো দুর্নীতি ও ভোগ-বিলাসিতার মালিন্য তাকে ও তার পরিবারের সদস্য (তার ভাষায়, আমার পরিবার হচ্ছে আমার সন্তান ও আমার বোন রেহানার সন্তানদের মধ্যে সীমাবদ্ধ)-দের স্পর্শ করতে পারেনি। এটা একটা বিরল দৃষ্টান্ত।

‘ক্ষমতা’ তার কাছে ‘উপভোগ’ করার বিষয় নয়। অমর্ত্য সেনের ভাষায় রাষ্ট্রক্ষমতা হচ্ছে, ‘জনগণকে ক্ষমতাবান’ করা এবং তাদের ‘সক্ষমতা’ বাড়ানো। ব্যাপক অর্থ-ব্যঞ্জনা রয়েছে এই বাক্যটির। জনগণকে প্রকৃত ‘ক্ষমতাবান’ করা এবং তাদের ‘সক্ষমতা’ বাড়াতে হলে বিপুল পরিশ্রম, সততা, নিষ্ঠা এবং আত্মত্যাগের প্রয়োজন। প্রয়োজন তারুণ্যদীপ্ত উদ্দীপনার। ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা, স্বপ্ন রচনা, দেশবাসীকে স্বপ্ন দেখানো এবং স্বপ্ন রূপায়ণ।

পিতার মতোই শেখ হাসিনা তার জীবন যৌবন বিলিয়ে দিয়েছেন এই কাজে। স্বপ্ন জয় সহজসাধ্য বিষয় নয়। প্রৌঢ়ত্বের গণ্ডি পেরুবার এই অপরাহ্নবেলায়ও কী অমানুষিক পরিশ্রম তাকে করতে হচ্ছে, তা এখন আমরা সবাই জানি। অবিভক্ত বাংলার মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশিম তার আত্মজৈবনিক গ্রন্থ In Retrospect-এ বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, “আমি তার মধ্যে একজন ‘অসাধারণ দক্ষ কর্মযোগী’ তরুণের সন্ধান পেয়েছি।” কথাটি শেখ হাসিনার ক্ষেত্রেও সমভাবে প্রযোজ্য। আমরা তার মধ্যে তারুণ্যের উদ্দীপনায় ভরপুর একজন ‘অসাধারণ দক্ষ কর্মযোগী’ `Exceptionally good young man of action`-কে পেয়েছি।

শেখ হাসিনার সতীর্থ, যারা পরস্পরের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে কম-বেশি জানি, আমাদের এক ঘরোয়া আড্ডায় কথা উঠেছিল আমাদের মধ্যে কে কে সুখী, কে অসুখী। খুবই স্পর্শকাতর ও একান্ত ব্যক্তিগত প্রশ্ন। কিন্তু আমাদের ‘সতীর্থ ৭১’-এর আড্ডায় সেদিন যে যার মতো করে হাসি-তামাশার মধ্যে এর উত্তর দিয়েছি। হঠাৎ আমাদের মধ্যে প্রশ্ন উঠল, হাসিনা কী সুখী? কে দেবে এই প্রশ্নের উত্তর, তিনি তো আর এই আড্ডায় নেই। একবার মাত্র গণভবনে এই আড্ডা হয়েছিল। সাহস করে আমি বললাম, পিতা-মাতা-ভাই-ভ্রাতৃবধূদের এমন ট্র্যাজিক মৃত্যুর পরও একজন মানুষ কী সুখী হতে পারে? আমাদের মধ্যে স্তব্ধতা নেমে এলো। পরিবেশটা স্বাভাবিক করার জন্য রবীন্দ্রনাথের দুটি লাইন গেয়ে শোনালাম-

“স্বার্থক জনম মাগো জন্মেছি এই দেশে
স্বার্থক জনম মাগো তোমায় ভালোবেসে…।”

গান থামিয়ে বললাম, “এদেশে জন্মে, এদেশকে ভালোবেসে যে তার জন্মকে স্বার্থক মনে করে, তার মতো সুখী আর কে হতে পারে? হাসিনা সুখী। কারণ সে এদেশের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করে দেশকে ভালোবেসেছেন।” দেশকে এগিয়ে নিচ্ছেন। পিতৃ-হত্যার রাজনৈতিক প্রতিশোধ তিনি নিয়েছেন। বেবী মওদুদ, জাহানারা নিশি এবং বাদল-সহ অনেকেই আমাকে সোচ্চার সমর্থন জানালেন। সবার অনুরোধে সেদিন রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী আমাদের প্রয়াত সতীর্থ জাহানারা নিশি দরদি কণ্ঠে পুরো গানটা গাইলেন। পিনপতন নীরবতার মধ্যে যখন ওর গান শেষ হলো, তখন সবার চোখের কোণায় জল…।

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত