স্বাধীনতা ও উন্নয়নের দল আওয়ামী লীগ

6656

Published on জুন 10, 2018
  • Details Image

তোফায়েল আহমেদঃ

মহান জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের নেতৃত্ব প্রদানকারী দল আওয়ামী লীগের ৬৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর এই বছরটি সবিশেষ তাৎপর্য বহন করে। ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১’ উৎক্ষেপণের মধ্য দিয়ে আমরা এখন ৫৭তম দেশ হিসেবে স্যাটেলাইট ক্লাবের গর্বিত সদস্য হয়েছি। এই একটি কারণে আন্তর্জাতিক পরিম-লে বাংলাদেশের সুনাম এখন অনন্য উচ্চতায় উঠেছে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট বাণিজ্যিকভাবে সফল হবে। মাত্র সাত বছরের মধ্যে এর বিনিয়োগকৃত অর্থ উঠে আসবে ও বাকি আট বছর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখবে। এর আগে আমরা পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিটের লাইসেন্স প্রাপ্তির মাধ্যমে ‘নিউক্লিয়ার নেশন’ হিসেবে বিশ্ব পরমাণু ক্লাবের সদস্য হয়েছি। আর স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হয়েছি। ২০০৯ থেকে আজ পর্যন্ত ৯ বছরের বেশি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত। এই ৯টি বছরে শেখ হাসিনা দেশকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। বিশ্বে মর্যাদার আসনে আসীন করেছেন। অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের রোল মডেল। প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসুর ভাষায়, বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতি চমৎকার। এটা আন্তর্জাতিক বিশ্বের জন্য অনুসরণীয়-অনুকরণীয়। নোবেল লরিয়েট অমর্ত্য সেনের ভাষায়, সামাজিক-অর্থনৈতিক সকল ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আজ পাকিস্তান থেকে এগিয়ে। এমনকি সামাজিক সূচকের কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভারত থেকে এগিয়ে। অনেক বড় বড় প্রকল্প প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সমাপ্তির পথে এগিয়ে চলেছে। পদ্মাসেতুতে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন বন্ধ করার পরেও দৃঢ়তার সাথে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতুর কাজ শুরু করে আজ তা সমাপ্তির পথে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১, পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র, পদ্মাসেতু ও পদ্মাসেতুতে রেলপথ, বঙ্গবন্ধু সেতুতে পৃথক রেলপথ নির্মাণের উদ্যোগ, মেট্রোরেল, এলিভেটরি এক্সপ্রেসওয়ে, কর্ণফুলী টানেল, রামপাল ও মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনসহ সর্বমোট ১১৯টি নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন, বিদ্যুৎ উৎপাদন ৩,২০০ থেকে ১৬,১৪৯ মেগাওয়াট, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩.৫ থেকে ৩৩.০৪ বিলিয়ন ডলার, রপ্তানি আয় ১০.৫২ থেকে ৩৪.৪২ বিলিয়ন ডলার, পায়রা বন্দর, গভীর সমুদ্র বন্দর স্থাপনসহ অসংখ্য উন্নয়নমূলক কাজ হাতে নিয়ে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৭.২৮ শতাংশ করে জনগণের মাথাপিছু আয় ১,৬১০ ডলারে উন্নীত করেছেন। সবল-সমর্থ আর্থ-সামাজিক বিকাশ নিশ্চিত করার ফলে অর্থনৈতিক অগ্রগতির সূচকে বাংলাদেশ আজ বিশে^র শীর্ষ ৫টি দেশের একটি। আন্তর্জাতিক সংস্থা প্রাইস ওয়াটার হাউস কুপার্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ‘বাংলাদেশ ২০১৩ নাগাদ বিশ্বের ২৯তম ও ২০৫০ নাগাদ ২৩তম অর্থনীতির দেশে উন্নীত হয়ে উন্নত দেশের তালিকায় স্থান করে নেবে।’ সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক উন্নতি ও সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করে জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র গঠনের এসব কৃতিত্বের জন্য জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এ পর্যন্ত ১৪টি আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত করেছে। দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এত উন্নয়নমূলক কাজ সম্পন্ন হয়েছে এবং হচ্ছে, যা এই ক্ষুদ্র লেখায় প্রকাশ করা অসম্ভব।

২০০৮-এর নির্বাচনে রূপকল্প তথা ভিশন-২০২১ ঘোষণা করেছিলেন তিনি। যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ হবে ডিজিটাল বাংলাদেশ এবং মধ্যম আয়ের দেশ। ডিজিটাল বাংলাদেশ আজ স্বপ্ন না বাস্তব। ইতোমধ্যে আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশে রূপান্তরিত হয়েছি এবং উন্নয়নশীল দেশে প্রবেশ করেছি। ২০২১-এ যখন স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি হবে, তখন আমরা পরিপূর্ণভাবে মধ্যম আয়ের দেশে প্রবেশ করব। এগুলো সম্ভব হয়েছে শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বের কারণে। শেখ হাসিনা যা বিশ্বাস করেন, জাতির জনকের মতো তাই তিনি বলেন এবং বাস্তবায়নের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেন। জাতির পিতা দুটি লক্ষ্য নিয়ে রাজনীতি করেছেন। একটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা, আরেকটি অর্থনৈতিক মুক্তি। তিনি আমাদের স্বাধীনতা দিয়েছেন কিন্তু অর্থনৈতিক মুক্তি দিয়ে যেতে পারেন নাই। সেই কাজটি দক্ষতা ও নিষ্ঠার সাথে বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা করে চলেছেন। ধীরে ধীরে যেমন বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন অনেক দূর এগিয়ে গেল, সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন স্বাধীন বাংলাদেশ হবে মর্যাদাশালী ক্ষুধামুক্ত দারিদ্র্যমুক্ত বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা। আমরা সেই পথেই বঙ্গবন্ধু-কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এগিয়ে চলেছি।

বাংলাদেশের মানুষের প্রাণপ্রিয় রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের ২৩ জুন প্রতিষ্ঠিত হয়। ঐতিহাসিক ২৩ জুন ১৭৫৭ সনে পলাশীর আম্রকাননে বাংলার স্বাধীনতার লাল সূর্য অস্তমিত হয়েছিল। আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতাগণ মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং অকালপ্রয়াত নেতা শামসুল হকÑ দলের আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশের দিন হিসেবে ইতিহাস থেকে ২৩ জুন তারিখটি বেছে নিয়েছিলেন। কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য মুসলিম লীগের নেতৃত্ব কুক্ষিগত করেছিল। সেই কারণে মুসলিম লীগের অপেক্ষাকৃত তরুণ নেতৃত্ব বিদ্রোহ করে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করে। ’৫৩ সালে দলের কাউন্সিল অধিবেশনে সাংগঠনিক রিপোর্ট পেশকালে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘জনতা ও বুদ্ধিজীবীদের সচেতন প্রতিরোধ প্রচেষ্টাতেই আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম।’ বঙ্গবন্ধুর কাছে থাকার দুর্লভ সুযোগ হয়েছিল আমার। তিনি বলেছিলেন, ‘পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করেছি, এই পাকিস্তান বাঙালিদের জন্য হয় নাই। একদিন বাঙালির ভাগ্য-নিয়ন্তা বাঙালিদেরই হতে হবে। সেই লক্ষ্য নিয়েই প্রথমে তোমাদের ছাত্র-সংগঠন ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেছি। তারপর ২৩ জুন এই ঐতিহাসিক দিনটি বেছে নিয়ে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করেছি। লক্ষ্য ছিল একদিন বাংলাদেশকে স্বাধীন করা।’ প্রতিষ্ঠার পর থেকেই আওয়ামী লীগ নিয়মতান্ত্রিক সংগ্রামের পথ বেছে নিয়েছে বলে ইতিহাসে বাংলাদেশ, আওয়ামী লীগ এবং বঙ্গবন্ধু এই ৩টি নাম সমার্থক। আজ থেকে ৫৭ বছর আগে বরিশাল ব্রজমোহন কলেজ শাখা ছাত্রলীগের কর্মী হিসেবে আমার রাজনৈতিক জীবনের সূচনা। এরপর ’৭০-এর ৭ জুন বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আওয়ামী লীগে যোগদান করি। প্রাণপ্রিয় দল আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে অর্ধশত বছর আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছি। সুদীর্ঘ এই কালপর্বে দেশের ভাগ্যাকাশে ঘটেছে অসংখ্য ঐতিহাসিক ঘটনা। আজ আওয়ামী লীগের শুভ জন্মদিনে সেসব কথা আমার মানসপটে ভেসে ওঠে।

বারবার বন্ধ্যত্ব ও ষড়যন্ত্রকে অতিক্রম করেছে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের ইতিহাস অবিরাম পরিবর্তন ও বিপ্লবের ইতিহাস। ’৫৪-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্টের ২২৮টি আসনে জয়লাভ কার্যত মুসলিম লীগের কবর রচনা করে এবং রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে সাম্প্রদায়িকতা ঝেটিয়ে বিদায় করার প্রেক্ষাপট তৈরি করে। ফলাফল, ’৪৯-এ প্রতিষ্ঠিত ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ ’৫৫-তে হয় অসাম্প্রদায়িক ‘আওয়ামী লীগ’। এই ছয় বছরে আওয়ামী লীগ কর্মীদের নিরন্তর সংগ্রাম করতে হয়েছে। দেশের চরম সাম্প্রদায়িক প্রেক্ষাপটকে মাত্র ছয় বছরের মধ্যে আমূল বদলে দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। ’৫৫-তে সাধারণ সম্পাদকের রিপোর্টে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আওয়ামী লীগ জন্ম হওয়ার পর থেকে আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ ও উহার কর্ম্মীগণ এক দিনের জন্যও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারে নাই। অত্যাচার ও জুলুম শাহীর বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ যে জোরালো প্রতিবাদের ধ্বনি তুলেছিল তারই ফলস্বরূপ জনগণের মধ্যে এসেছিল নব নব চেতনা, নতুন আশা ও উদ্দীপনা এবং অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার বজ্র কঠিন শপথ।’ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত ‘বজ্র কঠিন শপথ’ চেতনায় ধারণ করে আওয়ামী লীগের সংগ্রামী পথচলা। যে লক্ষ্য নিয়ে জাতির জনক আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সেই লক্ষ্য পূরণ হয়েছে। ধাপে ধাপে বাংলার মানুষকে তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছেন। ’৫২-এর মহান ভাষা আন্দোলন, ’৫৪-এর যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, ’৬২-এর সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে আওয়ামী লীগ। ’৬২-তে আমাদের স্লোগান ছিল ‘জাগো জাগো বাঙালী জাগো’; ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা, তোমার আমার ঠিকানা’। ’৬৬-এর ফেব্রুয়ারির ৫ তারিখে বঙ্গবন্ধু ৬-দফা দিয়েছিলেন লাহোরে। তখন তিনি ছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। ’৬৬-এর ১৮, ১৯ ও ২০ মার্চ আওয়ামী লীগের সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং তাজউদ্দীন আহমেদ সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ৬-দফা দেওয়ার পর বঙ্গবন্ধু আমাদের বলতেন ‘সাঁকো দিলাম, এই সাঁকো দিয়েই একদিন আমরা স্বাধীনতায় পৌঁছাবো।’

৬-দফা দেওয়ার পর বঙ্গবন্ধুকে আগরতলা মামলার আসামি হিসেবে ফাঁসি দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। জাগ্রত ছাত্রসমাজ সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ গঠন করে আসাদ, মকবুল, রুস্তম, মতিউর, আলমগীর, সার্জেন্ট জহুরুল হক, ড. শামসুজ্জোহাসহ অসংখ্য শহীদের রক্তের বিনিময়ে ’৬৯-এ প্রবল গণ-অভ্যুত্থান সৃষ্টি করে স্বৈরশাসক আইয়ুব খানকে ক্ষমতাচ্যুত করে। তখন আমাদের সেøাগান ছিল ‘পাঞ্জাব না বাংলা, পিন্ডি না ঢাকা’। জাতির জনককে ফাঁসির মঞ্চ থেকে ’৬৯-এর ২২ ফেব্রুয়ারি মুক্ত করে ২৩ ফেব্রুয়ারি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে কৃতজ্ঞ বাঙালি জাতি ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করে। এরপর আওয়ামী লীগ ’৭০-এর নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। যখন ১ মার্চ জাতীয় সংসদের পূর্বঘোষিত ৩ মার্চের অধিবেশন একতরফাভাবে স্থগিত ঘোষণা করা হয়, তখন দাবানলের মতো আগুন জ্বলে ওঠে। লাখ লাখ লোক রাজপথে নেমে আসে। শুরু হয় এক-দফা তথা স্বাধীনতার সংগ্রাম। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ’৭১-এর ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক বক্তৃতা দিয়ে নিরস্ত্র বাঙালি জাতিকে সশস্ত্র জাতিতে রূপান্তরিত করেন এবং বজ্রকণ্ঠে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করে বলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ অতুলনীয় এই বক্তৃতাই ছিল মূলত আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের দিক-নিদের্শনা। দীর্ঘ ৯ মাস মিয়ানওয়ালী কারাগারে কারারুদ্ধ অবস্থায় বঙ্গবন্ধু যখন মৃত্যুর প্রহর গুনেছেন, আমরা তখন হাতিয়ার তুলে নিয়ে যুদ্ধ করে ১৬ ডিসেম্বর প্রিয় মাতৃভূমি শত্রুমুক্ত করেছি। বঙ্গবন্ধুই একমাত্র নেতা যিনি বাংলার মানুষকে এক মোহনায় দাঁড় করাতে সমর্থ হয়েছিলেন। তার ডাকে এবং আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ৩০ লক্ষাধিক শহীদ আর ৪ লক্ষাধিক মা-বোনের আত্মত্যাগে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়! ’৭২-এর ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তমানব বঙ্গবন্ধু ফিরে এলেন স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের দায়িত্ব নিয়ে যখন তিনি দেশটাকে স্বাভাবিক করেন, তখন ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট সেনাবাহিনীর কতিপয় বিপথগামী বিশ্বাসঘাতকের হস্তে সপরিবারে নির্মমভাবে নিহত হন। ওই সময় তার দুই কন্যা আমাদের প্রিয় বোন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা প্রবাসে থাকায় ঘাতকদের হাত থেকে রেহাই পান।

’৭৫-এর ১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর আমাকে প্রথমে গৃহবন্দী ও পরে গ্রেফতার করে অমানুষিক শারীরিক নির্যাতন করে খুনিচক্র এবং সেপ্টেম্বরের ৫ তারিখ কারান্তরালে নিক্ষেপ করে। কারাজীবনের কুড়ি মাস ছিলাম ময়মনসিংহ কারাগারে এবং ১২ মাস কুষ্টিয়া কারাগারে। প্রায় ৩৩ মাস কারাগারে আটক থাকার পর আমার ও আবদুর রাজ্জাকের মুক্তির ব্যাপারে হাইকোর্টে রিট করলে প্রথমে রাজ্জাক ভাই এবং ৪ মাস পর ’৭৮-এর ১২ এপ্রিল আমি মুক্তিলাভ করি। কারামুক্তির পর দলকে সুসংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ করতে সারাদেশ চষে বেড়াই। ’৭৮-এর সম্মেলনে আবদুল মালেক উকিল সভাপতি, আবদুর রাজ্জাক সাধারণ সম্পাদক ও আমি কারারুদ্ধ অবস্থায় সাংগঠনিক সম্পাদক পদে নির্বাচিত হই। ’৮১-এর ১৩ থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিল অধিবেশন। কাউন্সিলে অনেক আলাপ-আলোচনার পর জাতীয় ও দলীয় ঐক্যের প্রতীক হিসেবে শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে তাকে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। আমরা সাব্যস্ত করি মহান জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের নেতৃত্ব প্রদানকারী দল আওয়ামী লীগের সংগ্রামী পতাকা তারই হাতে তুলে দেব। মাত্র ৩৪ বছর বয়সে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন শেখ হাসিনা। একই বছরের ১৭ মে এক ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ বৃষ্টিমুখর দিনে তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে ফিরে আসেন। দীর্ঘ তিন যুগ সাফল্যের সাথে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দিয়ে দলকে গণরায়ে অভিষিক্ত করে তিনবার সরকারে অধিষ্ঠিত হয়ে রাষ্ট্র পরিচালনায় যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখেছেন তিনি। নিষ্ঠা ও সততার সাথে, অত্যাচার-অবিচার সহ্য করে, জেল-জুলুম-নির্যাতন ভোগ করে আওয়ামী লীগকে বাংলার মানুষের কাছে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ’৭৫-এর পর অনৈক্য আর ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ যখন কঠিন সময় অতিক্রম করছিল, তখন তিনি দলের হাল ধরেছিলেন। সমগ্র সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা তখন সামরিক শাসকের দুঃশাসনের কবলে নিপতিত। দীর্ঘকাল সংগ্রাম করে দুঃশাসন থেকে তিনি আমাদের মুক্তি দিয়েছেন।

আওয়ামী লীগের পতাকা হাতে তুলে নিয়ে স্বৈরশাসন-বিরোধী আন্দোলন সংগঠিত করে দীর্ঘ ২১ বছর পর ’৯৬-এ গণরায় নিয়ে আওয়ামী লীগকে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে আসীন করেন বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা। তার নেতৃত্বে জাতীয় ঐকমত্যের সরকার গঠন করে আমরা মন্ত্রী হয়েছি, পাঁচ বছর নিষ্ঠার সাথে রাষ্ট্র পরিচালনা করে আমাদের হারানো গৌরব স্বাধীনতার সুমহান চেতনা পুনঃপ্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর স্বাধীনতার মূল্যবোধ ধ্বংসের চেষ্টা করা হয়েছিল। রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব লাভ করে প্রমাণ করেছি, খুনিচক্র ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে; কিন্তু বঙ্গবন্ধুর দল এবং তার আদর্শকে হত্যা করতে পারে নাই। যারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স চাপিয়ে দিয়েছিল, তাদের পরাস্ত করে ইনডেমনিটি আদেশ বাতিল করে বিচারের পথ প্রশস্ত করেছি। ২০০১-এ ক্ষমতায় এসে খালেদা জিয়া সেই বিচারের পথ অবরুদ্ধ করে। ২০০৮-এর নির্বাচনে ভূমিধস বিজয়ের মধ্য দিয়ে ২০০৯-এ সরকার গঠন করে সেই বিচারের কাজ শেষ করে বাংলার মাটিতে খুনিদের ফাঁসির রায় কার্যকর হয়। শেখ হাসিনা যদি প্রধানমন্ত্রী না হতেন তাহলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কোনোদিন বাংলার মাটিতে হতো না। বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধী-মানবতাবিরোধী অপরাধীদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা তুলে দিয়ে বাঙালি জাতিকে কলঙ্কিত করেছিল। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে বাংলার মানুষকে কলঙ্কমুক্ত করে চলেছে।

বঙ্গবন্ধুর দুটি স্বপ্ন ছিল, এক. বাংলার স্বাধীনতা; দুই. অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত করে শোষণমুক্ত সোনার বাংলা গড়ে ‘দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো’। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বাংলার মানুষ অর্থনৈতিক মুক্তি পেতে চলেছে। সংবিধান এবং সাংবিধানিক শাসন সমুন্নত রাখতে আওয়ামী লীগ বদ্ধপরিকর। কোনো অসাংবিধানিক শক্তির নিকট আওয়ামী লীগ কখনও মাথা নত করে নাই। শত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত। আওয়ামী লীগ নিয়মতান্ত্রিক দল, গণতান্ত্রিক দল। নিয়মতান্ত্রিক দল বলে ’৫৪ সাল থেকে অনুষ্ঠিত ’৮৮ এবং ’৯৬-এর ১৫ ফেব্রুয়ারির প্রহসনের নির্বাচন বাদেÑ প্রতিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশগ্রহণ করেছে। এমনকি স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের আমলে অনুষ্ঠিত বেসিক ডেমোক্রেসির নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশগ্রহণ করেছিল। স্বৈরশাসক আইয়ুবের পতনের পর ইয়াহিয়ার সামরিক শাসনে এলএফও-এর (লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার) অধীনে ’৭০-এ নির্বাচন করার প্রশ্ন যখন আসে তখন অনেকেই নির্বাচন বর্জনের ডাক দেন। দূরদর্শী নেতা বঙ্গবন্ধু নির্বাচনে অংশগ্রহণের ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তিনি আমাদের বলতেন, ‘আসন্ন নির্বাচন আমার কাছে ৬-দফা ও ১১-দফার পক্ষে রেফারেন্ডাম। নির্বাচনে বাংলার মানুষ তাদের ম্যান্ডেট প্রদান করে বিশ্ববাসীকে দেখাবে কারা তাদের নেতা। নির্বাচনে পরে আমি এই এলএফও টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলবো।’ ইতিহাস থেকে এটি স্পষ্ট যে, আওয়ামী লীগ জনসাধারণের ভোটাধিকারে বিশ্বাস করে এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতা হস্তান্তরের সাংবিধানিক নির্দেশনা পালন করে। যারা ভোটাধিকারে বিশ্বাস করে না, যারা অগণতান্ত্রিক পথে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখে তাদের ধ্বংস অনিবার্য। আমরা যদি বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলসমূহের ইতিহাস পর্যালোচনা করি তবে দেখব, একসময়ের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী দল মুসলিম লীগ, শেরে বাংলার কৃষক প্রজা পার্টি এদের অস্তিত্ব এখন আর নাই। মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ’৭০-এর নির্বাচন বর্জন করে বলেছিল, ‘ভোটের বাক্সে লাথি মারো’। আজ তার বিলুপ্ত! অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের নেতৃত্বাধীন ন্যাপ ভগ্নদশায় নিপতিত। কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষয়িষ্ণু। প্রাচীন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একমাত্র আওয়ামী লীগ বাংলার মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত।

আওয়ামী লীগ গণসম্পৃক্ত রাজনৈতিক দল, গণবিচ্ছিন্ন নয়। আওয়ামী লীগ নিয়মতান্ত্রিক সাংবিধানিক দল। সংবিধান মোতাবেক আগামী ২০১৯-এর ২৯ জানুয়ারির আগের ৯০ দিনের যে কোনো দিন জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে। আমার বিশ্বাস সেই নির্বাচনে দেশের সকল রাজনৈতিক দল সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অক্ষুন্ন রেখে জাতীয় অগ্রগতিকে সমুন্নত রাখবে। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘গভীর বাস্তবতাবোধই একদিন আওয়ামী লীগকে জনতা ও বুদ্ধিজীবীদের সংগঠন করিয়া তুলিয়াছিল।’ বঙ্গবন্ধুর চেতনা ধারণ করে শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বে গৌরবময় সংগ্রামী পতাকা ঊর্ধ্বে তুলে ধরে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক এবং উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলাই আওয়ামী লীগের আরাধ্য।

লেখক : আওয়ামী লীগ নেতা, সংসদ সদস্য, বাণিজ্যমন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার

সৌজন্যেঃ উত্তরণ

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত