আগামী দিনের আওয়ামী লীগ

6922

Published on ডিসেম্বর 9, 2019
  • Details Image

আবদুল মান্নানঃ

দেশের রাজনীতি অনেকটা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগবিরোধীদের মধ্যে বিভক্ত। এই বিভক্তি সম্ভবত শুরু হয়েছে ১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠন করার পর।

আগামী ২০ ও ২১ ডিসেম্বর দেশের বৃহত্তম ও অন্যতম ঐতিহাসিক রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দুই দিনব্যাপী ২১তম জাতীয় কাউন্সিল। কাউন্সিলে আগামী তিন বছরের জন্য দলটির জাতীয় নির্বাহী কমিটি গঠন করা হবে। বিভিন্ন কারণে এবারের কাউন্সিল ও কমিটি গঠন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যে কাউন্সিল গঠন করা হবে তার সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ। প্রথমত, সামনের মার্চ মাসে থেকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপনের বছর শুরু হবে। এরপর ২০২১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের ৫০ বছর। একই বছর দেশটি মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে পরিচিতি লাভ করবে বলে আশা করা যাচ্ছে। নতুন কাউন্সিলের নেতাদের এই দুটি কারণে সামনের দুই বছর অনেক গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানের নেতৃত্ব দিতে হবে। এরই মধ্যে দলটির বেশ কিছু অঙ্গসংগঠনের ও বিভিন্ন জেলার কমিটি গঠন করা হয়ে গেছে। আরো কিছু হবে। এসব কারণেই এবারের কাউন্সিল ঘিরে দেশের মানুষের অনেক প্রত্যাশার মধ্যে আছে দলের নির্বাহী কমিটিতে যেন কর্মঠ, নির্লোভ, ক্লিন ইমেজ, চৌকস, শিক্ষিত, মার্জিত, বিনয়ী, নতুন চিন্তার ও যাঁদের দলের প্রতি কমিটমেন্ট আছে, তেমন ব্যক্তিদেরই মনোনীত করা হয়।

আওয়ামী লীগের ইতিহাস অনেক চড়াই-উতরাইয়ের ইতিহাস, অনেক মানুষের ত্যাগ-তিতিক্ষার ইতিহাস। ১৯৪৯ সালে বাঙালির স্বার্থ রক্ষার প্রয়োজনে জন্ম নেওয়া দলটি এখন ৭০ বছর পার করছে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের একটি অমর কীর্তি হচ্ছে, এই দলের নেতৃত্বেই বাংলা নামের একটি স্বাধীন দেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক দল হিসেবে নিষিদ্ধ হয়েছে কয়েকবার, বিশেষ করে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সামরিক শাসকদের আমলে। দলের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন কমপক্ষে দুইবার। ভাঙনের মুখে পড়েছে একাধিকবার। যেমনটা উল্লেখ করেছি।

প্রথম বড় ভাঙনটি দেখা দেয় ১৯৫৭ সালে, যখন দলের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী কাগমারী সম্মেলনে দল থেকে বের হয়ে ন্যাপ গঠন করেন। ১৯৬৬ সালে তরুণ শেখ মুজিব বাঙালির মুক্তির সনদ ছয় দফা ঘোষণা করলে দলের তৎকালীন সভাপতি মাওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ নিজের সমর্থক কয়েকজন সদস্যকে নিয়ে দল থেকে বের হয়ে যান। একসময় দলের এককালের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান চৌধুরী দল থেকে বের হয়ে নিজে একটি আওয়ামী লীগ গঠন করেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনা দেশে না ফেরা পর্যন্ত দলটি অনেকটা ছত্রভঙ্গ অবস্থায় ছিল। আওয়ামী লীগের সেই দুর্দিনে দলের হাল ধরেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের স্ত্রী জোহরা তাজউদ্দীন। জিয়া ক্ষমতা দখল করে ১৯৭৭ সালে রাজনৈতিক দলের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলে মহিউদ্দিন আহমেদ ও আব্দুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে পৃথক বাকশাল গঠন করে তাঁরা আওয়ামী লীগ থেকে বের হয়ে যান। ১৯৮১ সালে ছয় বছর নির্বাসনে থেকে শেখ হাসিনা দেশে ফিরে শক্ত হাতে দলের হাল ধরলে তখন দলের অনেক নেতাই হতাশ হন। কারণ তাঁদের প্রত্যাশা ছিল শেখ হাসিনাকে দলের সভাপতি করা হলেও দলের আসল ক্ষমতা থাকবে তাঁদের হাতে। তাঁদের ধারণা ছিল, আওয়ামী লীগের মতো এত বড় একটি রাজনৈতিক দল পরিচালনা করার মতো যেহেতু কোনো অভিজ্ঞতা শেখ হাসিনার নেই, সেহেতু দলের নিয়ন্ত্রক ভূমিকায় থাকবেন তাঁরা। কিন্তু শেখ হাসিনা প্রমাণ করেছেন তাঁর অভিজ্ঞতা কম থাকতে পারে; কিন্তু জাতির জনকের কন্যা হিসেবে দলের পূর্ণ ক্ষমতা হাতে নেওয়ার মতো সাহস তাঁর আছে। ভুলে গেলে চলবে না, তিনি শেখ মুজিবের রক্তের উত্তরাধিকার।

শেখ হাসিনা সভাপতির দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি ঠিকই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে আবার পুনরুজ্জীবিতই করেননি, দলকে দীর্ঘ ২১ বছর পর আবার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করেছেন, যা ছিল রাজনীতির ইতিহাসে এক বিরল ও বিস্ময়। এই মেয়াদসহ মোট চার মেয়াদে তিনি আওয়ামী লীগকে সরকার পরিচালনার দায়িত্বে রাখতে পেরেছেন। এই চার মেয়াদে তিনি বাংলাদেশকে নিয়ে গেছেন এক অন্য উচ্চতায়। তিনি বর্তমানে বাংলাদেশের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর। এত দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকা নিঃসন্দেহে আনন্দের ও কৃতিত্বের। তবে এই মুহূর্তে দলের বা সরকারের সামনে কোনো প্রতিপক্ষ না থাকায় দলকে আরো কার্যকর ও সক্রিয় করার এখনই সময়। তবে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার বড় বিপদ হচ্ছে, দলে বানে ভাসা খড়কুটার মতো অনেক আগাছা-পরগাছা ঢুকে পড়ে, যেমনটি বর্তমান সময়ের আওয়ামী লীগে পরিলক্ষিত হচ্ছে। এতে দল দুর্বল হতে বাধ্য আর একবার দল দুর্বল হয়ে গেলে তাকে আবার টেনে তোলা সহজ নয়। আর টেনে তুলবেন তেমন আরেকজন শেখ হসিনা তো দেখা যাচ্ছে না।

একটি ক্রিয়াশীল ও দক্ষ দল না থাকলে সংগঠন তার অবস্থান ধরে রাখতে পারে না। এই সত্যটি বঙ্গবন্ধু বুঝতেন বলেই তিনি মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দলের সাধারণ সম্পাদক হওয়াকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। দেশ স্বাধীন হলে দলের সভাপতির দায়িত্ব এ এইচ এম কামরুজ্জামানের ওপর ছেড়ে দিয়েছিলেন। সরকারে থাকা বা মন্ত্রিত্বে থাকার চেয়ে দলের হাল ধরা যে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ, তা বঙ্গবন্ধুর মতো অন্য কেউ বোঝেননি। কিছুটা তাঁর কন্যা বুঝেছেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এই মুহূর্তে শেখ হাসিনা দল ও সরকারের জন্য এতটাই অপরিহার্য হয়ে উঠেছেন যে তাঁকে বাদ দিয়ে ভিন্ন কিছু চিন্তা করাও যায় না। ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর একটি বিষয় লক্ষণীয় যে বিগত ১০-১১ বছরে ভেসে আসা আগাছা-পরগাছারা অনেক বেশি সমাদৃত, তৃণমূলের নেতাকর্মীরা নন। বাবা পোড়খাওয়া আওয়ামী লীগের কর্মী হতে পারেন, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের জন্য জীবন বাজি রাখতে পারেন; কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে তাঁর সন্তানরাও আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে বিশ্বাস করেন বা এই রাজনীতি সম্পর্কে তাঁর কোনো ধারণা আছে, কারণ তাঁদের অনেকেই ‘আই হেইট পলিটিকস’ প্রজন্মের মানুষ।

২০০১ সালের কথা। শেখ হাসিনা তখন প্রধানমন্ত্রী। চট্টগ্রামে একজন আওয়ামী লীগের খাঁটি সমর্থক ও শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ, তাঁকে প্রধানমন্ত্রী কোনো একটি দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন। সেই ব্যক্তির সন্তান শেখ হাসিনাকে পছন্দ করেন না। টেবিলে শেখ হাসিনার একটি ফ্রেমবন্দি ছবি ছিল। অব্যাহতির খবর শুনে টেবিলে রাখা বঙ্গবন্ধুকন্যার ছবিটিকে উল্টে দিলেন সেই সন্তান এই বলে, ‘এই মহিলাকে পছন্দ করি না।’ এটি কোনো গল্প নয়, এটি বাস্তব। এমন অনেকেই এখন আওয়ামী লীগের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনে শুধু নেতানেত্রীই নন, কেউ কেউ মন্ত্রিসভার সদস্যও হয়েছেন। এবার মন্ত্রিসভা গঠন করার সময় শেখ হাসিনা অনেক নতুন মুখ সামনে নিয়ে এসেছেন, তাত্ত্বিকভাবে যা সঠিক ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য হচ্ছে, তাঁদের অনেকেই নানা কারণে জাতি ও দলকে হতাশ করেছেন। কেউ কথা বেশি বলেন, কেউ বা পদের দম্ভে মানুষের সঙ্গে দাম্ভিক আচরণ করেন। বিনয় তাঁদের কাছে অপরিচিত শব্দ। এটি সাধারণ মানুষের কথা। যাঁরা মন্ত্রিসভায় ঠাঁই পান, তাঁদের অবশ্যই দেশের সংবিধান সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা থাকাটা বাঞ্ছনীয়। নতুন প্রজন্মের অনেক নেতানেত্রীর দেশের সংবিধান সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা আছে বলে তাঁদের কথাবার্তায় মনে হয় না।

বঙ্গবন্ধু বাঙালিকে বিশ্বাস করতেন। তাঁর কন্যাও পিতার এই গুণাবলির উত্তরাধিকার। অনেকে বঙ্গবন্ধুকন্যার এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়েছেন ও নিচ্ছেন। এক-এগারোর পর বঙ্গবন্ধুকন্যা তখন কারাগারে। দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তাঁর মুক্তি দাবি করে একটি বিবৃতি দেবেন। একজনের কাছে বিবৃতিটি নিয়ে গেলে তিনি সাফ জানিয়ে দিলেন, এটি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের কাজ নয়। পরবর্তীকালে সেই একই ব্যক্তি দেশের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কমিশনের সদস্য হয়েছিলেন। এমন অনেক উদাহরণ আছে। ব্যক্তিগত লাভের জন্য অনেকে নিজের অতীত গোপন করে গত কয়েক বছরে দলে ও রাষ্ট্রের অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদ বাগিয়ে নিয়েছেন। এমন ধরনের অপকর্ম করার জন্য দলের ভেতরের কেউ কেউ নিশ্চয় সহায়তা করেন, যাঁকে দলের সভাপতি বিশ্বাস করেন। বঙ্গবন্ধু নিজের কাছের সব মানুষকে আপন মনে করতেন। এর জন্য তাঁকে চড়া মূল্য দিতে হয়েছিল। কাছের অনেক মানুষ থাকতে পারেন, যাঁরা নিজেরটা ছাড়া কিছু বোঝেন না। তাঁরা হচ্ছেন দলের জন্য ঘুণপোকা। বঙ্গবন্ধুকন্যা সম্পর্কে এ কথাটি অনেকাংশে সত্য। যাঁরা বঙ্গবন্ধু ও তাঁর কন্যাকে ভালোবাসেন তাঁরা প্রত্যাশা করেন, এই কাউন্সিলে যাঁরা দলের হাল ধরার জন্য মনোনীত বা নির্বাচিত হবেন, দলের প্রতি তাঁদের আনুগত্য নিরঙ্কুশ হবে এবং তাঁরা পদ-পদবির জন্য কখনো আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হননি।

শেখ হাসিনা ইদানীং প্রায়ই বলে থাকেন—তিনি অবসরে যাবেন। এ বয়সে এমনটা বলা স্বাভাবিক। যতই বলি শেখ হাসিনার বিকল্প তো দেখা যাচ্ছে না, কিভাবে অবসরে যাবেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, কোনো এক সময় তাঁর বিকল্প তো খুঁজতে হবে এবং সেখানে আবেগের কোনো স্থান থাকবে না। শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর স্থলাভিষিক্ত হতে পেরেছিলেন। কারণ জন্মলগ্ন থেকেই তিনি পিতাকে যত না একজন পিতা হিসেবে দেখেছেন, তার চেয়ে বেশি দেখেছেন একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে। শেখ মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধু আর জাতির জনক হয়ে উঠার তিনি একজন সাক্ষী। বর্তমান কাউন্সিলের পর আরেকটি কাউন্সিলের মাঝখানে হয়তো তিন বা চার বছরের ব্যবধান হবে।

পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পায়রা সমুদ্রবন্দর, ঢাকার মেট্রো রেল, কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে টানেলসহ অনেক মেগা প্রকল্পের কাজ শেষ হবে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে। কাউন্সিলে যাঁরা নির্বাচিত বা মনোনীত হবেন তাঁরা হবেন শেখ হাসিনার হাতে জন্ম নেওয়া নব আওয়ামী লীগের সেরা নির্বাহী কমিটি, যাঁরা এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করবেন। তাঁদের হাত ধরেই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ একটা নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে, তেমনটাই জনগণের প্রত্যাশা। ৪৯তম বিজয়ের মাসে আওয়ামী লীগের সভাপতির কাছে এটাই হোক দেশের মানুষের একমাত্র প্রত্যশা।

লেখক : বিশ্লেষক ও গবেষক

সৌজন্যেঃ কালের কণ্ঠ

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত