বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড ও জঙ্গিবাদের উত্থান প্রসঙ্গে

9349

Published on আগস্ট 30, 2018
  • Details Image

হাসান-উজ-জামানঃ

যতকাল রবে পদ্মা-মেঘনা-গৌর-যমুনা বহমান, ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুসহ তার পরিবারের সদস্যদের হত্যাকা- ইতিহাসের বেদনাদায়ক ও কলঙ্কজনক অধ্যায়। এই ঘৃণ্য, পৈশাচিক ও নারকীয় হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে আমাদের কষ্টার্জিত মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধ রাতারাতি ধ্বংস করে ’৭১-এর পরাজিত পাকিস্তানি চেতনা ও মূল্যবোধ পুনঃপ্রতিষ্ঠার ঘৃণ্য অপচেষ্টা চালানো হয়।

বাংলাদেশের বিজয় লাভের পর জনগণের রোষানলে পড়ার ভয়ে পলাতক ঘাতক-দালাল, রাজাকার-আলবদর, জামায়াত, মুসলিম লীগ, শান্তি কমিটির নেতারা বীরদর্পে খুনি মোস্তাক-জিয়ার আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে ক্রমেই রাজনীতিতে আবির্ভূত হতে হতে শুরু করে। স্বাধীনতা লাভের পর অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নিষিদ্ধ ঘোষিত জামায়াত, মুসলিম লীগ পুনর্জন্ম লাভ করে। মহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল অসাম্প্রদায়িক চেতনায় প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ যেন বাস্তবে নতুন করে পাকিস্তান রাষ্ট্রে পরিণত হয়। ’৭১-এর পরাজিত শক্তি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সামরিক শাসক জিয়ার আর্থিক ও নৈতিক সহায়তায় ক্রমেই শক্তি সঞ্চয় করতে থাকে। এমনকি মতাদর্শগত কারণে জেনারেল জিয়া তাদের প্রিয় নেতা ও তার দল বিএনপি প্রিয় দলে পরিণত হয়।

১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের হত্যাকা-ের খলনায়কদের বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধুর হত্যার পেছনে জিয়ার ইন্ধন ও সম্পৃক্ততা সুষ্পষ্ট হয়ে ওঠে। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার রোধকল্পে খুনি খন্দকার মোশতাক যে জঘন্য ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করেন, জিয়া ক্ষমতার জোরে সংসদে বিল উত্থাপনের মাধ্যমে সেই ঘৃণ্য অধ্যাদেশ অর্থাৎ ইনডেমনিটিকে আইনে রূপদান করে চরম বর্বরতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। ক্ষমতা দখলের পর বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে নিজেকে সাচ্চা পাকিপ্রেমিক ও তাদের অকৃত্রিম বন্ধু এবং সর্বোপরি তাদের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের দালাল হিসেবে প্রমাণ করতে সক্ষম হন। ফলে খুব স্বাভাবিকভাবেই বলা যায় যে, তিনি মনে-প্রাণে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেননি, জাতির গণজোয়ারে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার পেয়ারে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের পর প্রকৃত রাজনৈতিক চরিত্র উন্মোচন করেন। পরবর্তীকালে ক্যান্টনমেন্টে গড়ে ওঠা দল বিএনপি পাকিস্তানি দালাল মুসলিম লীগ, জামায়াত, রাজাকার, আলবদরদের জোটের অন্তর্ভুক্ত করে স্বাধীনতাবিরোধী গোষ্ঠীর বিশ্বস্ত আশ্রয়স্থল বা প্ল্যাটফর্মে পরিণত হয়। তাই নির্বাচন এলেই স্বাধীনতাবিরোধীরা তাদের অস্তিত্ব রক্ষার্থে বিএনপির পতাকাতলে সমবেত হয়।

জিয়ার শাসনামলে তার পৃষ্ঠপোষকতায় মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের নবম-দশম শ্রেণির পাঠ্যপুস্তক ‘ইসলামী পৌরনীতি’ বাধ্যতামূলক করা হয়। যে পাঠ্যপুস্তকে সুস্পষ্ট উল্লেখ ছিল, ‘বাংলা ভাষা হিন্দুয়ানী ভাষা’ যদিও এটি বাংলা ভাষাতেই লেখা পাঠ্যপুস্তক ছিল। এতে আরও উল্লেখ ছিল, “আমরা প্রকৃত অর্থে স্বাধীনতা অর্জন করেছিলাম ’৪৭ সালের ১৪ আগস্ট এবং ’৭১-এর স্বাধীনতা ভারতের দান।” এমনকি এই পুস্তকে ধৃষ্টতার সঙ্গে উল্লেখ করা হয়, ‘শেখ মুজিব জাতীয় বেইমান’। সুপরিকল্পিতভাবে মাদ্রাসার কোমলমতি ছাত্রদের মাথায় এহেন জঘন্য মিথ্যাচার ঢুকিয়ে আমাদের কষ্টার্জিত স্বাধীনতার বিরুদ্ধে জঙ্গি সৃষ্টির বীজ বপন করা হয়েছিল। ক্রমান্বয়ে এরা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে, এমনকি আফগান তালেবানদের সঙ্গে যোগদান করে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে এবং তাদের সঙ্গে বিভিন্ন যুদ্ধে অংশগ্রহণের মাধ্যমে অভিজ্ঞতা অর্জন করে। পরবর্তী সময়ে এরা দেশে ফিরে এসে বিভিন্ন পাহাড়ি অঞ্চল এবং গহিন জঙ্গলে প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে তরুণ ও যুবকদের ভারী ও হালকা অস্ত্রের প্রশিক্ষণ দিয়ে শহরাঞ্চলসহ দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়। এর পরিণতিতে বিভিন্ন এলাকায় হঠাৎ করে গুটিকয়েক যুবককে স্লোগান দিতে শোনা গেছে, ‘আমরা সবাই তালেবান বাংলা হবে আফগান’ ইত্যাদি। এদের মগজে ঢোকানো হয় যে, এ দেশের ইসলামকে ধ্বংস করা হয়েছে এবং তাদের ইসলাম ধর্ম রক্ষার্থে জিহাদে অংশ নিতে হবে, প্রয়োজনে বিধর্মী এমনকি নিজ ধর্মের দ্বিমত পোষণকারীদের হত্যা করা জায়েজ। তারা বিশ্বাস করে, তাদের ভাষায় এই জিহাদে অংশগ্রহণকালে কেউ মৃত্যুবরণ করলে সে শহীদ হয়ে জান্নাতবাসী হবে এবং তার দল তার পরিবারকে প্রয়োজনীয় আর্থিক সহায়তা প্রদান করবে। মূলত জাতির জনকের নির্মম হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধ ভূলুণ্ঠিত হতে শুরু করে। অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির স্থলে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়ে ক্রমেই জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটতে থাকে।

খুনি মোশতাকের ক্ষমতাগ্রহণ থেকে শুরু করে দীর্ঘ ২১ বছর রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সৃষ্ট সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক পরিবেশের সুযোগে জঙ্গিবাদ ক্রমেই মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। ১৯৯১-এ খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি ক্ষমতায় এসে জঙ্গিবাদের পৃষ্ঠপোষকতা দেয়, এমনকি লালন-পালন করতে শুরু করে। ১৯৯২-এর ৩০ এপ্রিল কওমি মাদ্রাসার ছাত্রদের প্রতিষ্ঠিত ‘হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশ” ১৯৯৯-এর ১৮ জানুয়ারি কবি শামসুর রাহমানের ওপর হামলা চালিয়ে তাকে গুরুতর আহত করে। গোয়েন্দা নজরদারি এড়িয়ে এরা বিভিন্ন স্থানে বোমা হামলার মাধ্যমে হত্যাযজ্ঞ চালায়। খালেদা জিয়া ক্ষমতায় থাকাকালীন ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনে সন্ত্রাসবিরোধী জনসভায় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের মূল নেতাদের হত্যার উদ্দেশ্যে পরিচালিত নারকীয় বোমা হামলা এরই ধারাবাহিকতা।

যে বর্বরোচিত হামলায় আইভি রহমানসহ ২২ জন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী নিহত হন। এটি দিবালোকের মতো সত্য যে, এ হামলার পেছনে খালেদা ও তার বড় পুত্রের মদদ ছিল। একটি জেলা বাদে প্রতিটি জেলায় ২০০৫-এর ১৭ আগস্ট একযোগে বোমা হামলা চালায় ‘জামা’আতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ’, অর্থাৎ জেএমবি নামে একটি জঙ্গি সংগঠন। এ সংগঠনের সবাই মাদ্রাসার ছাত্র। দীর্ঘ প্রায় এক যুগ পর গত ১ জুলাই রাতে সর্বাপেক্ষা বৃহৎ জঙ্গি হামলা চালানো হয় নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা কূটনৈতিক পাড়া গুলশানের হলি আর্টিজানে। ১৭ জন বিদেশিসহ মোট ২০ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এর আগে গুলশান থানার ওসি এবং এসি এদের গোলাগুলিতে নিহত হন। রাত পোহালে কমান্ডো হামলায় নিহত জঙ্গিদের মধ্যে তিনজনের পরিচয় জেনে আমাদের অবাক হতে হয়। ধনী পরিবারের এদের একজন ছিল স্কলাস্টিকার প্রাক্তন ছাত্র, বাকি দুজন নর্থ সাউথ ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ঈদের দিন শোলাকিয়ার ঈদগাহ মাঠে হামলাকারীরাও নর্থ সাউথের ছাত্র বলে জানা যায়। এর অল্প কয়েক দিনের মধ্যে সিরিয়া থেকে আইএসের পক্ষে তিন বাংলাদেশি তরুণ হুমকি প্রদানসহ বিভিন্ন ভিডিও বার্তা পাঠায়। শোলাকিয়ার হামলার পরও বেশ কিছু জঙ্গি তৎপরতা আমাদের শঙ্কিত করে। এই জঙ্গিদের প্রত্যেকেই ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান, একজন চিকিৎসক, প্রকৌশলী, কেউ কেউ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ ও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র। মাত্র দেড় যুগ আগে গুটিকয়েক মাদ্রাসাছাত্রের চাকু-ছোরা নিয়ে যে জঙ্গিদের যাত্রা শুরু হয়েছিল, ইতোমধ্যে অত্যাধুনিক অস্ত্রসহ তাদের উগ্রপন্থার ভয়ঙ্কর রূপ প্রতিরোধ করা হালকা এবং পুরনো আমলের অস্ত্র ধারণকারী বর্তমান পুলিশ বাহিনীর পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে এবং পুলিশ ও গোয়েন্দা বাহিনীর কাছে বিস্ময়ের সৃষ্টি করে।

বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে ক্রমান্বয়ে বেড়ে ওঠা জঙ্গিবাদের এই অভিশাপ থেকে বাংলাদেশকে রক্ষার দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ আজ অত্যাবশ্যক। বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের পক্ষেই সম্ভব এহেন অশুভ শক্তির মূল উৎপাটনের মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব সুরক্ষার প্রয়োজনীয় এবং যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা। ক্ষমতাসীন দলের সৎ, ত্যাগী ও গণমুখী নেতৃত্বই পারে জনগণের সার্বিক সমর্থন ও আস্থা অর্জনের মাধ্যমে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে জঙ্গিবাদের উৎস খুঁজে বের করে সমূলে এই জঙ্গিবাদকে নির্মূল করতে হবে। সেই লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর অক্লান্ত পরিশ্রমে তিলে-তিলে গড়ে ওঠা বর্তমান ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগকে সৎ-ত্যাগী ও জনগণের দুঃখ-দুর্দশা মোচনে নিবেদিতদের নেতৃত্বে সংগঠিত করতে হবে। কেবল দেশপ্রেমিক-সৎ ও গণমুখী নেতৃত্বের মাধ্যমেই সম্ভব হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধুর সারাজীবনের আত্মত্যাগ থেকে শিক্ষা লাভ করে ত্যাগের মহিমা ও মহান ’৭১-এর চেতনা এবং দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে চলমান হিংস্র ও অভিশপ্ত জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে গোটা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ হওয়া জরুরি। কষ্টার্জিত স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সুরক্ষার মাধ্যমে নিরাপদ, শোষণহীন গণতান্ত্রিক ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হবে।

লেখকঃ মহাসচিব, হিউম্যান রাইটস ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশ ও সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব, মুক্তিযোদ্ধা সংহতি পরিষদ

সৌজন্যেঃ দৈনিক আমাদের সময়

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত