শেখ মুজিবকে গোয়েন্দারা কীভাবে অনুসরণ করত

7688

Published on সেপ্টেম্বর 17, 2020
  • Details Image

অজয় দাশগুপ্ত:

ঢাকার গোয়েন্দা অফিস। অনেক শীর্ষ কর্মকর্তা উপস্থিত। পশ্চিম পাকিস্তানের গোয়েন্দারাও রয়েছে।

এক পশ্চিম পাকিস্তানি অফিসারঃ পূর্ব পাকিস্তানে নির্বাচন আয়োজনের জন্য সরকারের ওপর চাপ বাড়ছে। ১৯৪৬ সালে নির্বাচন হয়েছে। তারপর ৬ বছর চলে গেছে। এখন নির্বাচন দেওয়া হলে মুসলিম লীগ কি জয়ী হয়ে আসতে পারবে?

এক বাঙালি গোয়েন্দাঃ মুসলিম লীগের অবস্থা শোচনীয় স্যার। তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম নাই। জনসাধারণ বিমুখ। নেতারা ব্যবসা-পারমিট নিয়ে ব্যস্ত।

পশ্চিম পাকিস্তানি অফিসারঃ স্টপ ননসেন্স।

বাঙালি আরেক অফিসারঃ কয়েকদিন আগে বগুড়ায় একজন মন্ত্রীকে আওয়ামী লীগ কালোপতাকা দেখিয়ে সভা করতে দেয়নি। তিনি পালিয়ে প্রাণে বেঁচেছেন।

পশ্চিম পাকিস্তানি অফিসারঃ আপনারা কী করেছেন? ভাসানী জেলে। আরও অনেকে জেলে। একা মুজিব বাইরে। তিনি কী করতে পারেন? দরকার হলে সব জেল ভরে ফেলতে হবে।

বাঙালি আরেক অফিসারঃ পাকিস্তানের সাড়ে পাঁচ বছরের মধ্যে শেখ মুজিবকে প্রায় তিন বছর জেলে রাখা হয়েছে। সর্বক্ষণ তার ওপর নজরদারি চলছে। আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক তিনি। সিনিয়র-জুনিয়র সবাই চলে তার কথায়।

আরেক অফিসারঃ দিন দিন তিনি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছেন। তাকে অবিলম্বে অ্যারেস্ট করা দরকার।

পশ্চিম পাকিস্তানি অফিসারঃ ৩৩ বছর বয়স মাত্র। তিনি কী করতে পারেন?

বাঙালি অফিসারঃ শুনবেন তার কাজের ফিরিস্তি?

পশ্চিম পাকিস্তানি অফিসারঃ বলুন।

বাঙালি অফিসারঃ একটি দিনের গোয়েন্দা রিপোর্ট শুনুন স্যার। আমাদের কয়েকজন বিশ্বস্ত, চৌকশ কর্মী এই একটি লোকের পেছনে ছুটছে। ২৬ ফেব্রুয়ারি, রাত ১০ টায় শেখ মুজিব বাসা থেকে বের হয়ে রিকশায় আওয়ামী লীগ অফিসে যান। সেখান থেকে কিছু কাগজপত্র নিয়ে একই রিকশায় বাসায় আসেন।

পশ্চিম পাকিস্তানিঃ এত রাতে রাজনৈতিক দলের অফিসে কাউকে পাওয়া যায়?

অফিসারঃ তিনি প্রতিদিন দুই বেলা অফিস করেন। মধ্য রাত পর্যন্ত অনেক সময় থাকেন। ওই রাতে অফিস থেকে একই রিকশায় বাসায় এসে কাজী গোলাম মাহবুবকে নিয়ে ভিক্টোরিয়া পার্ক বাস স্ট্যান্ডে যান।

পশ্চিম পাকিস্তানিঃ রিকশায় চলাচল করেন শেখ মুজিব?

গোয়েন্দাঃ হ্যাঁ, রিকশা, বাস, নৌকা- এ সবই তার যানবাহন। হাঁটেনও প্রচুর।

পশ্চিম পাকিস্তানিঃ গাড়ি নেই?

গোয়েন্দাঃ না। বাবা ও বউয়ের কাছ থেকে কিছু টাকা আনেন। থাকেন একা, ছোট বাসায়। এর আগে অনেক দিন মেসে ছিলেন।

আরেক গোয়েন্দাঃ ওই রাতে বাসে চেপে যান নারায়ণগঞ্জ। সেখানে দলের কয়েকজন কর্মীর সঙ্গে কথা বলেন। তাদের সঙ্গে হোটেলে খাওয়া-দাওয়া করে রাত দেড়টায় বরিশালগামী স্টিমারে ওঠেন। স্টিমারেও আমাদের ওয়াচ পার্টি ছিল। অনেক লোক তাকে চেনে। তাদের সঙ্গে রাজনীতি নিয়ে আলাপ করে। তিনি নিশ্চিত, নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ জয়ী হবে।

আরেক গোয়েন্দাঃ পরদিন সকালেও চলে রাজনৈতিক আলোচনা। দুপুরে শেখ মুজিব বরিশাল পৌঁছে রিকশায় ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বাসায় যান। সেখানে জেলা আওয়ামী লীগ নেতারা আসেন। তাদের সঙ্গে আলোচনা করেন। রাত সাড়ে বারোটায় একা রিকশায় লঞ্চঘাটে যান। বাকি রাত খুলনাগামী একটি লঞ্চে ঘুমিয়ে কাটান। আমাদের ওয়াচ পার্টিও লঞ্চে ছিল।

পশ্চিম পাকিস্তানি অফিসারঃ ভয় নেই তার?

গোয়েন্দাঃ এমন নির্ভিক কেউ আছে বলে আমাদের জানা নেই। খুব ভোরে লঞ্চটি ছেড়ে যায়। তিনি পথে অনেকের সঙ্গে কথা বলেন। অচেনা লোকও অল্প সময়ের মধ্যে আপন হয়ে যায় তার। দুপুরের দিকে ঘোপেরডাঙ্গা নেমে পায়ে হেঁটে টুঙ্গিপাড়া বাড়ি পৌছান। এই পথে তাঁর সঙ্গে অনেক লোক হেঁটে যায়।

আরেক গোয়েন্দাঃ আমাদের ওয়াচম্যান কয়েক মাইল দূরে গোপালগঞ্জ শহরে গিয়ে ডিবি অফিসে শেখ মুজিবের বাড়িতে আসার খবর দেয়। সেখান থেকে একজন ওয়াচার ভোর সাড়ে চারটায় তার বাড়িতে পৌঁছায়।

পশ্চিম পাকিস্তানি অফিসারঃ তারপর?

গোয়েন্দাঃ আমরা এসে শুনতে পাই, বাড়িতে কয়েক ঘণ্টা থেকেই তিনি গোপালগঞ্জ শহরে চলে গেছেন। অথচ জানেন স্যার, তার ৬ ও ৪ বছর বয়সের দুটি ছেলেমেয়ে রয়েছে। স্ত্রীর আবার সন্তান হবে, দুই-তিন মাসের মধ্যে।

আরেক গোয়েন্দাঃ শেখ মুজিব গোপালগঞ্জে দলের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে রাতেই রওনা দেন এবং খুব ভোরে টুঙ্গিপাড়া বাড়িতে ফিরে আসেন। সেখানে দুই দিন থাকেন। অনেকের সঙ্গে কথা বলেন। পারিবারিক কাজ করেন।

আরেক গোয়েন্দাঃ ৪ঠা মার্চ কবি ইসমাইল নামের এক ব্যক্তিকে নিয়ে তিনি নৌকায় গোপালগঞ্জ শহরে যান। এই লোক বিভিন্ন জনসভায় আওয়ামী লীগের গুণগান করে গায় গায়, কবিতা লেখে। গোপালগঞ্জের টাউন ময়দানে বিকেলে শেখ মুজিব জনসভা করেন। কাজী গোলাম মাহবুব ও আবদুল ওয়াদুদ পাটোয়ারিও শেখ মুজিবের সঙ্গে বক্তব্য রাখেন।

পশ্চিম পাকিস্তানিঃ বিশ্রাম নেন কখন?

গোয়েন্দাঃ বাকিটা শুনুন স্যার। ওই রাতেই তিনি নৌকায় টুঙ্গিপাড়ার বাড়িতে রওনা দেন। সেখানে পৌছান সকালে। পরদিন বরিশালগামী স্টিমারে ওঠেন ঘোপেরডাঙ্গা থেকে। ৮ মার্চ বরিশাল পৌঁছান সকাল ৬ টায়। রিকশায় যান ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বাসায়। এর মধ্যেই কয়েকজন দলীয় কর্মী সেখানে হাজির। ঘণ্টা খানেক থেকে ফের রিকশায় এসে ঢাকাগামী স্টিমারে ওঠেন। সকাল সাড়ে ৯টায় স্টিমার ছাড়ে। আমাদের ওয়াচার নজর রেখেছে। দিনের বেলা অনেক চেনা-অচেনা লোক তার সঙ্গে নানা বিষয় আলোচনা করে।

আরেক গোয়েন্দাঃ নারায়ণগঞ্জে স্টিমার পৌঁছে প্রায় পৌনে নয়টায়। কী করে স্থানীয় নেতারা খবর পায়, জানি না। কয়েকজন দলীয় নেতা তাকে স্বাগত জানায় এবং ভিক্টোরিয়া পার্কগামী বাসে তুলে দেয়। বাস থেকে নেমে রিকশায় বাসায় যান।

পশ্চিম পাকিস্তানি অফিসারঃ এই বিবরণ অবিশ্বাস্য। আমি সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টকে এটা বিশ্বাস করাতে পারব না।

বাঙালি গোয়েন্দাঃ এটাই রিয়ালিটি। এই জীবনই তার নিয়মিত জীবন। বাইরে যখন থাকেন এভাবেই কাজ করেন। এখন আপনারা সিদ্ধান্ত নেন, কখন অ্যারেস্ট করবেন।

আরেক গোয়েন্দাঃ ৮ মার্চ ঢাকায় ফিরে পরদিন সকালে তিনি আওয়ামী লীগ অফিসে গেছেন। বিকেলে আবার গেছেন। ১১ মার্চ দুটি বড় কর্মসূচি ছিল, রাশিয়ার নেতা স্ট্যালিনের মৃত্যুতে আরমানিটোলা ময়দানে স্মরণসভা এবং সন্ধ্যায় বার লাইব্রেরিতে সর্বদলী রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন পরিষদের প্রতিনিধি সভা। এ কর্মসূচি সফল করার কাজ তাকেই করতে হয়। বাড়ি যাবার আগে ঢাকায় ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবসের কর্মসূচি সফল করার প্রধান দায়িত্বও তিনি পালন করেছেন।

পশ্চিম পাকিস্তানিঃ শেখ মুজিবকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়, সেটা নিয়ে সবাই ভাবুন। আপনাদের কিছু একটা করতেই হবে।

সূত্র : সিক্রেট ডকুমেন্টস অব ইন্টালিজেন্স ব্রাঞ্চ অন ফাদার অব দি ন্যাশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তৃতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ১২৬-১২৭

 

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত