গণআন্দোলন এক দফায় রূপান্তরের দিন

1803

Published on ফেব্রুয়ারি 9, 2021
  • Details Image

তোফায়েল আহমেদ:

মহান ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত মাস ফেব্রুয়ারি শুরু হয়েছে। গুরুতর অসুস্থ আমার স্ত্রী আনোয়ারা আহমেদের চিকিৎসার কারণে বেশ কয়েকদিন যাবত ভারতের রাজধানী দিল্লির ম্যাডেন্টা হাসপাতালে রয়েছি। তবু মন আমার পড়ে আছে প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশে। যখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বিশ্বে মর্যাদাশালী ও উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত হয়েছে, যখন দেশের মানুষ উন্নয়নের সুফল পাচ্ছেন, ঠিক তখনই দেশবিরোধী-গণবিরোধী কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠী আলজাজিরা প্রচারমাধ্যমের সাহায্যে মেতে উঠেছে এক নতুন ষড়যন্ত্র-চক্রান্তে। বাংলার মানুষ অতীতের মতো এবারও এসব ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের দাঁতভাঙা জবাব দেবে। এসব মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে আমরা আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

'৫২-এর মহান ভাষা আন্দোলনে বাংলার সংগ্রামী ছাত্রসমাজ রাজপথে বুকের রক্ত ঢেলে মাতৃভাষা বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করে। আর '৬৯-এর জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে সংগ্রামী ছাত্র-জনতা দেশব্যাপী তুমুল গণআন্দোলন সংঘটিত করে দেশের মানুষের রাজনৈতিক অধিকার 'ভোটাধিকার' অর্জন এবং সকল রাজবন্দিসহ প্রিয়নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে কারামুক্ত করে। সত্যিকার অর্থেই '৫২-এর রক্তধারা '৬৯-এর রক্তস্রোতে মিশে '৭১ সালে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের উন্মেষ ঘটায়। বাঙালির জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে এ এক ঐতিহাসিক পরম্পরা। '৬৯-এর ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগের ২১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের 'ডাকসু' কার্যালয়ে চার ছাত্র সংগঠনের নেতৃত্বে আমার সভাপতিত্বে সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়। আমি-ডাকসুর ভিপি হিসেবে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সমন্বয়ক ও মুখপাত্রের দায়িত্ব পালন করি। দশজন ছাত্রনেতার উপস্থিতিতে এক সংবাদ সম্মেলনে ছাত্রদের ঐক্যবদ্ধ প্ল্যাটফর্ম 'কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ' গঠন করে ছয় দফা দাবি আদায়ে এবং বঙ্গবন্ধুকে কারামুক্ত করতে ছয় দফাকে দাঁড়ি, কমা, সেমিকোলন সমেত ১১ দফার ৩ নম্বর দফায় অন্তর্ভুক্ত করে ঐতিহাসিক ১১ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করি।

১১ দফার প্রতি ছাত্র-শ্রমিক-কৃষক-পেশাজীবী-বুদ্ধিজীবীসহ বাংলার সর্বস্তরের মানুষের সমর্থন আদায় করতে পেরেছিলাম দেশের সর্বত্র সর্বব্যাপী গণবিক্ষোভ এমন ছিল যে, স্বৈরশাসক ভীত হয়ে ২৫, ২৬ ও ২৭ জানুয়ারি সান্ধ্য আইন বলবৎ রাখে। ২৭ জানুয়ারি ঢাকায় গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে দেশের সর্বত্র গণবিক্ষোভ অব্যাহত থাকে। ১ ফেব্রুয়ারি আইয়ুব খান বেতার ভাষণে রাজনৈতিক সমাঝোতার কথা বলেন। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে কারাগারে রেখে এবং ১১ দফা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত কোনো সমঝোতা হবে না পরিস্কার জানিয়ে দিয়ে আমরা আইয়ুব খানের বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করি। ৬ ফেব্রুয়ারি আইয়ুব খান পূর্ব পাকিস্তান সফরে আসেন এবং এক সংবাদ সম্মেলনে দেশরক্ষা আইন ও অর্ডিন্যান্সের প্রয়োগ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। '৬৯-এর ২৫ মার্চ আইয়ুব খান পদত্যাগ করলে ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা গ্রহণ করে এলএফও (লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার) জারি করে এবং 'প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকার' প্রদান ও পার্লামেন্ট নির্বাচনের ঘোষণা প্রদান করে। '৬৯-এর গণআন্দোলনে শহীদ আসাদ, মতিউর, মকবুল, রুস্তম, আলমগীর, সার্জেন্ট জহুরুল হক, ড. শামসুজ্জোহাসহ সব শহীদের রক্তের শপথ নিয়ে বলেছিলাম, 'এই রক্ত আমরা বৃথা যেতে দেবো না।' শহীদের আত্মদান বৃথা যায়নি। পরবর্তী ইতিহাস তা প্রমাণ করেছে। 

৯ ফেব্রুয়ারি এক ঐতিহাসিক দিন এবং এদিনেই গণআন্দোলন এক দফায় রূপান্তরিত হয়। এদিন পল্টনে আমার জীবনের প্রথম জনসভা। পল্টন ময়দানে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে 'শপথ দিবস' পালিত হয়। এদিনেই সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের দশজন ছাত্রনেতা লাখ লাখ মানুষের সামনে 'জীবনের বিনিময়ে ১১ দফা দাবি আদায়ের শপথ গ্রহণ' করে। জনসভা তো নয় যেন বিশাল এক গণমহাসমুদ্র! সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সমন্বয়ক এবং সভার সভাপতি হিসেবে পিনপতন নীরবতার মধ্যে একটানা ৪৫ মিনিট বক্তৃতা করি। সেদিনের বক্তৃতায় যা বলেছিলাম, পরদিন ১০ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত দৈনিক ইত্তেফাকের পাতা থেকে তার কিয়দংশ আজ পাঠকদের জন্য তুলে দিচ্ছি, "প্রেসিডেন্টের প্রস্তাবিত আলোচনা বৈঠকের ক্ষেত্র প্রস্তুতের জন্য ছাত্র-জনতার কতিপয় দাবি আদায়ে দেশে স্বাভাবিক অবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের আহ্বান জানাই। ছাত্র-জনতার সম্মিলিত আন্দোলনের মাধ্যমে জনগণের পত্রিকা 'ইত্তেফাক'কে আমরা ছিনিয়ে এনেছি। দেশরক্ষা আইনের প্রয়োগ বন্ধ করেছি। মোজাফ্‌ফর, আলতাফ প্রমুখ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে কারাগার হতে মুক্ত করেছি। অপরাপর রাজবন্দিদেরকেও আমরা মুক্ত করবো। এ দেশের যে প্রিয় নেতা জন্মের পর হতে বাংলার মানুষের জন্য সংগ্রাম করেছেন, জেল-জুলুম নির্যাতন সহ্য করেছেন, সেই জনাব শেখ মুজিবুর রহমানকে অবিলম্বে মুক্তি দিতে হবে। ছাত্র-জনতার দাবি-দাওয়া যদি পূরণ না করা হয়, শেখ মুজিবসহ সকল রাজবন্দির যদি মুক্তি দেওয়া না হয়, তাহলে বাংলার ঘরে ঘরে প্রচণ্ড বিস্টেম্ফারণ ঘটবে। সমগ্র পাকিস্তানে জনসংখ্যার শতকরা ৫৬ জন বাঙালি। অতএব, আমাদের বিচ্ছিন্ন হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না...।' বক্তৃতার শেষে সমবেত জনতার তুমুল গর্জনের সঙ্গে বজ্রকণ্ঠে স্লোগান তুলি- 'শপথ নিলাম শপথ নিলাম মুজিব তোমায় মুক্ত করবো; শপথ নিলাম শপথ নিলাম মাগো তোমায় মুক্ত করবো।' ভাবতে আজ কত ভালো লাগে ঐতিহাসিক শপথ দিবসের এই স্লোগানের দুটি লক্ষ্যই সংগ্রাম ও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জন করেছি।

সোনার বাংলার ৩৯ জন সোনার সন্তানের প্রাণের বিনিময়ে '৬৯-এর ২২ ফেব্রুয়ারি প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে মুক্ত করে, '৭০-এর ঐতিহাসিক নির্বাচনে ছয় দফা ও ১১ দফার পক্ষে গণরায় নিয়ে, '৭১-এর মহত্তর মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লক্ষাধিক মানুষের সুমহান আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে ১৬ ডিসেম্বর প্রিয় মাতৃভূমিকে হানাদারমুক্ত করে সেদিনের সেই শপথবাক্য আমরা অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়ন করেছি। এরপর ১৪ ফেব্রুয়ারি 'ডাক'-এর (ডেমোক্রেটিক অ্যাকশন কমিটি) আহ্বানে অর্ধদিবস হরতাল পালন ও পল্টনের জনসভায় জনতার দাবির মুখে প্রিয় নেতার ছবি বুকে ঝুলিয়ে বক্তৃতা করি। সেদিনের জনসভায় সংগ্রামী জনতাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, 'আপনারা কি প্রিয় নেতা শেখ মুজিব ছাড়া গোলটেবিল বৈঠক চান? আপনারা কি প্রিয় নেতা শেখ মুজিবের প্যারোলে মুক্তি চান?' জনতা সমস্বরে বলেছিল, 'না, চাই না।' তখন বঙ্গবন্ধুর প্যারোলে মুক্তির কথা প্রচার করা হয়েছিল। এ ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুর প্রিয় সহধর্মিণী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন। '৬৯-এর ২৪ জানুয়ারি সর্বব্যাপী গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গণআন্দোলন সমগ্র জাতিকে উজ্জীবিত করে ৯ ফেব্রুয়ারি এক মোহনায় শামিল করেছিল স্বৈরশাসকের শত উস্কানি সত্ত্বেও আমরা নৈরাজ্যের পথে যাইনি। নিয়মতান্ত্রিকভাবেই আন্দোলন করেছি। আজ সেই সোনালি অতীতের দিকে দৃষ্টিপাত করলে মনে হয় কী করে এটা সম্ভব হলো? তখন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর বিচার চলছে। 'রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য' অর্থাৎ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা বলে যে মামলাকে অভিহিত করা হয়েছিল সেই মামলার বিচার চলছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন ফাঁসির মঞ্চে। আমরা জাগ্রত ছাত্রসমাজ শুধু ঐক্যবদ্ধ হইনি, গোটা জাতিকে আমরা ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিলাম।

১৫ ফেব্রুয়ারির প্রথম প্রহরে রাতের বেলা সার্জেন্ট জহুরুল হককে হত্যা করে আবার কারফিউ জারি করা হয়, ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. শামসুজ্জোহাকে- যিনি নিজের বুক পেতে দিয়ে বলেছিলেন, 'আমার ছাত্রদের গুলি করার আগে আমার বুকে গুলি চালাতে হবে'; তখনই তার বুকে প্রথমে গুলি পরে বেয়নেট চালিয়ে তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল। যার প্রতিবাদে সমগ্র দেশ গণজাগরণ-গণবিস্টেম্ফারণে কেঁপে ওঠে এবং অমর একুশে ফেব্রুয়ারির ঐতিহাসিক দিনে পল্টন ময়দানে লাখ লাখ লোকের সামনে যখন প্রিয় নেতা শেখ মুজিবকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নিঃশর্ত মুক্তিদানের আলটিমেটাম দিয়েছিলাম, যার পরিপ্রেক্ষিতে ২২ ফেব্রুয়ারি প্রিয় নেতাকে মুক্তি দিতে স্বৈরশাসক বাধ্য হয়েছিল। তেইশে ফেব্রুয়ারি তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে আজকের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ১০ লক্ষাধিক লোকের উপস্থিতিতে গণসংবর্ধনায় কৃতজ্ঞ বাঙালি জাতি কৃতজ্ঞ চিত্তে প্রিয় নেতাকে 'বঙ্গবন্ধু' উপাধিতে ভূষিত করেছিল। ৯ ফেব্রুয়ারি আন্দোলন আর ১১ দফার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। সেদিন আন্দোলন এক দফায় চলে যায়। প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে মুক্ত করেই আমরা ঘরে ফিরেছি।

প্রতি বছর এই দিনগুলো জাতীয় জীবনে ফিরে আসে। আনন্দের বিষয় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিটি মিটিংয়ে আমি তার সফরসঙ্গী হিসেবে যেতাম। যখন বক্তৃতা করতেন- সেই '৫২-এর মহান ভাষা আন্দোলন, আইয়ুববিরোধী আন্দোলন, '৬৬-এর ছয় দফা আন্দোলন, '৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের কথাগুলো বলতেন। ঐতিহাসিক ৭ মার্চের বক্তৃতায়ও তিনি '৬৯-সালের গণঅভ্যুত্থানের কথা উল্লেখ করেছেন। আমার লাইব্রেরি রুমে বসে যখন '৬৯ সালের সেই দিনগুলোর ছবি ও পত্রিকার পাতা জুড়ে প্রতিবেদনগুলো দেখি, তখন আনন্দে বুক ভরে যায় এই ভেবে যে, একদিন আমরা গৌরবোজ্জ্বল এই দিনগুলো সৃষ্টি করেছিলাম।

লেখকঃ আওয়ামী লীগ নেতা; সংসদ সদস্য; সভাপতি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি, জাতীয় সংসদ।

সৌজন্যেঃ দৈনিক সমকাল

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত