বাঙ্গালির সূচনাবিন্দু ছয় দফাঃ আওয়ামী লীগের অনলাইন আলোচনায় বক্তারা

6657

Published on জুন 8, 2020
  • Details Image

ঐতিহাসিক ৬ দফা দিবসে রোববার (৭ জুন) রাতে অনলাইনে সম্প্রচারিত ভার্চুয়াল আলোচনা অনুষ্ঠান ‘৬ দফা থেকে স্বাধীনতা’ শীর্ষক তরুণদের সাথে রাজনীতিক ও ইতিহাসবিদদের ওয়েবিনার আয়োজন করা হয়। ওয়েবিনারটি সম্প্রচারিত হয় আওয়ামী লীগের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ এবং ইউটিউব চ্যানেলে। সঞ্চালনায় ছিলেন সুভাষ সিংহ রায়।

আলোচনায় অংশ নেন সাবেক ছাত্রনেতা ও ডাকসুর সাবেক সহসভাপতি এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য তোফায়েল আহমেদ এমপি, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় কৃষি মন্ত্রী ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম মেম্বার ড. মো: আব্দুর রাজ্জাক, আরো উপস্থিত ছিলেন বঙ্গবন্ধুর একান্ত সচিব ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গর্ভনর ড. মোহাম্মদ ফরাস উদ্দিন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. হারুন অর রশিদ ও সিনিয়র সাংবাদিক অজয় দাশগুপ্ত উপস্থিত ছিলেন।

কিভাবে ৬ দফার পরিকল্পনা করছিলেন বঙ্গবন্ধু- অনুষ্ঠান সঞ্চালকের এমন প্রশ্নের জবাবে জনাব তোফায়েল আহমেদ বলেন, 'আওয়ামী লীগ নেতার দল নয়, আওয়ামী লীগ কর্মীর দল। আমার নেতা-কর্মীরা যদি আমার পাশে থাকে তবে আমি আমার লক্ষ্যে পৌছবই' এই বক্তব্য দিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে বঙ্গবন্ধু সারা বাংলাদেশ সফর করতে শুরু করেন। বঙ্গবন্ধু ছয় দফা প্রচারের জন্য ৩৫ দিনে ৩২টি জনসভা করেছিলেন। তিনি জানতেন তিনি গ্রেফতার হবেন তাই তিনি সময়ের অপচয় করেননি। এভাবে ছয় দফাকে তিনি আন্দোলনের এক চূড়ান্ত শিকড়ে পৌছে দিয়েছিলেন। আমাদের সূচনা বিন্দু ছিল ছয় দফা। অর্থাৎ ছয় দফার সাঁকো পেরিয়েই আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি।

তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ছয় দফা ও ৭ জুন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। আমাদের জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে ছয় দফা ও ৭ জুনের গুরুত্ব অপরিসীম। “৬ দফা না দিলে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা হত না, আর বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত না করতে পারলে ৭০ এর নির্বাচনে জয়ী হতে পারতাম না।”

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম মেম্বার ড. মো: আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ৭ই জুন ১৯৬৬ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সারাদেশ জুড়ে হরতাল পালিত হয়। ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগ এবং সাধারণ জনতার স্তস্ফুর্ত অংশগ্রহণে এ হরতাল সফল হয়েছিলো। সারাদেশজুড়ে হরতালটি এতো সংগঠিত ছিলো যে পুলিশ, ইপিআর হরতালে গুলি চালায়। ১৯৬৬-এর এই দিনে মনু মিয়া, মুজিবুল্লাহসহ অসংখ্য শহীদের রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল ঐতিহাসিক ছয় দফা আন্দোলন।

কৃষিমন্ত্রী আরো বলেন, বঙ্গবন্ধু ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্টের আগেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা চিন্তা করেছিলেন। কারণ তিনি ঠিক বুঝতে পেরেছিলেন পাকিস্তান সৃষ্টির পর পূর্ব বাংলা হবে পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণের একমাত্র জায়গা এবং একটি উপনিবেশ মাত্র।

অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাস উদ্দিন বলেন, বাংলাদেশে পাট জন্মালো ৪০ এর দশকে। কোরিয়ানরা এদেশ থেকে পাট কিনে নিলো অতি উচ্চ মূল্যে। এ থেকে যে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হলো তা দিয়ে যাবতীয় শিল্পায়নের সামগ্রী কেনা হলো করাচির জন্য। বঙ্গবন্ধু খুব ভালভাবে বুঝতে পেরেছিলেন তাদের এই বৈষম্যটা। ১৯৬০ সাল আসার আগেই বঙ্গবন্ধু বুঝতে পারলেন এদের সাথে আর থাকা যাবেনা।

তিনি আরো যোগ করেন “ছয় দফা কে প্রণয়ন করা এ নিয়ে মজাদার গল্প আছে। কেউ কেউ অনেক ইতিহাস রচনা করেছেন, কেউ কেই বলেছেন সিভিল সার্ভেন্ট লিখেছে, কেউ কেউ বলছেন ওমুক প্রফেসর লিখেছেন। “বঙ্গবন্ধু নিজের জবানে বলেছেন, ‘আমার মাথার কিলবিল, আলফা ইন্সুরেন্স কম্পানির দেওয়া ভাঙ্গা টাইপ রাইটারে হানিফের টাইপিংয়ে ছয় দফা’।”

ছাত্রদের মনে প্রশ্ন জেগেছে, কেনো আওয়ামী লীগ নেতারা ছয় দফার বিরোধীতা করেছিলেন। এ প্রশ্নের উত্তরে ফরাস উদ্দিন বলেন, বঙ্গবন্ধুর যে সাহস, যে সাংগঠনিক ক্ষমতা, অর্জন করা যে প্রত্যয় ছিল তৎকালীন সময়ে তার সমসাময়িক যে আওয়ামী লীগ নেতারা ছিলেন তারা ছিলেন অপেক্ষাকৃত ভীতু। এই ছিলো পটভূমি।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. হারুন অর রশিদ বলেন, বঙ্গবন্ধু ১৯৪৭ সালে সৃষ্টি হওয়া পাকিস্তান রাষ্ট্রে বিশ্বাস করতেন না। বঙ্গবন্ধু তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীর ২২ নম্বর পৃষ্ঠায় লিখেছিলেন, তিনটা রাষ্ট্র হবে, একটি হচ্ছে বর্তমান পাকিস্তান, আজকের বাংলাদেশ ও ভারতবর্ষ। এ তিনটি রাষ্ট্রের কথা বঙ্গবন্ধু স্পষ্ট করে বলে গেছেন। বঙ্গবন্ধু জাতির পিতা এবং স্বাধীন রাষ্ট্রের স্থপতি ঠিক কিন্তু তিনি সবার আগে ছিলেন মনে প্রাণে একজন বাঙালি। হাজার বছর ধরে বাঙালির যে ইতিহাস, সংস্কৃতি তা তিনি বুকে ধারণ করেছেন সেইসাথে বাঙালির হাজার বছরের জাতি মুক্তির যে আন্দোলন-সংগ্রাম তা তিনি বুকে ধারণ করেছেন ৫২-র ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে একাত্তরের দিকে তিনি ধাবিত হয়েছেন ধাপে ধাপে।

তিনি আরো যোগ করেন, বঙ্গবন্ধুর বুঝতে পেরেছিলেন ছয় দফার পথই আসল পথ। তার সাথে যদি কেউ নাও থাকে তবুও তিনি এই আন্দোলন সংগ্রাম চালিয়ে যাবেন বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। কারণ তিনি জানতেন এর মাধ্যমেই বাঙালির মুক্তি আসবে। ছয় দফা থেকে সরে আসতে বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তান সরকার অনেক অনুনয় বিনয় করলেও তিনি বলেন, ছয় দফার একটি দাঁড়ি, কমা, সেমিকোলনও পরিবর্তন করা হবেনা।

অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে সিনিয়র সাংবাদিক অজয় দাশগুপ্ত বলেন, ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারীর পরে আওয়ামী লীগের সকল নেতা-কর্মী গ্রেফতার হয়ে গিয়েছিলো। এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছিলো ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক করার জন্য মহিলা সম্পাদক আমেনা বেগমকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল এবং আওয়ামী লীগের সাবেক-বর্তমান সকল নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছিলো। কিন্তু তারাই ৭ই জুন হরতাল ডেকেছিলো। এমন সফল হরতাল হয়েছিলো যে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ২৯ সেপ্টেম্বরের মতো যে হরতালে কোন পিকেটিং লাগেনি এমন একটা সর্বাত্নক হরতাল তারা পালন করেছিলো। তরুণদের উপর নির্ভর করেই কিন্তু ৭ই জুনের হরতাল পরে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান সংগঠিত হয়েছিল।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ১৯৬৬ এর ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে সম্মিলিত বিরোধী দলসমূহের এক কনভেনশনে বাংলার গণমানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের দাবি সম্বলিত বাঙালির ‘ম্যাগনাকার্টা’ খ্যাত ঐতিহাসিক ‘ছয় দফা দাবি’ উত্থাপন করে তা বিষয়সূচিতে অন্তর্ভূক্ত করার প্রস্তাব করেন। কিন্তু সভার সভাপতি চৌধুরী মোহাম্মদ আলী ‘ছয় দফা দাবি’ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনায় অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করলে ফেব্রুয়ারির ১১ তারিখ বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে ঢাকা বিমানবন্দরে সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেন এবং ২০ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে ‘ছয় দফা’ দলীয় কর্মসূচি হিসেবে গ্রহণ করা হয়।

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত