মৃত্যুঞ্জয়ী এক মহানায়ক - দিবাকর সিকদার

5591

Published on আগস্ট 4, 2019
  • Details Image

‘একজন মানুষ হিসাবে সমগ্র মানবজাতি নিয়েই আমি ভাবি। একজন বাঙালি হিসাবে যা কিছু বাঙালিদের সঙ্গে সম্পর্কিত তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এই নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালোবাসা, অক্ষয় ভালোবাসা, যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি এবং অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে’ (শেখ মুজিবুর রহমান, অসমাপ্ত আত্মজীবনী)।

১৭৫৭ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের জাঁতাকলে স্বাধীন বাংলার যে সূর্য অস্তমিত হয়েছিল, সেই দুঃসময়কে অতিক্রম করে বাংলার স্বাধীনতার সূর্যকে বাঙালির কাছে ফিরিয়ে দিতে আবির্ভূত হন বিশ্বের সংগ্রামী মানুষের অবিসংবাদিত নেতা বাঙালির মহানায়ক শেখ মুজিবুর রহমান।

গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ তার জন্ম। বাবা শেখ লুৎফর রহমান, মা বেগম সায়রা খাতুন। ১৯৩৮ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সে সহধর্মিণী হিসেবে গ্রহণ করেন বেগম ফজিলাতুন্নেসাকে।

১৯৪১ সালে গোপালগঞ্জ মিশন স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করে ভর্তি হন কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে। ১৯৪৬ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এ সময় তিনি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সংস্পর্শে আসেন।

রাজনৈতিক অঙ্গনে ধ্বনিত হয় এক কালপুরুষের দীপ্ত পথচলা। ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন। রাজনৈতিক অঙ্গনে শেখ মুজিবের সম্পৃক্ততা বেড়ে চলে। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয় এবং তিনি এর সঙ্গে যুক্ত হন। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে হরতাল পালনের সময় ঢাকায় গ্রেফতার ও কারারুদ্ধ হন।

১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে টুঙ্গিপাড়া এলাকা থেকে পূর্ববঙ্গ সাধারণ পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার কৃষি, বন ও সমবায় মন্ত্রীর দায়িত্ব নেন শেখ মুজিব। পাকিস্তানি শোষণের বিরুদ্ধে নানা ঘাত-প্রতিঘাত অতিক্রম করে তিনি বাঙালিদের সংগঠিত করতে থাকেন।

একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের স্বপ্নের বীজ বাঙালির হৃদয়ে বপন করতে সক্ষম হন তিনি। ১৯৬৬ সালে লাহোরে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে আমাদের বাঁচার দাবি ‘৬ দফা কর্মসূচি’ পেশ করেন।

‘আগরতলা মামলা’ নামক মিথ্যা ষড়যন্ত্র মামলা দিয়ে তাকে গ্রেফতার করা হয়। ফুঁসে ওঠে বাঙালি। ১৯৬৯ সালে প্রবল গণআন্দোলনের মুখে মামলাটি প্রত্যাহার করে শেখ মুজিবকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ কর্তৃক ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে আয়োজিত নাগরিক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তাকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়।

১৯৭০ সালের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় বঙ্গবন্ধুকে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতার আসনে অধিষ্ঠিত করে। স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবতার আরও কাছাকাছি চলে আসে।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ ২৫ মার্চ রাতে গ্রেফতার হওয়ার আগে স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন তিনি।

বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয় পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে। নয় মাসব্যাপী মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের আত্মত্যাগ আর কয়েক লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আসে কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখেন বঙ্গবন্ধু।

স্বাধীন বাংলাদেশের পুনর্গঠনে শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর সংগ্রাম। দিন-রাত বঙ্গবন্ধুর অক্লান্ত পরিশ্রম আর কূটনৈতিক পারদর্শিতায় বাংলাদেশ এগিয়ে যেতে থাকে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রে স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের হাতে সপরিবারে নিহত হন বঙ্গবন্ধু। ব্যাহত হয় স্বাধীন বাংলাদেশে স্বপ্নিল অগ্রযাত্রা।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। যে অসাধারণ ধৈর্য, সাহস ও দৃঢ়তা নিয়ে তিনি তার সুদীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রামে অসংখ্য অগ্নিপরীক্ষার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি শাসক-শোষক চক্রকে রুখে দিয়ে একটি স্বাধীন দেশের জন্ম দিয়েছেন, তার তুলনা বিশ্বে বিরল। তিনি মৃত্যুঞ্জয়ী। মৃত্যুর তুচ্ছতা অতিক্রম করে তিনি আজকের ও আগামীকালের মহানায়ক।

দিবাকর সিকদার : উপ-কিপার, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর

সৌজন্যেঃ যুগান্তর 

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত