গ্রামোন্নয়ন ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে জননেত্রীর পথ চলা

1919

Published on ফেব্রুয়ারি 3, 2022
  • Details Image

সজল চৌধুরীঃ

বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নের দিকেই এগিয়ে চলছেন। তিনি বাংলাদেশের গ্রাম উন্নয়নের জন্য সুদূর প্রসারী একটি পরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন। বাংলাদেশের জনসংখ্যা ঘনত্ব অত্যন্ত উচ্চ পর্যায়ে। তাছাড়া গ্রামগুলোর দূরত্ব শহর থেকে খুব বেশি নয়। তাই শহর উন্নয়নের পাশাপাশি যদি গ্রাম ভিত্তিক উন্নয়ন সম্ভব হয় তাহলে মানুষ হয়তো গ্রাম ছেড়ে আর শহরে যাবে না। কারণ শুধুমাত্র নগরকেন্দ্রিক উন্নয়নের সুফল এর পাশাপাশি অনেক ধরনের নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে। সেই নেতিবাচক প্রভাব গুলোর সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিফলন রয়েছে। এই শহর কেন্দ্রিক স্বল্প দূরত্বে থাকা বাংলাদেশের গ্রামগুলোর যদি সুষম উন্নয়ন হয় তাহলে একদিকে যেমন বাংলাদেশের অর্থনীতির ক্ষেত্রে তার একটি ইতিবাচক প্রভাব পড়বে ঠিক তেমনি শহরের পাশাপাশি এই গ্রাম গুলো শক্তিশালী অর্থনৈতিক মানদণ্ড হিসেবে কাজ করবে।

১৯৭৫ সালের ২৬ শে মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে আয়োজিত একটি জনসভায় বঙ্গবন্ধু একটি গ্রামের ধারণা দেন। যার নাম সমবায় গ্রাম। তিনি উক্ত জনসভায় পাঁচ বছরের জন্য গ্রামভিত্তিক একটি পরিকল্পনা করেন। প্রত্যেকটি গ্রামের জন্য যাকে কো-অপারেটিভ কিংবা সমবায় ভিত্তিক গ্রামোন্নয়ন বলা হয়ে থাকে। তিনি আশা প্রকাশ করেন বাংলাদেশে ৬৪ হাজার গ্রাম কো-অপারেটিভ হবে। যেখানে গ্রামের যে মানুষগুলো কাজ করতে পারে সেই মানুষগুলোকে সেই কো-অপারেটিভ এর সদস্য হতে হবে। এভাবে তিনি বহুমুখী কো-অপারেটিভ গ্রামের ধারণা প্রদান করেন। তিনি এই বিষয়টিও সকলের সামনে পরিষ্কার করেন জমির মালিকানাতে কোন মালিকের সমস্যা হবে না। অর্থাৎ জমি মালিকেরই থাকবে। এমনকি যার জমি সেই জমির ফসল পাবে। কিন্তু ফসলের অংশ সবাই পাবে। সেই অংশ যাবে কো-অপারেটিভের হাতে। অংশ যাবে সরকারের হাতে। একজন কৃষক যেন তার কাজের সর্বোচ্চ মূল্য পায় সে দিক দিয়ে তিনি ছিলেন সোচ্চার। এই উদ্দেশ্য সাধনের লক্ষ্যে তিনি গ্রামকে কো-অপারেটিভ গ্রামোন্নয়নের চিন্তা মাথায় এনেছিলেন। যেখানে সকলকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে বলেছিলেন। কারণ তিনি অনুধাবন করেছিলেন কৃষক বাঁচলে দেশ বাঁচবে। তিনি সমস্ত উৎপাদিত ফসলকে তিন ভাগে বিভক্ত করতে চেয়েছিলেন। তথ্য-উপাত্ত থেকে দেখা যায় এক ভাগ যাবে শ্রমের ভিত্তিতে। এক ভাগ যাবে জমির মালিকানার ভিত্তিতে। আরেক ভাগ যাবে গ্রাম তহবিলে। আর এই তহবিল গ্রাম উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন কর্মকান্ড পরিচালিত করবে এবং বাস্তবায়িত হবে। তার এই ভাবনার সাথে জলবায়ু ও জীব বৈচিত্র সংরক্ষণ এর বিষয়টিও ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল। গ্রামোন্নয়নের এমন ভাবনার মাধ্যমে তিনি গ্রামের সকলকে অন্তর্ভুক্ত করতে চেয়েছিলেন একসাথে। শুধুমাত্র উৎপাদনের সাথেই নয় তাদের বহুমুখী উন্নয়নের জন্য তার এই সমবায়ভিত্তিক গ্রামোন্নয়নের ধারণা ছিল সুদূরপ্রসারী।

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল তার দেশের প্রত্যেকটি মানুষ খাদ্য পাবে, শিক্ষা পাবে, আশ্রয় পাবে, সবথেকে উন্নত জীবনের অধিকারী হবে। আর এই দেশ গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন হাজার ১৯৭২ সালের ৩০শে জুন বাংলাদেশ সমবায় ইউনিয়ন আয়োজিত সমবায় সম্মেলনে। কারণ বঙ্গবন্ধু বাংলার মাটিকে চিনতেন। বাংলার মানুষের ঐতিহ্যকে উপলব্ধি করতেন। বাংলার মানুষের শিকড়কে তিনি চিনতেন নিবিড় ভাবে। তিনি শোষনহীন একটি সমাজ গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন।

তবে এই গ্রাম উন্নয়নের ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম যে বিষয়টি দেখতে হবে সেটি হচ্ছে শহরকেন্দ্রিক নাগরিক জীবনের সুবিধা ও অসুবিধার রুপরেখা গুলো কি কি? শহরের একজন নাগরিক যে সুবিধাগুলো তাদের দৈনন্দিন জীবনে ভোগ করছে সেটি যদি গ্রামের কোন সাধারণ মানুষ তাদের নিজেদের স্থানে থেকেই পায় তাহলে শহরে যাওয়ার প্রবণতা তাদের মধ্যে নেমে আসবে। যেমন যদি শিক্ষার ক্ষেত্রে বলি সাধারণত দেখা যায় শহর গুলোতে শিক্ষার পরিবেশ, স্কুল-কলেজ এর প্রাচুর্যতা গ্রাম অঞ্চল গুলো থেকে অনেক বেশি। আবার যদি স্বাস্থ্যসেবার কথা বলা হয় সেখানেও দেখা যায় গ্রামের স্বাস্থ্য সেবার মান থেকে শহরের স্বাস্থ্যসেবার ফেসিলিটি অনেক বর্ধমান। সে ক্ষেত্রে গ্রামগুলোতেও যদি শিক্ষা, চিকিৎসা, সাংস্কৃতিক সেবা এই উপযোগ গুলো সঠিকভাবে পৌঁছানো যায় তাহলে গ্রামোন্নয়নের যে চিত্র পরিস্ফুটিত হবে সেটি সাধারণ মানুষেরা খুব ভালভাবে উপলব্ধি করতে পারবে। এমনকি গ্রামে বর্তমানে যে আবাসনের ধারা প্রচলিত আছে সেই ধারাগুলোর ক্ষেত্রেও কিছুটা পরিবর্তন আসতে পারে। সেই পরিবর্তনগুলো শহরকেন্দ্রিক নাগরিক জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা গ্রহণ করতে পারি। তাছাড়া বঙ্গবন্ধুর যে কো-অপারেটিভ গ্রামোন্নয়নের চিন্তার দৃষ্টান্ত পরিলক্ষিত হয় সেটিও টেকসই উন্নয়নের জন্য কাজে লাগানো যেতে পারে।

আরেকটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এখন গ্রামগুলো শুধুমাত্র কৃষির উপর নির্ভরশীল নয়। গ্রামগুলোতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ক্ষুদ্র মাঝারি এবং বৃহৎ শিল্পের ব্যবসার প্রসার। তাছাড়া এই গ্রামের মানুষদের মধ্যে আজও তাদের ঐতিহ্যগত কিছু জীবন ধারা রয়েছে। যেই জীবনধারা তাদের আবাসন থেকে শুরু করে দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন উপাদান এর উপর নির্ভরশীল। এমন কি সেখানকার জীব বৈচিত্রের সাথেও মানুষের জীবনধারার একটি সুসম্পর্ক রয়েছে। আর এই পরিবর্তনগুলোর সাথে প্রযুক্তিগত উন্নয়নকে সহাবস্থান করতে পারলেই উন্নয়নের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা সম্ভব। তাছাড়া শহর গুলোতে যেমন সঙ্ঘবদ্ধ আবাসন ব্যবস্থার প্রচলন রয়েছে যাকে আমরা কমিউনিটি বেজড আবাসন প্রকল্প বলে থাকি। যেখানে বসবাসরত একজন নাগরিক সেই কমিউনিটি এর মধ্যে তার চাহিদার বেশিরভাগ প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম। ঠিক তেমনি যদি গ্রামগুলোতেও সেই ধরনের কমিউনিটি বেজড আবাসন এর ধারণা প্রদান করা হয় কিংবা বাস্তবায়ন করা হয় হয়তোবা গ্রামের মানুষেরা সেখান থেকে সুফল পাবে।

বর্তমানে আমরা আমাদের শহর ও গ্রামের টেকসই উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করছি। নতুন পরিকল্পনা করছি। নতুনভাবে নগর এবং শহরের প্রস্তাবনা করছি। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের কথা ভাবছি। কিন্তু যে বিষয়টিকে এখানে গুরুত্বারোপ করছি সেটি হলো আমাদের এই শিল্প বিপ্লবে টেকসই উন্নয়নের ধরন কেমন হবে কিংবা ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে গ্রাম-নগরায়ন-শিল্পায়ন কেমন হবে সেসব বিষয় গুলো যদি বঙ্গবন্ধুর দর্শন থেকে আরও নিবিড় ভাবে নেয়া যেত গবেষণার মাধ্যমে তাহলে হয়তো টেকসই উন্নয়নের আরো একটি ধাপ স্বপ্নের বাংলাদেশ বিনির্মাণে আমরা এগিয়ে নিতে পারতাম। এ সম্পর্কে আরও বিশদ পরিকল্পিত গবেষণার প্রয়োজন অবশ্যই। এ জন্য প্রয়োজন একটি স্বতন্ত্র জাতীয় ‘বঙ্গবন্ধু গ্রাম ও নগর উন্নয়ন গবেষণা কেন্দ্র’ যেখানে শুধুমাত্র বাস্তবায়িত হবে ‘বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ’।

সবশেষে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে এবং সব নাগরিক সুবিধা নিশ্চিতের পাশাপাশি সেখানকার জীব বৈচিত্র সংরক্ষণ এর মাধ্যমে বাংলাদেশের সব গ্রামকে পরিকল্পিত ভাবে সাজাতে সরকার কাজ করে যাচ্ছে। তিনি গ্রামগুলোকে স্বপ্নের মত সুন্দর করে সাজাতে চেয়েছেন। তিনি আরো বলেছেন উন্নয়ন যেন গ্রাম থেকে শুরু হয়। আর এই কথার মাধ্যমেই তিনি ব্যক্ত করেছেন তার সুদূরপ্রসারি ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা। আর তাই আজ আমরা আশাবাদী ভবিষ্যতের একটি সোনার বাংলা দেখার স্বপ্নে।

লেখকঃ শিক্ষক ও স্থপতি

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত