হে স্বদেশ ফের সেই কথা জানালাম...

3710

Published on নভেম্বর 2, 2020
  • Details Image

সৈয়দা জাকিয়া নূর লিপিঃ

পঁচাত্তর-পরবর্তী বাংলাদেশের ইতিহাসে ৩ নভেম্বরের জেলহত্যা সবচেয়ে ন্যক্কারজনক ও কলঙ্কময় অধ্যায়। জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংসতার পর এই জেল হত্যাকাণ্ড বিশ্ববিবেককেও স্তম্ভিত করে দেয়। এদিন মহান মুক্তিযুদ্ধের চার কাণ্ডারি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে যাঁরা স্বাধীনতা যুদ্ধকে দৃঢ়তার সঙ্গে নেতৃত্ব দিয়েছেন, সেই চার মহান জাতীয় নেতাকে সভ্যতার ইতিহাস লঙ্ঘন করে নৃশংসভাবে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে হত্যা করা হয়। সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এবং এএইচএম কামারুজ্জামান ছিলেন সেই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের নির্মম শিকার। তাই ক্যালেন্ডারের পাতা ঘুরে ৩ নভেম্বর এলেই স্বজন হারানোর গোপন বেদনা বারবার গুমরে ওঠে।

চার শহীদের অন্যতম প্রধান ব্যক্তি ছিলেন কিশোরগঞ্জের কীর্তিমান রাজনীতিক; সৎ, স্বচ্ছ ও আদর্শভিত্তিক রাজনীতির বরপুত্র সৈয়দ নজরুল ইসলাম। তিনি আমার বাবা। রাজনীতি আর মন্ত্রিত্বের কারণে বাবা ঘরে খুব বেশি সময় দিতে পারতেন না। তারপরও যেটুকু অবসর পেতেন সেই সময়টুকু তিনি আমাদের দেওয়ার চেষ্টা করতেন। মনে পড়ে, ছোটবেলা বাবা প্রায়ই আমাদেরকে রবীন্দ্রনাথের 'সোনার তরী' কাব্য থেকে কবিতা পড়ে শোনাতেন। শোনাতেন শরৎচন্দ্রের গল্প আর উপন্যাস। বাবা খুব কোমল হৃদয়ের মানুষ ছিলেন। কিন্তু দায়িত্বের ব্যাপারে ছিলেন অত্যন্ত দৃঢ়চেতা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি ছিল তার অগাধ আস্থা ও শ্রদ্ধা। বাবা তখন প্রায়ই বলতেন, মোশতাক যেহেতু বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলেছে, সে আমাদেরও বাঁচতে দেবে না। আম্মা বারবার বাবাকে বাসা ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য বলতেন। কিন্তু বাবা তার সাহস আর দৃঢ়চেতা মানসিকতায় পালিয়ে যাওয়ার মতো ভীরুতা দেখাননি। বঙ্গবন্ধুকে হারানোর পর তিনি হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন, তার সামনেও বড় কোনো ঝুঁকি অপেক্ষা করছে। যে কারণে তিনি আমাদের খুব বেশি আদর করতেন। ঘন ঘন জড়িয়ে ধরতেন, চুমু খেতেন। এর মধ্যে আমাদের বাসায় একদিন ফোন এলো। বাবা ফোন ধরে কথা বলতে লাগলেন। অপর প্রান্তে কে আছেন, আমরা জানি না। তবে, বাবার উত্তেজিত কণ্ঠ শুনে আমাদের বুঝতে বাকি থাকে না যে, টেলিফোনে কথা বলছে খন্দকার মোশতাক। তিনি তার মন্ত্রিসভায় যোগ দেওয়ার জন্য বাবাকে পীড়াপীড়ি করলেন। বাবা তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিমায় দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন, তিনি বঙ্গবন্ধুর আদর্শ আর রক্তের সঙ্গে বেইমানি করতে পারবেন না। কথা শেষ করেই তিনি খুব জোরে রিসিভার ছুড়ে মারেন। এর পর আরও কয়েকবার ফোন এসেছে। এক পর্যায়ে বাবা ফোন রিসিভ করা বন্ধ করে দিলেন। একদিন ফোন ধরলেন আম্মা। তার কাছেও একই প্রস্তাব দেওয়া হলো। আম্মাও খুব সাহসের সঙ্গে না করে দিলেন।

সে রাতে বাবাকে খুব চিন্তিত মনে হয়েছিল। বাবা সাধারণত আমাদেরকে খুব বেশি কাছে ডাকতেন না। সেদিনের পর থেকে আমাদের সবাইকে বুকের কাছে পেতে চাইতেন। বাবা দূরদর্শী ছিলেন। তিনি জানতেন, বড় একটা কিছু অঘটন ঘটতে যাচ্ছে। তাই আমাদের প্রতি তার আদরের মাত্রা অনেক বেশি বেড়ে যায়। বাবার এই হঠাৎ পরিবর্তন সেই ছোট্ট বয়সেও আমাদের ভাবিয়ে তোলে। এ যেন মুক্তিযুদ্ধের সময় অবরুদ্ধ দেশের সেই কঠিন পরিস্থিতি। বাবা একদিন আমাদের দু'বোনকে ডেকে সুকান্তের কবিতার লাইন আউড়ে শোনালেন- 'দৃঢ় সত্যের দিতে হবে খাঁটি দাম/ হে স্বদেশ ফের সেই কথা জানালাম/ জানে না তো কেউ পৃথিবী উঠছে কেঁপে/ ধরেছে মিথ্যা সত্যের টুঁটি চেপে।'

১৫ আগস্টের মর্মন্তুদ ঘটনার পরের সপ্তায় একদিন মোশতাকের সেনারা বাবাকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায়। নেওয়ার সময় বলেছিল, আবার তাকে ফিরিয়ে দেওয়া হবে। হ্যাঁ, ফিরিয়ে ঠিকই দিয়েছিল, তবে লাশ করে। বাবার কথা মনে হলে আজও বুকের ভেতরটা খাঁখাঁ করে। বড় ভাই সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের মধ্যে বাবার সেই চরিত্র, সেই আদর্শের প্রতিফলন দেখেছিলাম। কিন্তু সেই ভাইও অনন্তের পথে হারিয়ে গেছেন। জেলহত্যার বিচার একটা হয়েছে বটে, তবে নেপথ্যের সেই ষড়যন্ত্রকারীরা আজও তাদের হিংস্র থাবা গুটিয়ে নেয়নি। এই ষড়যন্ত্রকারীদের সমূলে বিনাশ করতে পারলেই বাংলাদেশ হয়ে উঠবে পরিপূর্ণ নিরাপদ এবং আমরাও সেদিন পরম নিশ্চিন্তে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারব। বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশরত্ন জননেত্রী শেখ হাসিনা এমনটিই চাইছেন।

লেখকঃ সৈয়দ নজরুল ইসলামের কন্যা; সংসদ সদস্য

সৌজন্যেঃ দৈনিক সমকাল

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত