অন্য এক বাংলাদেশ

3702

Published on অক্টোবর 28, 2019
  • Details Image

এম নজরুল ইসলাম:

সপ্তাধিককাল কাটিয়ে এলাম দেশে। এবারে বেশ ব্যস্ত সময় কেটেছে। গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা হয়েছে। সর্ব ইউরোপিয়ান আওয়ামী লীগের আগামী দিনের পথচলায় নির্দেশনা নিয়েই ভিয়েনা ফিরেছি। ঢাকায় আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সর্ব ইউরোপিয়ান আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক হয়েছে। এবারের ঢাকা সফরকালে রাজনৈতিক সতীর্থদের সঙ্গে যেমন দেখা হয়েছে, তেমনি দেখা হয়েছে ঢাকার সংবাদিক বন্ধুদের সঙ্গেও। গিয়েছি ঢাকার বাইরেও। রাজধানীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে ঘুরেছি। সর্বত্রই দেখতে পেয়েছি বদলে যাওয়া অন্য এক বাংলাদেশের ছবি। মানুষের মধ্যে দেখেছি আশার আলো। যে সমৃদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সেই স্বপ্ন যে তাঁর কন্যার হাত ধরে পূরণ হতে চলেছে, তা আজ স্পষ্ট। সাক্ষাতে তিনিও তাঁর স্বপ্নের কথা বলেছেন। প্রতিবছর একাধিকবার দেশে যাই। এভাবেই সপ্তাধিককাল কাটিয়ে আসি আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও রাজনৈতিক সতীর্থদের সান্নিধ্যে। তবে এবারের অভিজ্ঞতা একেবারেই অন্যরকম। এবার দেখে এলাম ভেতরে ভেতরে ক্রমপরিবর্তনশীল অন্য এক বাংলাদেশ। উপলব্ধি করেছি দেশের মানুষও উন্নত আগামীর স্বপ্ন দেখতে শিখেছে। উন্নত জীবন যাপনে অভ্যস্ত হয়ে ওঠা মানুষ নিজেদের জীবনমানের উন্নতি চাইছে। প্রবাস থেকে গিয়ে স্বল্প সময় অবস্থান করেও উপলব্ধি করতে পেরেছি, বাংলাদেশে গ্রাম ও শহরের ব্যবধান ঘুঁচতে খুব বেশিদিন সময় লাগবে না।

আমি যেদিন ঢাকা ছেড়ে আসি, ঠিক তার দু’দিন আগে ২২ অক্টোবার মঙ্গলবার পদ্মা সেতুর ১৫তম স্প্যান ‘৪-ই’ বসানো হয়েছে। জাজিরা প্রান্তের ২৩ ও ২৪ নম্বর পিলারের ওপর এটি সফলভাবে স্থাপন করা হয়। এর মাধ্যমে সেতুর ২২৫০ মিটার এখন দৃশ্যমান। প্রকাশিত খবর থেকে জেনেছি, ১৪তম স্প্যান বসানোর তিন মাস ২৩ দিনের মাথায় স্থায়ীভাবে বসল এই পঞ্চদশ স্প্যানটি। একের পর এক স্প্যান বসানের ফলে দৈর্ঘ্য বেড়ে চলেছে পদ্মা সেতুর। গাড়ি ও ট্রেনে চড়ে পদ্মা পাড়ি এখন ধীরে ধীরে বাস্তবে রূপ নেওয়ার পথে। রাজধানী ঢাকা ও এর আশপাশের অঞ্চল থেকে পদ্মা নদী পাড়ি দিয়ে দক্ষিণাঞ্চলে যাওয়ার স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নেবে আর ২৬টি স্প্যান বসলেই। প্রাপ্ত তথ্য বলছে, মূল সেতুর বাস্তবায়নের অগ্রগতি ৮৪ ভাগ এবং আর্থিক অগ্রগতি ৭৫.৮৪ ভাগ শেষ হয়েছে। মূল সেতুর সব কটি পাইল ড্রাইভের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। সেতুর ৪২টি পিয়ারের মধ্যে ৩২টির কাজ শেষ হয়েছে। আর বাকি ১০টির কাজ চলমান। মোট ৪১টি ট্রাস (স্প্যান) এর মধ্যে চীন থেকে এসেছে ৩১টি। গত মঙ্গলবার বসানো হয়েছে ১৫তম স্প্যান। রেলওয়ে স্ল্যাব-এর জন্য মোট ২৯৫৬টি প্রি-কাস্টের মধ্যে ২৮৯১টি স্ল্যাব তৈরির কাজ শেষ হয়েছে। বাকিগুলো শেষ হবে আগামী নবেম্বরে। এ পর্যন্ত ৩৬১টি স্ল্যাব স্থাপন করা হয়েছে। অন্যদিকে, ২৯১৭টি প্রি-কাস্ট রোডওয়ে ডেকস্ল্যাবের মধ্যে ১৫৫৩টির কাজ শেষ হয়েছে। আর স্থাপন করা হয়েছে ৫৪টি। পদ্মা সেতু শুধু দেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের নয়, সারা বাংলাদেশেরই স্বপ্নের সেতু। এই সেতু নির্মিত হচ্ছে নিজস্ব অর্থায়নে। এই দক্ষিণাঞ্চলেই নির্মিত হয়েছে দেশের তৃতীয় সমুদ্র বন্দর, পায়রা সমুুদ্র বন্দর। পদ্মা সেতু নির্মাণের পর পায়রা সমুদ্র বন্দরটি দক্ষিণ জনপদের অর্থনীতির চিত্র বদলে দেবে বলে মনে করা হচ্ছে। পায়রা বন্দর দক্ষিণ জনপদের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র হবে বলে মনে করা হচ্ছে। স্থানীয়দের আশা, বন্দরটি পূর্ণাঙ্গভাবে চালু হলে উপকূলীয় এলাকার হাজার হাজার বেকার যুবকের কর্মসংস্থান হবে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নতুন জোয়ার আনবে পদ্মা সেতু ও পায়রা বন্দর, এটাই অর্থনীতিবিদদের আশা।

প্রবাসে থাকতেই জেনেছি ভেতরে ভেতরে অনেকটাই বদলে গেছে বাংলাদেশ, প্রতিদিন একটু একটু করে বদলে যাচ্ছে। ‘দ্য স্পেক্টেটর ইনডেক্স’-এ প্রকাশিত বিশ্বের ২৬টি শীর্ষ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী দেশের তথ্যের ভিত্তিতে দেখা যায় বাংলাদেশ জিডিপি বা মোট দেশজ উৎপাদন অর্জন করেছে বিশ্বের সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি। ২০০৯ সাল থেকে শুরু করে ২০১৯ পর্যন্ত এ দেশের সবচেয়ে সফল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের ১০ বছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি সারা বিশ্বে সবার ওপরে। এ সময় বাংলাদেশের জিডিপিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৮৮ শতাংশ, যা বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ চীন ও ভারতের চেয়েও বেশি। যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ইকোনমিকস এ্যান্ড বিজনেস রিসার্চ (সিইবিআর) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০৩২ সালের মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বের বড় ২৫টি অর্থনীতির দেশের একটি হবে। তখন বাংলাদেশ হবে ২৪তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। বর্তমানে অবস্থান ৪১তম। ২০৩৩ সালে বাংলাদেশের পেছনে থাকবে মালয়েশিয়া, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশ। আগামী ১৫ বছর দেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি গড়ে ৭ শতাংশ থাকবে। ‘দ্য ওয়ার্ল্ড ইন ২০৩০ : আওয়ার লং টার্ম প্রজেকশনস ফর ৭৫ কান্ট্রিজ’ শিরোনামের এই রিপোর্টে দেখানো হয়েছে, ২০১৮ থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে অবস্থানের দিক থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতি ১৬ ধাপে উন্নীত হবে, যা অন্য যে কোন দেশের তুলনায় অধিক। অন্যদিকে হংকং সাংহাই ব্যাংকিং কর্পোরেশন- এইচএসবিসির সর্বশেষ গ্লোবাল রিসার্চে বলা হয়েছে, আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) নিরিখে বিশ্বের ২৬তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বর্তমানে বাংলাদেশের অবস্থান যেখানে ৪২তম।

এইচএসবিসি’র দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়ন মডেলে দেখানো হয়েছে, ২০৩০ পর্যন্ত প্রতিবছর বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গড়ে ৭.১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে। যা রিপোর্টে উল্লিখিত ৭৫টি দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ। বাংলাদেশে ২০১৮ সাল থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ৭.৩ শতাংশ, ২০২৩ থেকে ২০২৮ সালের মধ্যে ৭.০ শতাংশ এবং ২০২৮ থেকে ২০৩৩ সালের মধ্যে ৭.২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হওয়ার কথা বলা হয়েছে। রিপোর্ট বলছে, বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতি ৩০০ বিলিয়ন ডলারের হলেও ২০৩০ সালের মধ্যে তা বেড়ে দাঁড়াবে ৭০০ বিলিয়ন ডলারে। চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি আট শতাংশ হবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। আজ বুধবার এডিবি ডেভেলপমেন্ট আউটলুকে এই পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। সরকার চলতি অর্থবছরে ৮ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে বলে লক্ষ্য ঠিক করেছে।

ওদিকে গত এক মাসেরও বেশি সময় ধরে দেশে চলছে শুদ্ধি অভিযান। এরই মধ্যে বেশ কয়েকজন যুবলীগ নেতা ও সিটি কর্পোরেশনের ওয়ার্ড কমিশনারকে গ্রেফতার করা হয়েছে। দুর্নীতির অভিযোগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদত্যাগ করেছেন। ঢাকার নামী-দামী ক্লাবগুলোতে বেআইনীভাবে চালানো অনেক ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে র‌্যাবের অভিযান এবং ক্যাসিনো পরিচালনাকারী আওয়ামী যুবলীগের নেতার আসনে গেড়ে বসা ‘গডফাদারদের’ গ্রেফতার ও কোটি কোটি টাকার জুয়ার সরঞ্জাম উদ্ঘাটন জনমনে প্রবল আলোড়নের সৃষ্টি করেছে। জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে এই অভিযান। সাধারণ মানুষ এই অভিযানকে অভিনন্দন জানিয়েছে। বৃদ্ধি পেয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাবমূর্তি। যুবলীগের চেয়ারম্যানকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। স্ত্রী-পুুত্রসহ তাঁর ব্যাংক এ্যাকাউন্ট জব্দ করা হয়েছে।

গত সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ অধিবেশনের ফাঁকে নিউইয়র্কে ভয়েস অব আমেরিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, জঙ্গী ও সন্ত্রাসবাদ এবং মাদকের বিরুদ্ধে অভিযানের পর সমাজ থেকে বৈষম্য দূর করতেই তিনি দুর্নীতি-অনিয়মের বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নেন। বাংলাদেশে সপ্তাধিককাল অবস্থানকালে অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে প্রত্যক্ষ করলাম ‘বিএনপি রয়ে গেছে বিএনপিতেই’। কেবলই ‘বিরোধিতার স্বার্থে বিরোধিতা’ নীতিতে এখনও অনড় দলটি। সরকারের এসব ইতিবাচক কর্মকা-কে সাধুবাদ জানাতে পারেনি বিএনপি। তাদের এই রাজনৈতিক দৈন্য যে এখনও গেল না, বাংলাদেশের রাজনীতিতে এর চেয়ে দুঃখজনক বিষয় আর কী থাকতে পারে।

লেখক : সর্ব ইউরোপিয়ান আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং অস্ট্রিয়া প্রবাসী লেখক, মানবাধিকারকর্মী, সাংবাদিক

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত