পিতা ও কন্যা : ভিন্ন প্রেক্ষিত একই ধারা

1937

Published on আগস্ট 16, 2018
  • Details Image

শেখর দত্তঃ

জাতীয় শোক দিবস সামনে রেখে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন ও কর্মের বহুমুখী অবদান এবং জাতীয় জীবনে সেই সব অবদানের প্রভাব নিয়ে যত ভাবছি, ততই বিস্মিত হচ্ছি। জাতীয় চেতনার ভ্রুণ সৃষ্টিতে, সেই চেতনার ভিত্তিতে জাতিকে একটি স্বাধীন মানচিত্র উপহার দিতে, হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী বিধ্বস্ত নবজাত দেশে রাষ্ট্রীয় সব প্রতিষ্ঠান গড়তে, জনজীবনকে স্বাভাবিক ও বিশ্ব সম্প্রদায়ের স্বীকৃতি আদায় করতে এবং সর্বোপরি জাতির অভিযাত্রার লক্ষ্য সুনির্দিষ্ট করতে তিনি যা করেছেন, তা জাতি হিসেবে আমরা তেমন স্মরণেও রাখি না। তবে জাতি-রাষ্ট্র জন্মের উৎসমুখের দিকে তাকালে অনুধাবন করা যাবে, প্রথমে মার্কিন-চীন মদদপুষ্ট সাম্প্রদায়িক-স্বৈরাচারী পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসনের বন্দিদশা ছিন্ন করা এবং পরে দেশি-বিদেশি পরাজিত শত্রুদের প্রকাশ্য গোপন অপতৎপরতার মধ্যে উল্লিখিত সব অবদান রাখা ছিল যারপরনাই কঠিন এবং প্রতি পদে জীবনের কতটা ঝুঁকি ছিল।

এই ঝুঁকিটাই আজ থেকে ৪৩ বছর আগে আজকের দিনে সত্যে পরিণত হয়েছিল। অভিজ্ঞতা থেকে এই সত্য ইতোমধ্যে খুব ভালোভাবে অনুধাবন করা গেছে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার ভেতর দিয়ে দেশে কেবল রাজনৈতিক নেতৃত্বের শূন্যতাই সৃষ্টি হয়নি, পাকিস্তানি আমলের মতো অস্থিতিশীলতা, অনিশ্চয়তা, অরাজকতার মধ্যে পড়েছে। হত্যাকারীদের উদ্দেশ্য ছিল দুটো। এক. দেশকে পাকিস্তানি ধারায় ফিরিয়ে নেয়া, দুই. অস্থিতিশীল করা। প্রথমটা পরিকল্পনা মতো কার্যকর করা সম্ভব হয়নি, তবে দ্বিতীয়টা কার্যকর থাকছে।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সামরিক শাসনের দিনগুলোতে বলা হতে থাকে যে, আওয়ামী লীগের দশা হবে মুসলিম লীগের মতো। একদিকে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে তীব্র অপবাদ রটানো আর অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুর নাম নিয়ে রাজনীতি করা যাবে না বলে সামরিক ফরমান জারি করা হয়েছিল। লক্ষ্য ছিল বঙ্গবন্ধু ও তাঁর দল আওয়ামী লীগকে চিরতরে কবর দেয়া। কিন্তু এটাই বাস্তব যে, আওয়ামী লীগ এখনো সর্ববৃহৎ দল হিসেবে ক্ষমতায় আর বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রীয় মর্যাদার সুপ্রতিষ্ঠিত।

এই অবস্থায় নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি-জামায়াতের ২০ দলীয় জোটের সঙ্গে ডান-বাম-মধ্য রাজনৈতিক দলগুলো ও নিরপেক্ষ দাবিদার সুশীলরা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে টার্গেট করেছে। আওয়ামী লীগ বিরোধী প্রচার ও তৎপরতার গতিপ্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করলে সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে, কীভাবে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করার তৎপরতা চালাচ্ছে।

প্রসঙ্গক্রমে বঙ্গবন্ধুর সময় আর শেখ হাসিনার সময়ের ব্যবধান বিস্তর। তখন উপমহাদেশ বিভক্তির ভেতর দিয়ে মধ্যযুগীয় মতাদর্শে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তৃতীয় বিশ্বের সদ্য স্বাধীন দেশগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে। আমাদের মতো দেশগুলো যখন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী হয়ে সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের দিকে ঝুঁকে গণমুখী অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী ও প্রগতিশীল পথ গ্রহণ করতে থাকে, তখন পাকিস্তান আমেরিকামুখী হয়ে বাঙালি জাতিবিরোধী গণবিরোধী সাম্প্রদায়িক প্রতিক্রিয়াশীল পথ গ্রহণ করে। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর জাতীয়তাবাদী নেতারা জোট নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করে আর পাকিস্তানের শাসক-শোষকগোষ্ঠী যোগ দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জোটে।

এই কারণে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের গণউত্থান ও মুক্তিযুদ্ধ অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী, গণতান্ত্রিক, বামমুখী, প্রগতিমুখিন ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী হওয়া ভিন্ন বিকল্প ছিল না। অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী ও গণতান্ত্রিক পথে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের দেশ হওয়া ছিল তখনকার সময়ে বিধিলিপির মতো অখণ্ডনীয়। সেই লড়াই-সংগ্রাম পরিচালনার অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে শেখ মুজিব হয়ে উঠেছিলেন জনগণের অবিসংবাদিত নেতা, জাতির পিতা।

কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের মধ্য দিয়ে দেশ যখন স্বাধীন হয়, তখন বিশ^ প্রেক্ষাপটে ঘটে এক পরিবর্তন। আমেরিকা হীনস্বার্থে পেট্রোডলার ব্যবস্থা গড়ে তোলে এবং সোভিয়েত ইউনিয়নকে মোকাবেলা করার জন্য আগ্রাসী হয়ে ওঠে। সেই পরিস্থিতিতে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে খাদ্যসহ অন্যান্য সাহায্যের জন্য বঙ্গবন্ধু সরকারকে কিছুটা ভারসাম্যমূলক অবস্থান নেয়া ভিন্ন উপায় ছিল না। জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে উল্লিখিত ধরনের অবস্থান গ্রহণের ফলে দেশের ভেতর বঙ্গবন্ধু বাম-ডান-মধ্য তিন দিক থেকেই আক্রমণের শিকার হন।

বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তা লক্ষ করে পরাজিত শত্রুরা প্রকাশ্যে টার্গেট করে জাতীয় চার নীতিকে। ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিকে ধর্মহীনতা বলে ধর্মপ্রাণ মানুষের মনে বিভ্রান্তি ছড়ায়। তবে ডানদিক থেকে আক্রমণ করে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ফায়দা লোটা তখন একেবারেই সম্ভব ছিল না। তাই শুরুতেই আসে বামদিক থেকে আক্রমণ। স্বাধীনতার ৬/৭ মাসের মধ্যেই রহস্যজনকভাবে প্রথমে ছাত্রলীগ ও পরে আওয়ামী লীগ ভেঙে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের স্লোগান নিয়ে জাসদ গঠিত হয়। চীনপন্থী গ্রুপগুলো তো আগে থেকেই সাধারণভাবে ‘দুই কুকুর’ নীতি নিয়ে আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করছিল। এমন কি রুশপন্থীদের ঐক্যের কৌশলও একই ধারায় ছিল না। বঙ্গবন্ধুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট ছিঁড়ে ফেলাসহ নানা ঘটনা হচ্ছে এর সাক্ষী। তবে বলার অপেক্ষা রাখে না, সরকার ও সরকারি দল আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে ‘চাটার দল’; তাদের অপতৎরতা এইসব কাজের জমিন সৃষ্টি করে উৎসাহ জুগিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর ওপর মানুষের যতটুকু আস্থা ও বিশ^াস ছিল, তাতে এই পরিস্থিতি থেকে দেশকে টেনে তোলা অসম্ভব ছিল না। কিন্তু তখনকার সময়ের অন্যান্য গণমুখী জাতীয়তাবাদী নেতাদের মতো বঙ্গবন্ধুকেও নিষ্ঠুর বুলেটে জীবন দিতে হয়েছিল।

বঙ্গবন্ধুর সময়ে বিশ্ব ও জাতীয়ভাবে উল্লিখিত যে ধরনের প্রেক্ষাপট ছিল এখন তা নেই। যে দিক থেকেই বলা হোক না কেন, সমাজতন্ত্র এখন আর আশু রাজনৈতিক ইস্যু নেই। ধনতন্ত্র-সমাজতন্ত্র এই দুই ভাগে বিশ্ব আর বিভক্ত নয়। সমাজতন্ত্রের পতন, টুইন টাওয়ার ধ্বংস, ধর্মীয় উগ্রতা ও সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের ভেতর দিয়ে দেশে দেশে গণতন্ত্র ও মানবিকতা অপসৃত হচ্ছে। মূল্যবোধ ও নৈতিকতার ধস নামছে। লোভ-লালসা-হিংসা-দ্বেষ লাগামহীন হয়ে উঠছে। সহজে অস্ত্র ও মাদকপ্রাপ্তি আর অর্থবান হয়ে উঠে কায়েমি স্বার্থবাদী সিন্ডিকেট গড়ে তোলার সঙ্গে সহজ খবরের আদান-প্রদান পরিস্থিতিকে সব দিক থেকে অস্থির করে তুলছে।

আন্তর্জাতিক ও জাতীয় প্রেক্ষাপটে উল্লিখিত ধরনের ভিন্নতা সত্ত্বেও কোনো দল গোষ্ঠী ব্যক্তি যদি বলেন, বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ আর শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ এক নয়, শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগকে পাকিস্তানি আমলের প্রথমদিকের মতো আওয়ামী মুসলিম লীগ বানিয়ে ফেলছে; তবে তা নিঃসন্দেহে হয় পরিবর্তন না বোঝার ফল কিংবা বুঝেও রাজনৈতিক ফায়দা লোটার দুরভিসন্ধী। একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, কথায় কথায় যারা তত্ত্বকথা উচ্চারণ করেন, তারা এটা ভুলে যান যে, ক্ষমতার রাজনীতি মানিক মিয়া এভিনিউর মতো সোজা সরল পথে অগ্রসর হয় না। চড়াই-উৎরাই, আগু-পিছু কৌশল গ্রহণ করা ছাড়া ইপ্সিত লক্ষ্যের দিকে অগ্রসর হওয়া অসম্ভব। অবস্থা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কৌশল পাল্টাতে হয়। যে দল কৌশলে স্থিতিস্থাপকধর্মী নয়, সেই দল টিকে থাকার যোগ্যতা হারায়।

ক্ষমতার রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ কখনোবা ধর্মীয় রাজনীতির পক্ষে ছাড় দিলেও দলের ঘোষণাপত্র ও কর্মসূচিতে সেই ছাড় দেয়নি। আজকে জাতীয় শোক দিবস তথা বঙ্গবন্ধুর তিরোধান দিবসে বলতে হয়, পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে আগু-পিছু কৌশল নিয়ে যেভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অগ্রসর হচ্ছেন, তাতে জন্মলগ্নে আওয়ামী লীগ যে ধারা গ্রহণ করেছিল, বঙ্গবন্ধু যে ধারা বহন করে জীবন দিয়েছেন, সেই ধারাই বঙ্গবন্ধু-কন্যা পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কৌশল নিয়ে অগ্রসর করছে। চলার পথে সীমাবদ্ধতা-দুর্বলতা থাকতেই পারে আর সমাজের দুর্বলতা-সীমাবদ্ধতা রাজনীতিতে প্রতিফলিত হবেই। প্রকৃত বিচারে বাঙালি জাতির জীবনে বঙ্গবন্ধু যেমন চিরঞ্জীব, তেমনি বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক ধারাও চিরঞ্জীব থাকবে। জাতীয় শোক দিবসে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুসহ শহীদ সবার প্রতি জানাই সশ্রদ্ধ প্রণতি।

লেখকঃ রাজনীতিক ও কলাম লেখক

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত