ছিটমহলের দুঃসহ অভিজ্ঞতা আজ শুধুই স্মৃতি

7006

Published on আগস্ট 2, 2018
  • Details Image

ড. শফিক আশরাফঃ

আমরা পৃথিবীর উদ্বাস্তু মানুষদের কথা জানি। আমরা নিজেদের অভিজ্ঞতা দিয়ে উদ্বাস্তু সমস্যা উপলব্ধি করেছি। আমরা দীর্ঘ ৯ মাস ভারতের ঘাড়ে উদ্বাস্তু হয়ে থেকেছি। আমরা দেশহীন মানুষদের কথাও জানি, যাদের কোনো দেশই তাদের নাগরিক বলে স্বীকার করে না। যারা ছিটমহলে বসবাস করেছে তারা একই সঙ্গে দুটি অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে গিয়েছে। বর্তমান সরকারের হাত ধরে প্রায় ৬৮ বছরের এই ছিটমহল সমস্যা ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই সমাধান হয়। উদ্বাস্তু ও দেশহীন মানুষগুলো একটা দেশ পায়, পায় নিজেদের মাটি।

আমার সহকর্মী শিক্ষক-কলামিস্ট তুহিন ওয়াদুদ ওই দিন বাংলাদেশ অংশে ভারতের ছিটমহল দাশিয়ারছড়ায় তাদের সঙ্গে সারা রাত ছিলেন। খুব কাছ থেকে দেখেছেন তাদের আনন্দ ও বেদনা। প্রায় তিন বছর পর তাঁর সঙ্গে দাশিয়ারছড়ায় যাচ্ছিলাম বাস্তব অবস্থা দেখতে। যেতে যেতে তিনি তাঁর সেই অভিজ্ঞতা ও ছিটমহল আন্দোলনের ইতিহাস, তাদের আনন্দ ও কষ্টের কথা বলছিলেন। ভারত অংশে ছিটমহল আন্দোলনের নেতা ছিলেন দীপক সেনগুপ্ত এবং বাংলাদেশ অংশে গোলাম মোস্তফা। দীপক সেন মৃত্যুশয্যায় শুয়ে ছেলে দীপ্তিমান সেনকে দেশহীন দুঃখী মানুষদের ভার নিতে বললেন। দীপক সেনের মৃত্যুর পর ছেলে দীপ্তিমান বহুজাতিক কম্পানির বড় চাকরি ছেড়ে ছিটমহলবাসীদের পাশে দাঁড়ান। দিনের পর দিন স্ত্রী-সন্তান থেকে বিচ্ছিন্ন থেকেছেন দীপ্তিমান সেনগুপ্ত। দীপ্তিমানের স্ত্রী তাঁকে ফোন করে বলেছেন, ‘মাঝেমধ্যে দেখা করতে এসো! লোকে বলে আপনার স্বামী বেঁচে থাকলে আসে না কেন?’ আন্দোলনের এসব ইতিহাস শুনতে শুনতে আমরা দাশিয়ারছড়ায় পৌঁছে গেলাম। আমাদের জন্য সেখানে অপেক্ষা করছিলেন বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফা ও ছিটমহলবাসীদের সুখ-দুঃখের সঙ্গী, তাদের নিকটজন সাংবাদিক আজিজুর রহমান মজনু।

দাশিয়ারছড়ায় ঢুকেই কয়েকজন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ও শ্রমজীবী মানুষের সঙ্গে দেখা হলো। মনে হলো আনন্দে তাদের চোখ-মুখ ঝলমল করছে। তাদের দেখেই বোঝা যাচ্ছে তারা ভালো আছে। তাদের সন্তানদের শিক্ষার কথা জিজ্ঞেস করাতে বলল—আগে এখানে কোনো স্কুল ছিল না, এখন স্কুল হয়েছে। তাদের সন্তানরা নিয়মিত স্কুলে যাচ্ছে। মসজিদ-মন্দির, শ্মশানঘাট তৈরি হয়েছে। তাদের জন্য আরো আনন্দের বিষয় হলো এখানে বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা হয়েছে। গোলাম মোস্তফার সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম বাংলাদেশের ভেতরে ভারতের যে ১১১টি ছিটমহল এবং ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের ৫১টি, মোট ১৬২টি ছিটমহল ছিল—সেখানে অর্ধলক্ষাধিক মানুষ বসবাস করত। সেখানে কোনো আইনের প্রয়োগ ছিল না, ছিল অপরাধীদের অভয়ারণ্য। সেখানে মাদক বেচাকেনাসহ যেকোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চলত অবাধে। সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ অনেকটা জিম্মি ছিল অপরাধীদের কাছে। তাদের উৎপাদিত শস্য কিংবা অন্যান্য জিনিসপত্রের ন্যায্য দাম তারা পেত না। কারণ কোনো দেশেরই বাজার তাদের জন্য উন্মুক্ত ছিল না। তাদের কোনো চিকিৎসাসেবা ছিল না, ছিল না কোনো জনপ্রতিনিধি কিংবা কোনো ভোটাধিকার।

২০১৫ সালে ছিটমহল বিনিময়কালে দাশিয়ারছড়ায় ১০৫টি হিন্দু পরিবার ছিল। এর মধ্যে ২৫টি পরিবার বাংলাদেশ অংশ ছেড়ে ভারতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। বাকি ৮০টি পরিবার এখানে থেকে যায়। ভারত অংশ থেকে বাংলাদেশ অংশে একটি পরিবারও আসেনি। ছিটমহল বিনিময়ের এই তিন বছর পর বাংলাদেশ অংশে থেকে যাওয়া সনাতন ধর্মের পরিবারগুলোকে যথেষ্ট সন্তুষ্ট বলে মনে হয়েছে। তারা ওপারে চলে যাওয়া পরিবারগুলোর দুঃখ-কষ্ট ও ভোগান্তির কথা বলছিল।

চারদিকে নীলকমল নদবেষ্টিত দাশিয়ারছড়া খুব সহজেই একটি ইউনিয়নের মর্যাদা পেতে পারে। ইউনিয়ন পরিষদ হলে আইন-শৃঙ্খলার উন্নতির পাশাপাশি রাস্তাঘাট ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পাবে এখানকার নাগরিকরা। আঞ্চলিক ভোটের রাজনীতি যারা করে তারা তাদের নিজেদের কারণে অনেক কিছুরই বিরোধিতা করবে; কিন্তু সরকারকে যৌক্তিকভাবে নিরপেক্ষ কাজটি করতে হবে। স্বার্থান্বেষী মহলের কারণেই ছিটমহল সমস্যা নিরসনে ১৯৫৮ সালের নেহরু-নূন চুক্তি বাস্তবায়িত হয়নি; ১৯৭৪ সালের মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি আলোর মুখ দেখেনি! এমনকি ২০১১ সালে ছিটমহল বিনিময় চুক্তি বাস্তবায়নে সব প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করা হলেও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরোধিতার কারণে সেটা বাস্তবায়িত হয়নি। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে শেষ পর্যন্ত ৬ জুন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরে উভয় দেশ মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি অনুমোদন করে। এরই আলোকে ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই রাত ১২টা ১ মিনিটে ছিটমহল বিনিময় হয়। সরকার ৩১ জুলাইকে ছিটমহল দিবস ঘোষণা করেছে। এই দিনে ছিটমহলবাসী হয়তো তাদের খেরোখাতা নিয়ে বসবে। হয়তো অতীত দুঃখ-কষ্টের স্মৃতিচারণা করবে, জীবনের লাভ-লোকসানের হিসাব মেলাবে, দীর্ঘশ্বাস ফেলে দেখবে এরই মধ্যে পেরিয়ে গেছে জীবনের ৭০ বছর।

ছিটমহলে বসবাসরত অর্ধলক্ষাধিক মানুষ এই রাজনীতির কারণে প্রায় ৬৮ বছর দেশহীন উদ্বাস্তু জীবন যাপন করেছে। সত্যিকার অর্থেই তারা জানে না এই দুর্বিষহ জীবনের জন্য তাদের অপরাধ কী ছিল। ছিটমহল নিয়ে গলাবাজির রাজনীতি চলেছে দীর্ঘদিন। এখন অন্তত গলাবাজির রাজনীতি শেষ হয়েছে। নিঃস্বার্থভাবে বিভিন্ন ব্যক্তি, সংগঠন ও সরকার দাঁড়িয়েছে তাদের পাশে। আর এই ভালোবাসার প্রতিদানে তারাও মাটি ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে জন্মভূমিকে তা ফিরিয়ে দেবে বহুগুণে।

লেখক : শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত