যে প্রধানমন্ত্রী শুধু প্রশাসক নন

3969

Published on অক্টোবর 14, 2020
  • Details Image

সিকদার আনোয়ার:

মন্ত্রিপরিষদ সচিব, মুখ্য সচিব এবং গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত সচিবরা দাপ্তরিক প্রয়োজনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে অপেক্ষাকৃত ঘন ঘন দেখা সাক্ষাতের সুযোগ পান। আমি সরকারের সচিব ছিলাম অল্প সময়ের জন্য, তাও একটি প্রশিক্ষণ একাডেমিতে রেক্টর হিসেবে। ফলে মন্ত্রিপরিষদের বৈঠক, একনেক সভাসহ প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত কোনো সভায় যোগদানের সুযোগ হয়নি। সুযোগ হয়নি তার সফরসঙ্গী বা প্রতিনিধি দলের সদস্য হয়ে বিদেশ সফরের। রাষ্ট্রের প্রধান এই নির্বাহীর সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ হয়েছে মাত্র কয়েকবার।

প্রথম ঘটনা ২০১২ সালের ১৯ ডিসেম্বরে। ন্যাশনাল ডিফেন্স কোর্সের (এনডিসি) সমাপনী অনুষ্ঠান। জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান হয় প্রতি বছর। অডিটরিয়ামে সনদ বিতরণের পর স্ন্যাকস ও চায়ের ব্যবস্থা করা হয়েছিল খোলা মাঠে প্যান্ডেল করে। আর এ প্যান্ডেল সংলগ্ন মাঠে সামরিক, বেসামরিক, বিদেশি কোর্সমেটদের আলাদা করে দাঁড় করানো হয়। বেসামরিক কর্মকর্তাদের মধ্যে আমার আগের ব্যাচের কর্মকর্তা থাকলেও আমি অতিরিক্ত সচিব আর সবাই যুগ্মসচিব বা সমমর্যাদাসম্পন্ন বিধায় আমার আপত্তি ও যুক্তিকে গুরুত্ব না দিয়ে আমাকে লিডার বানানো হয়েছে। তাই আমাকেই সামনে দাঁড়াতে হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী হেঁটে সবাইকে অতিক্রম করেন এবং এনডিসির কমান্ড্যান্ট লে. জে. মোল্লাহ ফজলে আকবর সবাইকে পরিচয় করিয়ে দেন।

একপর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী আমার সামনে আসতেই সালাম দিয়ে পরিচয় দিলাম। অনেক ভিভিআইপি বা সিনিয়র কর্মকর্তাকে দেখেছি নীরবে ইঙ্গিতে সালামের জবাব দেন। তিনি হাসিমুখে শব্দ করে সালামের জবাব দিলেন, কুশলাদি জিজ্ঞেস করলেন এবং কোর্স সম্পর্কে মতামত নিলেন। সবশেষে জিজ্ঞেস করলেন, 'সিভিল অফিসার আপনারা কতজন?' বললাম, 'স্যার, আমরা ১২ জন।' তিনি বললেন, 'ভালো তো, অনেকেই তো আছেন।' আমার সাহস খানিকটা বেড়ে গেল, হয়তো ওনার আন্তরিক সাহচর্যে, হাসিভরা মুখ দেখে, স্বাভাবিক আলাপচারিতায়। বলে বসলাম, 'স্যার, সংখ্যাটা আরও বেশি হওয়া দরকার।' বলেই ভাবনায় পড়ে গেলাম, বলাটা ঠিক হলো কিনা। অন্য কোনো প্রধানমন্ত্রী হলে রাগ না করলেও অন্তত বিরক্ত হতেন। কিন্তু তিনি সম্মতিসূচক মাথা নেড়ে, হাসি দিয়ে এগিয়ে গেলেন।

দ্বিতীয় ঘটনা ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের। আমি তখন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রশাসক। ১৬ মার্চ থেকে ৬ এপ্রিল পর্যন্ত ঢাকার শেরেবাংলা ক্রিকেট স্টেডিয়ামসহ তিনটি স্টেডিয়ামে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হবে। ঢাকা শহর শুধু সুসজ্জিত করা নয়, সেই সঙ্গে নাগরিক সুবিধাদি উন্নয়নের একটা বিরাট অংশের দায়িত্ব ডিএনসিসির ওপর। কয়েক কোটি টাকার প্রকল্প জরুরি ভিত্তিতে পাস হয়ে গেল। বিভিন্ন রাস্তার মিডিয়ান কোম্পানি বা ফার্মগুলোর স্ব স্ব অর্থায়নে সৌন্দর্যবর্ধন করার জন্য বিজ্ঞাপন দেওয়া হলো। জাহাঙ্গীর গেট থেকে বনানী রেলক্রসিং পর্যন্ত মিডিয়ান সৌন্দর্য বর্ধন করার কাজ পেল ভিনাইল ওয়ার্ল্ড। সময় কম, সিদ্ধান্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা কাজ শুরু করে দিল। কিছুদিনের মধ্যেই হঠাৎ একদিন একটি পত্রিকার প্রথম পাতায় একাধিক ছবিসহ লিড নিউজ হলো- ভিনাইল ওয়ার্ল্ড যে কাজ করছে, তাতে আবর্জনার শহর হতে যাচ্ছে ঢাকা। তৃতীয় শ্রেণির ইট, বাথরুমের টাইলস দিয়ে যাচ্ছেতাই কাজ হচ্ছে। দেশের ভাবমূর্তি ধুলায় লুণ্ঠিত হবে ইত্যাদি।

সকালেই প্রধানমন্ত্রীর পিএস আমার ব্যাচমেট ফোন করে বললেন, 'সর্বনাশ, পত্রিকা যেভাবে ছবিসহ রিপোর্ট করেছে, তার ওপর ভিআইপি কে যেন প্রধানমন্ত্রীর কাছে একই অভিমত দিয়েছেন। তিনি তোমাদের ডেকেছেন জরুরি ভিত্তিতে।' শিডিউল দেখে বললেন, 'আগামীকাল ১০টায় হেলিকপ্টারে তিনি চট্টগ্রামে যাবেন। সকাল ৯টা থেকে সোয়া ৯টার মধ্যে গণভবনে দেখা করতে হবে।' দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও আমি যাব ঠিক করলাম। হঠাৎ মাথায় এলো তৎকালীন সচিব মনজুর হোসেনকে নিয়ে যাই। তিনি হয়তো কিছুটা সামলাতে পারবেন। অনুরোধ করার সঙ্গে সঙ্গে তিনি রাজি হয়ে গেলেন।

সকাল পৌনে ৯টার মধ্যে গণভবনে আমরা হাজির। প্রধানমন্ত্রী এলেন ৯টার সামান্য পরে। আমাদের ডাকলেন প্রায় সোয়া ৯টায়। সামনের চেয়ারে সচিব আর আমি। ডান পাশে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বসলেন। দুরু দুরু বক্ষে প্রস্তুতির কথা শুরু করলাম। লক্ষ্য করলাম ওনার মুখে বিরক্তি বা অসন্তোষের রেশ মাত্র নেই; বরং চোখে হাসির আভা। বক্ষের কম্পন থেমে গেল। ঢাকা শহরের রাস্তা মেরামত, সৌন্দর্যবর্ধনসহ অন্যান্য বিষয়ে আমাদের পরিকল্পনাটা সংক্ষেপে প্রধানমন্ত্রীকে বললাম। তিনি ধৈর্য সহকারে শুনে যাচ্ছেন। তারপর কিছু পরামর্শ দিলেন। মিডিয়ানে কী ফুল লাগানো যায়, কোন ফুল কোন ঋতুতে ফোটে, কোন সময়ে ফোটে তা মুখস্থ বলে যাচ্ছেন, আমরা তন্ময় হয়ে শুনছি।

আনুমানিক পৌনে ১০টায় একজন এসে বললেন, 'স্যার, হেলিকপ্টার রেডি।' তিনি কোন সড়কের কী অবস্থা বলে যাচ্ছেন। পল্লবীর কালশী সড়কটি মেরামত করতে বললেন, যাতে গাড়িগুলো এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি মিরপুর স্টেডিয়ামে ঢুকতে পারে। বললাম,'স্যার, সে রাস্তাটির প্রশস্তকরণ ও মেরামতের কাজ শুরু হয়ে গেছে।' তিনি কথা বলছেন, হাসছেন। ততক্ষণে প্রায় ১০টা বেজে গেছে। প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কবিগুরুর 'আমাদের ভয় কাহারে' স্মরণ করে এয়ারপোর্ট থেকে স্টেডিয়াম পর্যন্ত স্থাপিতব্য বিলবোর্ডের ছবি দেখাতে শুরু করলেন। এয়ারপোর্ট থেকে প্রথমটিতে বঙ্গবন্ধু, তারপর রাষ্ট্রপতি, তৃতীয়টিতে প্রধানমন্ত্রীর ছবি। তৃতীয়টিতে ওনার হাসিমুখ ছবি দেখেই ফিক করে হেসে বলে উঠলেন 'এটা দেবেন? এটা তো টুথপেস্টের বিজ্ঞাপন!' সবাই হেসে উঠলেন। এক ঘণ্টারও বেশি সময় পর বেরিয়ে আসার সময় নিচু স্বরে, কোমল সুরে গুরুত্বপূর্ণ কথাটা বললেন- 'মিডিয়ানে ইট-কংক্রিট যতটুকু সম্ভব কম লাগাবেন।' বাইরে এসে ভাবলাম কত উদ্বিগ্ন ছিলাম, অথচ কী সুন্দর পরিবেশে সমাধান! বলা বাহুল্য, আজও ঢাকা নগরীতে সেগুলো অন্যতম সুন্দর মিডিয়ান।

তৃতীয় ঘটনা ১৭ বা ১৮ ডিসেম্বর, ২০১৭। বিসিএস প্রশাসন একাডেমিতে ২১ ডিসেম্বর ১০২ এবং ১০৩তম আইন ও প্রশাসন কোর্সের সমাপনী ও সনদ বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীকে প্রধান অতিথি হিসেবে দাওয়াত কার্ড পৌঁছাতে গণভবনে গিয়েছিলাম সকাল পৌনে ৯টায়। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব জানালেন, বিশেষ কারণবশত তিনি গণভবনে আসতে পারবেন না। দেখলাম কোনো এক দেশের রাষ্ট্রদূত প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বিদায়ী সাক্ষাৎ করতে এসেছেন। অপেক্ষা করতে থাকলাম। পৌনে ১০টার দিকে তিনি বের হয়ে তার অফিস কক্ষের দিকে রওনা হলেন। আমার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় দাঁড়িয়ে সালাম দিলাম, তিনি জবাব দিলেন। তিনি অফিস কক্ষে ঢোকার কিছুক্ষণের মধ্যে সেনাপ্রধান বেশ কিছু কর্মকর্তাসহ এলেন এবং অনেকক্ষণ কথা বললেন। তারপর একে একে সুপ্রিম কোর্টের একজন বিচারপতি, খাদ্যমন্ত্রী, সাবেক শিল্পমন্ত্রী দেখা করলেন। এরপর এনডিসি কমান্ড্যান্ট অনেক কর্মকর্তাসহ এলেন দাওয়াত দিতে এবং অনেকক্ষণ ছিলেন গণভবনে।

সবশেষে আমাকে যখন ডাকা হলো তখন সাড়ে ১২টা পার হয়ে গেছে। সালাম দিয়ে কক্ষে ঢুকতেই প্রধানমন্ত্রী বললেন, 'আপনাকে অনেকক্ষণ বসিয়ে রাখা হয়েছে।' আমি বললাম, 'না স্যার, কোনো অসুবিধা নেই, আমি ভালো ছিলাম।' তিনি তার বাঁপাশে ব্যক্তিগত কর্মকর্তাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, 'তোমরা খেয়াল রাখবা না কে কখন এসেছেন?' আমি ভীষণ অপ্রস্তুত হলাম। আমাকে বসতে বললেন। কক্ষে বসা ছিলেন মুখ্য সচিব। অনুমতি নিয়ে দাওয়াত কার্ডটি দিলাম। তিনি দেখলেন, পড়লেন। আরও কিছু বিষয়ে আলোচনা হলো। একই দিন বিকেলে আরেকটি কর্মসূচি আছে বিধায় আমাদের অনুষ্ঠান সংক্ষিপ্ত করে চা-নাশতা পর্ব আগেই বাদ দেওয়া হয়েছিল।

প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়ে সাহস করে একপর্যায়ে বলেই ফেললাম, 'স্যার, অনুমতি দিলে একটা অনুরোধ করতে চাই। আমার এই ১০০ জন ম্যাজিস্ট্রেট সারাজীবন এ মধুর স্মৃতি বয়ে বেড়াবে, তাদের কর্মে উৎসাহ-উদ্দীপনা জোগাবে যদি তারা আপনার সঙ্গে বসে এক কাপ চা খেতে পারে। আপনি কি অনুগ্রহ করে আরও বিশ-পঁচিশ মিনিট সময় দেবেন?' উনি মৃদু হেসে ব্যক্তিগত স্টাফদের দিকে জিজ্ঞাসু নেত্রে তাকালেন বটে, তাদের কিছু বলার আগেই আমাকে সম্মতি দিয়ে দিলেন। অনুমতি নিয়ে বেরিয়ে এলাম আর ভাবছিলাম এ সংবাদ শুনে শতাধিক ম্যাজিস্ট্রেটের হৃদয়ে আনন্দের বন্যা বয়ে যাবে। 

লেখকঃ অবসরপ্রাপ্ত সচিব; প্রাক্তন রেক্টর, বিসিএস প্রশাসন একাডেমি

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত