‘অবতারেই’ মুশকিল আসান!

483

Published on অক্টোবর 19, 2023
  • Details Image

অজয় দাশগুপ্তঃ

আশির দশকে ঢাকায় এক আন্তর্জাতিক ফুটবল টুর্নামেন্টের লোগো করা হয়েছিল রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের ছবি ব্যবহার করে। এক ফটোগ্রাফার অভিযোগ করেন, ছবিটি তিনি মিরপুর চিড়িয়াখানায় ঝুঁকি নিয়ে তুলেছিলেন। কিন্তু ফুটবল কর্মকর্তারা ছবি ব্যবহারের জন্য তার অনুমতি নেননি, রয়্যালটিও দেননি।

এ নিয়ে একটি পত্রিকায় আকর্ষণীয় কার্টুন প্রকাশ করা হয়েছিল। কার্টুন চিত্রে দেখা যায়— একটি বাঘ সুন্দরবনে গাছের গুঁড়িতে আয়েশিভঙ্গিতে শুয়ে আছে। পাশে বসা আরেকটি বাঘকে বলছে, ভাগ্নে, শুনেছি ঢাকায় আমাদের ছবি ছাপা নিয়ে তুলকালাম চলছে। সব বাঘকে খবর দে। ঢাকা চল, আমাদের রয়্যালটি নিয়ে আসি।

বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে একের পর এক ‘বিদেশী প্রতিনিধিদের’ আনাগোনা দেখে বাঘের কার্টুনটি মনে পড়ে গেল। ব্যাপক সমাদর ও প্রচার পেলে কে না এক সময়ের ‘বাস্কেট কেস’ নামে অপবাদ দেওয়া দেশটিতে আসতে উৎসাহী হয়। বৈঠকে বসতে পারলেই জীবন ধন্য মনে করা অনেক মানুষ এ দেশে। তারপর আছে ব্যাপক প্রচার।

আমি যখন সাংবাদিকতা শুরু করেছি (৫১ বছর পূর্ণ হয়েছে), সিনিয়রদের কথাও কাজে বুঝে গিয়েছিলাম— ‘বাংলাদেশ নিয়ে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এবং যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন প্রভৃতি দেশ ও সংস্থা যা বলে, তার চেয়ে সত্য ও বস্তুনিষ্ঠ আর কিছু নেই।’ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক নীতি ও কর্মসূচির যত বেশি সমালোচনা হতো, গণমাধ্যমে তত গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ ও প্রচার হতো। প্রতি বছর জাতীয় বাজেট প্রণয়নের আগে ‘সাহায্যদাতারা’ প্যারিসে বৈঠকে বসতেন, যা ‘প্যারিস কনসোর্টিয়াম’ নামে পরিচিত ছিল। সমন্বয়কারী সংস্থা হিসেবে বৈঠকের আগে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশ বিষয়ে একটি কান্ট্রি কনসেপ্ট পেপার তৈরি করত, যেখানে পরবর্তী অর্থ বছরে সরকার কী করবে এবং কী করবে না তার পরামর্শ ও নির্দেশনা থাকত। এ রিপোর্ট যে সব সাংবাদিক প্রথম হাতে পেত, ‘স্কুপ’ বের হয়ে আসত বড় হেডলাইনে। অথচ রিপোর্টটির বড় অংশেই থাকত একটি সার্বভৌম দেশের জন্য অবমাননাকর, আপত্তিজনক মন্তব্য। কিন্তু সাংবাদিকদের অনেকে বাংলাদেশের অহেতুক বদনাম ও সমালোচনায় দোষের কিছু দেখত না।

১৯৯৬ সালের ২৩ জুন শেখ হাসিনা প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে বলেন— বাংলাদেশকে কেউ ‘সাহায্য’ দেয় না। আমরা ঋণ নেই, সময়মতো সুদসহ পরিশোধ করি। ঋণদাতা কী করে ‘সাহায্যদাতা’ হতে পারে? তিনি প্রশ্ন তোলেন, বাংলাদেশ নিয়ে আলোচনার বৈঠক কেন প্যারিসে হবে? তাঁর অবস্থান মেনে নেয় বিশ্বব্যাংক— ১৯৯৮ সালে প্রথমবারের মতো ঢাকার একটি হোটেলে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

পদ্মা সেতুতে অর্থের জোগান নিয়ে বিশ্বব্যাংকের অন্যায় অভিযোগ প্রত্যাখান করে শেখ হাসিনা যে দৃঢ়তা ও দেশপ্রেমের পরিচয় রেখেছেন, তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই।

অথচ এ দেশেই আমরা শুনছি— ‘পিটার হাসকে (বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত) ধন্যবাদ জানাই। আমাদের জন্য তিনি অবতার হয়ে এসেছেন। উনাকে আরও সাহস দেওয়া দরকার। বাবারে বাঁচা, রক্ষা করো।’ যে আলোচনায় ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা নস্যাতের জন্য সপ্তম নৌবহর পাঠানো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঢাকাস্থ রাষ্ট্রদূতকে বিএনপির একজন শীর্ষনেতা ‘বাবা’ ও অবতার’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। ‘বাংলাদেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে দেশীয়-আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকা এবং আমাদের করণীয়’ শীর্ষক বিএনপি আয়োজিত ১৬ অক্টোবরের ওই সেমিনারের খবর প্রায় গণমাধ্যমেই এসেছে। সেখানে উপস্থিত ছিলেন মির্জা ফখরুল ইসলাম। তিনি বলেছেন— ‘পশ্চিমা বিশ্ব বাংলাদেশে গণতন্ত্রের পক্ষে কমিটেড’।

অথচ এই পশ্চিমা বিশ্বের মোড়ল হিসেবে পরিচিত যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমলে বার বার সামরিক শাসনকে উৎসাহ ও মদদ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এ জংলি শাসনকালে মানবাধিকার পদদলিত হয়, রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকে, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণ করা হয়। শাসকরা স্বেচ্ছাচারিতার চরমে ওঠে। বাংলাদেশের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা ১৯৭২ সালে যে সংবিধান প্রণয়ন করেছিলেন, তাতে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি ছিল গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ। সামরিক উর্দি পরা জিয়াউর রহমান অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে বিচারপতি আবু সাদত মোহাম্মদ সায়েমকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও রাষ্ট্রপতির পদ ছেড়ে দিতে বাধ্য করার পর উভয় পদ দখল করে একক ক্ষমতাবলে এই সংবিধান থেকে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ বাদ দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত খন্দকার মোশতাক আহমদ ১৫ অগাস্টের নিষ্ঠুর ঘাতকদের বিচার করা যাবে না— এই ব্যবস্থা রেখে যে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করেছিলেন, তা আইন হিসেবে অনুমোদন দিয়েছিল জিয়াউর রহমানের একক ক্ষমতাবলে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল বিএনপি। ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর প্রতিষ্ঠিত দলটি কোন জাদুবলে মাত্র সাড়ে পাঁচ মাস পর অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দুই তৃতীয়াংশের বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল, সেটা নিয়ে এখনও গবেষণা হতে পারে। জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যায় (যারা প্রকাশ্যেই বলেছিল—আমরা মুজিবকে হত্যা করেছি, সাহস থাকলে বিচার কর) জড়িতদের বিচার করা যাবে না, এমন আইন অনুমোদন করে বিএনপি যে ‘সংসদীয় পাপ’ করেছিল— তা খণ্ডনের কোনো সূত্র কেউ বলতে পারবেন কি?

বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দল ঢাকায় মহাব্যস্ত সময় কাটিয়ে স্বদেশে ফিরে সুপারিশ করেছে— নির্বাচনে ‘সব দলের অর্থবহ রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের ক্ষেত্র তৈরি করা’।

এই প্রতিনিধিদল বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় নানা স্থানে অবাধে বিচরণ করেছে। অথচ যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতর প্রতিনিধিদল ঢাকায় অবস্থানকালেই মার্কিন নাগরিকদের ‘বাংলাদেশে ভ্রমণে বাড়তি সতর্কতা জারি করেছে’।

প্রতিনিধিদল কি এমন কোনো সমস্যার মুখে পড়েছিল? বাংলাদেশে ব্যবসা ও অন্যান্য প্রয়োজনে কত বিদেশীর আনাগোনা। কেউ কি বাংলাদেশে ভ্রমণ অনিরাপদ বলছে?

প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দল ‘সব দল’-এর জন্য অর্থবহ প্রতিযোগিতার কথা বলেছে। ‘সব দল’ অর্থ কি? সেই ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচনের সময় মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর অনুসারীরা স্লোগান দিত— ‘...(গালি) জনগণ, তোরা কর নির্বাচন, আমরা চললাম সুন্দরবন’, ‘ভোটের বাক্সে লাথি মার নির্বাচন বাতিল কর’। বামপন্থীদের অনেক দল। সিরাজুল আলম খান-আ.স.ম. আবদুর রবের অনুসারীরা ভাসানীপন্থিদের মতোই অনেক দলে বিভক্ত। এক সময় তারা সমস্বরে বলত— ‘পার্লামেন্ট শুয়ারের খোয়াড়’। নির্বাচন নিয়ে সংলাপে তারা উৎসাহী হবে, এমন বাস্তবতা আছে কি?

অন্যদিকে, বামপন্থীদের এ সব গোষ্ঠীর পাশাপাশি বিএনপির সঙ্গে আরও আছে জঙ্গিবাদী কিছু গোষ্ঠী, যারা সংবিধান মানে না। ব্লাসফেমি আইন প্রণয়নের দাবিতে যারা সোচ্চার। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব প্রদানের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাদের কাছে ‘ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ’ করেছেন। ২০০৫ সালের ১৭ অগাস্ট বাংলাদেশের শত শত স্থানে বোমা হামলা চালিয়েছিল যে অপশক্তি, তারাই ২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজানে ভয়ঙ্কর জঙ্গি হামলা চালিয়ে নির্বিচার হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিল। এদেরও নির্বাচনে আস্থা নেই। বিএনপি নেতারাও এটা জানেন এবং এ কারণেই বার বার বলছেন— সাধারণ নির্বাচনে জয়ী দলগুলোকে নিয়ে নয়, শেখ হাসিনার পতনের আন্দোলনে যারা রাজপথে থাকবে এবং নানাভাবে সহযোগিতা দেবে, তাদের নিয়েই গঠিত হবে নতুন সরকার।

মার্কিন প্রতিনিধিদল বলছে— ‘বাংলাদেশের শক্তিশালী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ঐতিহ্য ২০৪১ সালে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার রূপকল্প অর্জনের ক্ষেত্রে একটি শক্তিশালী ভিত স্থাপন করেছে।’

এ ভিত রচিত হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে, সেটা যুক্তরাষ্ট্র ভালভাবেই বোঝে। কিন্তু বাংলাদেশে নিযুক্ত তাদের রাষ্ট্রদূতকে যারা ‘অবতার’ মানেন তারা কী বলছেন? মির্জা ফখরুল ইসলাম ১৩ অক্টোবর সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘বর্তমান সরকার অর্থনীতি পুরোপুরি ধ্বংস করেছে। অর্থনীতি ফোকলা হয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকার প্রতারণা করছে। এমন একটি ন্যারেটিভ খাড়া করেছে যে বাংলাদেশ রোল মডেল হয়ে গেছে থার্ড ওয়ার্ল্ড কান্ট্রিগুলোর ডেভেলপমেন্টের জন্য।’

অর্থনীতিতে ফোকলা হয়ে যাওয়া দেশটি কী করে দশকের পর দশক যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশের কোটি কোটি নারী-পুরুষকে সময়মতো পরনের কাপড় তৈরি করে পাঠাচ্ছে?

বিএনপির নেতারা একদিকে বলেন, পশ্চিমা বিশ্ব রাজনৈতিক ইস্যুতে শেখ হাসিনার সমালোচনা করে তাদের সাহস জোগাচ্ছে। একইসঙ্গে বলেন, শেখ হাসিনা উন্নয়ন-অগ্রযাত্রার চিত্র তুলে ধরে পশ্চিমাদের নিয়ন্ত্রিত বিশ্বব্যাংক-আইএমএফকে বিভ্রান্ত করছেন।

গরু হারালে কৃষক ভুল বকে, স্ত্রীকেও মা বলে সম্বোধন করে। বিএনপি নেতাদের কি গরু হারিয়েছে? এমন অবস্থান নিয়ে তারা কী করে শেখ হাসিনাকে চ্যালেঞ্জ জানাবেন? দেশে-বিদেশে এখন কিন্তু একটি সত্য প্রতিষ্ঠিত— তার মতো কোনো সরকারই এ পর্যন্ত অর্থনীতি এবং শিক্ষা-স্বাস্থ্যসহ নানা খাতে এত বিপুল অর্জন সম্বল করে ভোটারদের মুখোমুখি হয়নি। কেবল কাউকে ‘অবতার’ মেনে তাকে মোকাবিলা করা যাবে কি?

লেখকঃ মুক্তিযোদ্ধা, একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক

সৌজন্যেঃ বিডিনিউজ২৪

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত