নিভৃতচারী ছোট আপা

2904

Published on সেপ্টেম্বর 14, 2020
  • Details Image
ডা. নুজহাত চৌধুরীঃ
 
১৯৭৫ সালের মধ্যভাগে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ রেহানা যখন গিয়েছিলেন বড় বোন শেখ হাসিনার কাছে জার্মানিতে, দেশে রেখে গিয়েছিলেন পিতামাতা, ছোট্ট রাসেলসহ মায়াভরা এক পরিবার। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভয়াল রাতে ঘাতকরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুসহ তার গোটা পরিবারকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে। বাবাকে হারিয়ে হঠাৎ করে কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হলেন বঙ্গবন্ধুর ছোট্ট মেয়েটি। সেই বয়সে দেখলেন চেনা মুখগুলো হঠাৎ করে কীভাবে পরিবর্তিত হয়ে নিষ্ঠুর ও অচেনা হয়ে উঠেছে। কী আদরে, কী মায়ায়, কী সাধারণের মাঝে এক অসাধারণ পরিবারে বড় হয়ে ওঠা বোন দুটি হঠাৎ করে হয়ে পড়লেন নিঃসঙ্গ-অসহায়। সেই কিশোর বয়সের এই নির্মম আঘাত ও বিশ্বাসঘাতকতা তার মনোজগতে কী ব্যাপক ঝড় তুলেছিল তা হয়তো আমরা কেউ অনুধাবন করতে পারব না।
 
এরপর নামহীন-পরিচয়হীন দীর্ঘ শরণার্থী জীবন ভারতে; তারপর চলে গেলেন লন্ডনে নিজের জীবন গড়ার দৃঢ়প্রত্যয়ে। আর সর্বক্ষণ অন্তরে ছিল পিতৃহত্যার বিচার করার প্রতিজ্ঞা। সেই যাত্রা ছিল কণ্টকাকীর্ণ। অচেনা শহরে বন্ধুহীন শত্রুবেষ্টিত নিঃসঙ্গ মেয়েটি ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন; কারও সহায়তায় নয়, শুধু নিজ মনোবলকে সম্বল করে। আজও লন্ডনে চাকরি করেন, টিউবে করে অফিসে যান। আজও অযাচিত কোনো সাহায্য প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি আজ পেরিয়ে এসেছেন জীবনের অনেকটা পথ। সেই মেয়েটি আর তার বড় বোন শুধু নিজেরাই ঘুরে দাঁড়াননি, করেছেন পিতৃহত্যার বিচার এবং বঙ্গবন্ধুকে হারানো অভিভাবকহীন বাংলাদেশকেও টেনে নিয়ে চলেছেন সোনার বাংলার পথে। সম্মুখে সব ভার বইয়ে চলা বোন শেখ হাসিনার পেছনে শক্ত খুঁটি হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন ছোট বোন শেখ রেহানা।
 
বাবা হারানোর নিষ্ঠুরতা ও পরবর্তী জীবনযুদ্ধ তাদের দুই বোনকে জীবনকে নির্মোহভাবে দেখতে শিখিয়েছে। শিখিয়েছে এই বাস্তবতা- জীবন পাল্টে যেতে পারে যে কোনো সময়। তাই তারা নির্মোহ-নির্লোভ, কিন্তু সাহসী ও আত্মপ্রত্যয়ী। বুকের কষ্ট চেপে রেখে দৃঢ়তার সঙ্গে যে কোনো সংকট মোকাবিলা করেন অবিচল চিত্তে। তাই আজ আসতে পেরেছেন বহুদূর। আজ বঙ্গবন্ধুর বড় কন্যা শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী আর বঙ্গবন্ধুর সেই ছোট্ট কিশোরী মেয়েটির কন্যা যুক্তরাজ্যের আইনপ্রণেতা। বঙ্গবন্ধুর রক্তের বাহক এবং বঙ্গমাতার সুশিক্ষায় শিক্ষিত কন্যা দুটি সেই একই সুশিক্ষায় গড়ে তুলেছেন পরবর্তী প্রজন্মকেও। বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যার ইস্পাতকঠিন দৃঢ় মনোবল আমাকে সত্যিই অভিভূত করে। অভিভূত করে তাদের সাহস, জীবন ও মানুষ সম্পর্কে নির্মোহ-স্বচ্ছ অন্তর্দৃষ্টি।
 
ছোট আপা নিজের কষ্টের কথা, নিজের অনেক ক্ষত উন্মোচন করেন মাঝে মধ্যে খুব সাধারণভাবে সাধারণ উচ্চারণে। কিন্তু চোখ দেখে বোঝা যায় ক্ষতের গভীরতা। তিনি পেয়েছেন বাবার সেই বিখ্যাত স্মৃতিশক্তি। ভোলেন না প্রায় কিছুই। আর সেটাই মাঝে মাঝে মনোকষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। মনে আছে সব বিশ্বাসঘাতকতা, তাই চিনতে পারেন মুখোশের আড়ালে ঢাকা মানুষের মুখ। আর এই স্মৃতিশক্তিই তাকে অতীত থেকে শিক্ষা নিতে শেখায়। গানের গলা খুব মিষ্টি, কিন্তু কখনোই প্রকাশ করেন না। এই প্রথম অবাক দৃষ্টিতে দেখলাম এ বছর ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে জনসমক্ষে গাইলেন সবার সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে।
 
সংগীতানুরাগী, সাহিত্যপ্রেমী ছোট আপা অনেক গান শোনেন এবং গুনগুন করে গেয়ে ওঠেন সেই গান প্রায়শই। তিনি প্রচুর বই পড়েন, বই পড়তে ভালোবাসেন। পড়ার এই আগ্রহ ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন পরবর্তী প্রজন্মেও।
 
যারা বঙ্গমাতাকে চিনতেন, তারা জানেন ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ির দরজা ছিল সবার জন্য উন্মুক্ত। বঙ্গমাতার আতিথেয়তা থেকে কেউ বঞ্চিত হতেন না। এই সহজাত আতিথেয়তা ও মাতৃরূপ আছে ছোট আপার ভেতরেও। আদর, মায়া ও ভালোবাসায় জড়িয়ে রাখতে পারেন প্রগাঢ়ভাবে। নিজে বহুকাল অনিরাপদ জীবনযাপন করার কারণে কাছের মানুষের নিরাপত্তা নিয়ে ভাবেন সর্বক্ষণ।
 
খুব নিভৃতচারী এ মানুষটির অনেক অবদান রয়েছে এদেশের অর্জনে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারকাজের সূচনার সঙ্গে তিনি ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। প্রবাসে বসে সেই আন্দোলন গড়ে তোলার পেছনে ছিলেন মূল চালিকাশক্তি। আজও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শক্তি ও সাহস জোগান ছোট বোন শেখ রেহানা। এ কথা নির্দি্বধায় স্বীকার করেন প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং। আড়ালে থাকার কারণে তার ভালোবাসা আর মমতার প্রকৃত ব্যাপ্তি হয়তো দেশবাসী অনুধাবন করেনি সম্যকভাবে, কিন্তু কাছে থেকে যারা তাকে দেখেছেন তারা জানেন- কী এক দেশপ্রেমিক, প্রগতিশীল হৃদয় ও মনন তিনি ধারণ করেন।
 
ছোট আপার দেশপ্রেম, দেশের মানুষের মঙ্গল আকাঙ্ক্ষা, সংস্কৃতিমনা উদার হৃদয় আমাদের মনে শ্রদ্ধার উদ্রেক করে। তার জন্মদিনে তাকে জানাই অভিবাদন। এই নিভৃতচারী, আত্মপ্রত্যয়ী, দেশপ্রেমিক, মাতৃমূর্তির স্নেহধন্য হয়ে তাকে জানাতে চাই অপার ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা।
 
 
লেখকঃ চিকিৎসক; শহীদ বুদ্ধিজীবী আলীম চৌধুরীর কন্যা

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত