বঙ্গবন্ধুঃ একজন বিরল বিশ্বনেতৃত্বের নাম

8244

Published on ফেব্রুয়ারি 27, 2020
  • Details Image

- অধ্যাপক ড. মো. সাজ্জাদ হোসেন

বঙ্গবন্ধু আর বাংলাদেশ-একই সূত্রে গাঁথা। অধিকারবঞ্চিত বাঙালিজাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে একটি স্বাধীন দেশ উপহার দিয়েছেন তিনি। ভঙ্গুর অর্থনীতি থেকে একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে গড়ার কাজে হাত দেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

আজীবন এই মানুষটি বিশ্বের শোষিত মানুষের কথা ভেবেছেন, তাদের অধিকার আদায়ে সংগ্রাম করেছেন।

তিনি বাঙালির না বলা কথা বুঝতে পারতেন! তাইতো পুরো জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে তাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করেছিলেন। বাঙালির অধিকারের কথা বলতে গিয়ে যৌবনের ১৩টি মূল্যবান বছর শেখ মুজিব কাটিয়েছেন পাকিস্তানের কারাগারে।

কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বসে যে নেতা প্রিয় মাতৃভূমি বাংলার ছবি হৃদয় দিয়ে এঁকেছেন, ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন, সেই নেতাকে ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি জাতির পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞচিত্তে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। আসছে ২৩ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবের ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধির ৫১ বছর।

তিনি শুধু বাঙালি জাতিরই মহান নেতা ছিলেন না, সারা বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নেতা ছিলেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই তিনি উপলব্ধি করেছিলেন এই পাকিস্তান বাঙালিদের জন্য হয়নি। একদিন বাংলার ভাগ্যনিয়ন্তা বাঙালিদের হতে হবে। সেই লক্ষ্য সামনে নিয়ে ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগ এবং ১৯৪৯-এর ২৩ জুন আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করেন।

তারপর সংগ্রামের সুদীর্ঘ পথে নেতৃত্ব দিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন সংগঠিত করার মধ্য দিয়ে স্বাধীন সার্বভৌম ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠা করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে ঊনসত্তুরের গণআন্দোলন এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়।

জাতির মুক্তিসনদ ছয় দফা ঘোষণা করায় শেখ মুজিবসহ মোট ৩৫ জনের বিরুদ্ধে ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব ও অন্যান্য’ করা হয়। যা ইতিহাসে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা হিসেবে পরিচিত। এরপর এর প্রতিবাদে ফুঁসে ওঠে ছাত্র সমাজ।

এরই প্রেক্ষিতে ১৯৬৯ সালের ৪ জানুয়ারি সকল ছাত্র সংগঠনের ঐক্যবদ্ধ প্ল্যাটফরম ‘কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করা হয়। বর্তমান আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা ও ডাকসুর তৎকালীন ভিপি তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচি ১১ দফা ঘোষণা করা হয়। যেখানে অগ্রবর্তী ভূমিকা রাখে এদেশের ছাত্র তথা তরুণ সমাজ। এরই মধ্যে দেশজুড়ে আন্দোলনে নেমে পড়েছে মানুষ।

১৫ ফেব্রুয়ারি সার্জেন্ট জহুরুল হক এবং ১৮ ফেব্রুয়ারি ড. শামসুজ্জোহা নিরাপত্তা বাহিনীর বুলেটে নির্মমভাবে নিহত হলে বাংলার মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। বিক্ষুব্ধ মানুষকে দমাতে আইয়ুব সরকার সান্ধ্য আইন জারি করে। এরপরও থেমে থাকেনি বাংলার তরুণ সমাজ।

জনরোষের ভয়ে এক পর্যায়ে ২২ ফেব্রুয়ারি আইয়ুব খান আগরতলা মামলা সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করে বঙ্গবন্ধুসহ সব রাজবন্দীকে নিঃশর্ত মুক্তি দেয়। এরপর দেশজুড়ে বয়ে যায় আনন্দের বন্যা।

মুক্তি পাওয়ার পরদিন অর্থাৎ ওই বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে গণসংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ওইদিন প্রিয় নেতাকে একনজর দেখতে রাজধানীতে লাখ লাখ মানুষের সমাগম ঘটে।

ঐতিহাসিক ওই জনসভায় শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেওয়া হয়। এক স্মৃতি কথায় ডাকসুর তৎকালীন ভিপি, সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক, মুখপাত্র ও সমন্বয়ক তোফায়েল আহমেদ লিখেছেন, …সেই জনসমুদ্রের মানুষকে যখন জিজ্ঞাসা করেছিলাম, যে নেতা জীবনের যৌবন কাটিয়েছেন পাকিস্তানের কারাগারে, ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন, সেই প্রিয় নেতাকে কৃতজ্ঞ বাঙালি জাতির পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞচিত্তে একটি উপাধি দিতে চাই। ১০ লাখ মানুষ যখন ২০ লাখ হাত উত্তোলন করেছিল সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। তখনই প্রিয় নেতাকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়।

এরপর থেকেই পৃথিবীর নিপীড়িত মানুষের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ‘বঙ্গবন্ধু’ হিসেবে সারাবিশ্বের মানুষ তাকে ডাকে। এখন তিনি ‘বিশ্ববন্ধু’ হিসেবেও স্বীকৃতি পেয়েছেন। গতবছরের ১৫ আগস্টের এক আলোচনায় জাতিসংঘে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নেতারা তাকে, বিশ্ববন্ধু হিসেবে আখ্যা দেন।

ঊনসত্তরের ২৩ ফেব্রুয়ারি ‘বঙ্গবন্ধু’ হিসেবে দেওয়া প্রথম ভাষণে শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘আগরতলা মামলার আসামি হিসেবে আমাকে গ্রেফতার করে কারাগার থেকে মুক্তি দিয়ে পুনঃ গ্রেফতার করে যখন ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাবে, তখন বুঝতে পেরেছিলাম যে, ওরা আমাকে ফাঁসি দেবে। তখন এক টুকরো মাটি তুলে নিয়ে কপালে মুছে বলেছিলাম, হে মাটি, আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমাকে যদি ওরা ফাঁসি দেয়, মৃত্যুর পরে আমি যেন তোমার কোলে চিরনিদ্রায় শায়িত থাকতে পারি।’

বক্তৃতার শেষে তিনি বলেছিলেন, ‘রক্ত দিয়ে জীবন দিয়ে তোমরা যারা আমাকে কারাগার থেকে মুক্ত করেছ, যদি কোনো দিন পারি নিজের রক্ত দিয়ে আমি সেই রক্তের ঋণ শোধ করে যাব।’ তিনি একাই রক্ত দেননি, সপরিবারে বাঙালি জাতির রক্তের ঋণ তিনি শোধ করে গেছেন। তিনি চলে গেছেন, রেখে গেছেন তাঁর দুই কন্যা।

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন দেখতেন- বাংলাদেশের স্বাধীনতা; যা তিনি সম্পন্ন করেছেন। আরেকটি ক্ষুধামুক্ত ও দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, আমরা তাকে ধরে রাখতে পারিনি।

তবে জাতির পিতার সেই অসমাপ্ত কাজটি দক্ষতার সঙ্গে বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে চলেছেন তারই জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা। তিনি ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ তথা ভিশন-২০২১ বাস্তবায়ন করছেন। তিনি ভিশন-২০৩০, ২০৪১ এবং একশ বছরব্যাপী ডেল্টা প্ল্যান ঘোষণা করেছেন।

সে অনুযায়ী নানা উদ্যোগ ও পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষেণে জানা যায়, বাংলার দুখী মানুষের মুক্তির জন্য ৪ হাজার ৬৮২ দিন কারারুদ্ধ ছিলেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধু যা বলতেন, তা বিশ্বাসী আত্মা থেকে উঠে আসত এবং একবার যা বলতেন, ফাঁসির মঞ্চে গিয়েও তার সঙ্গে আপস করতেন না। স্বাধীনতার পর ১৯৭২-এর ৮ জানুয়ারি, পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পান তিনি।

পরে সেখান থেকেই লন্ডন যান। এরপর ৯ জানুয়ারি লন্ডনে এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকরা তাকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আপনার বাংলাদেশ তো এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। সেখানে কিছুই নেই, শুধু ধ্বংসস্তূপ।’

উত্তরে বলেছিলেন, ‘আমার মাটি আছে। আমার মানুষ আছে। আমার মাটি যদি থাকে, আমার মানুষ যদি থাকে, একদিন এই ধ্বংসস্তূপ থেকেই আমি আমার বাংলাদেশকে ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত, শস্য-শ্যামলা সোনার বাংলায় পরিণত করবো।’

বঙ্গবন্ধু তা পেরেছিলেন। তাই অসংখ্য বাধা মোকাবিলা করে সাফল্য পাওয়ার যে সক্ষমতা এ দেশের জনগণের রয়েছে সে সত্যটিও তিনি জানতেন। দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ করে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নেন তিনি। তৈরি করা হয় সংবিধান; ১৯৭২ সালে প্রজাতন্ত্রের ওই সংবিধানেও বঙ্গবন্ধুর অন্তর্ভুক্তিমূলক সমৃদ্ধির দর্শন প্রতিফলিত হয়।

শিক্ষার বিষয়টি উপলব্দি করে তিনি প্রাথমিক থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষা-সব স্তরেই যুগান্তকারী পদক্ষেপ নেন। প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি)।

জাতির পিতা যেখানেই যেতেন, কথা বলতেন-সব জায়গাতেই বাংলার গরিব-দুঃখী-কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের কথা থাকতো। আলজেরিয়ায় অনুষ্ঠিত জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে যোগদান করে মঞ্চে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘বিশ্ব আজ দু’ভাগে বিভক্ত। একদিকে শোষক আরেক দিকে শোষিত। আমি শোষিত জনগণের পক্ষে।’

সত্যিই তিনি শোষিত জনগণের পক্ষে ছিলেন। আমৃত্যু মানুষের কল্যাণ এবং মানুষের অধিকার আদায়ের কথা বলেছেন। শাসকের বুলেট কিংবা রক্ত চক্ষু তাকে দাবায়ে রাখতে পারেনি।

বঙ্গবন্ধুর জীবন ছিল বাংলার মানুষের জন্য উৎসর্গিত। তিনি নিজেই বলেছেন সে কথা। ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্ট যখন সাক্ষাৎকার নেন, তখন জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘What is your qualification?’

উত্তরে রাজনীতির মহানায়ক বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘I love my people.’ পরের প্রশ্ন ছিল, ‘What is your disqualification?’ বলেছিলেন, ‘I love them too much।’

সত্যিই, বাংলার মানুষের প্রতি বঙ্গবন্ধুর হৃদয়ের ভালোবাসা এত গভীর ছিল যে, সমুদ্রের গভীরতা পরিমাপ করা যায়, কিন্তু বাঙালি জাতির প্রতি, দুঃখী মানুষের প্রতি তাঁর যে ভালোবাসা এটা কোনো দিন নিরূপণ করা যায় না।

আর এ কারণেই মহৎ গুণাবলীর অধিকারী ‘বাঙালির বন্ধু’ হিসেবে আস্থা অর্জনকারী, গরিব-দুঃখী-মেহনতি মানুষের বন্ধু এমন একজন মহান ব্যক্তিত্বের নামের অগ্রেই ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি শোভনীয়। এবছর বাঙালি জাতি জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করবে।

জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকীতে আমাদের প্রত্যয় হোক তার স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তোলার দৃপ্ত শপথ।

লেখক: সদস্য, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন

 

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত