৬ দফাই এক দফাঃ আমাদের স্বাধীনতা, ঘুরিয়ে বলা শুধু

1140

Published on জুন 7, 2021
  • Details Image

মহসিন খানঃ

১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে পরাজিত হওয়ার পর প্রায় ২০০ বছর কেটেছে শোষণ, নিষ্পেষণ, নির্যাতনে। ১৯৪৭ সালে একটি অনিয়ন্ত্রিত ইতিহাসের শেষ মিনিটের বিশেষ ছাড়ের মাধ্যমে জন্মলাভ করে পাকিস্তান ও ভারত নামক দুটি রাষ্ট্র। দেশ ভাগ হলেও পূর্ব বাংলার মানুষের মাথার উপর থেকে আকাশের কালো মেঘ তখনো কাটেনি। প্রায় ১২০০ মাইল দূরের পশ্চিম পাকিস্তান সরকার এ দেশের মানুষের উপর অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক অত্যাচার জারি রাখে। প্রথমে আঘাত হানে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মুখের ভাষা বাংলার উপর। ৫৬ শতাংশ মানুষের মুখের ভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বেও উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করে পাকিস্তান সরকার তাদের স্বৈরাচারী মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ ঘটায়।

১৯৫২ সালে বুকের তাজা রক্ত দিয়ে বাঙালিরা তাদের মায়ের ভাষা বাংলার অধিকার আদায় করে।এই আন্দোলনের সময় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে কারারুদ্ধ করা হয়। কারাগারে থেকেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মাতৃভাষার জন্য আন্দোলন করেছেন। অনশন করেছেন মায়ের ভাষা বাংলার অধিকার আদায় করার জন্য। ভাষার উপর আঘাত করে শুরু, তারপর এদেশের মানুষদের উপর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিকভাবে অত্যাচারের স্টিমরোলার চালায় পাকিস্তান সরকার। পূর্ব বাংলার মানুষের কষ্টে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে রাতারাতি পরিবর্তন সাধিত হয়। অপরদিকে বছরের পর বছর বৈষম্যের শিকার হয়েছে পূর্ব পাকিস্তানের অবকাঠামো,স্বাস্থ্য এবং শিক্ষা।

ভারত ভাগের সময় পাকিস্তানের দুই অংশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলের সংখ্যা ছিল প্রায় সমান। কিন্তু ১৯৭১ সালে এসে পূর্ব পাকিস্তানে ২৪ বছরের আগের তুলনায় প্রাইমারি স্কুলের সংখ্যা কমে যায়। অথচ পশ্চিমে ১৯৬০ এর দশকে এসেই প্রাথমিক স্কুলের সংখ্যা তিনগুণ বেশি হয়ে যায়। ১৯৫১ সালে পূর্ব পাকিস্তানে গ্রাজুয়েটের সংখ্যা ছিল ৪১,০০০। আর পশ্চিম পাকিস্তানে ছিল ৪৫,০০০। কিন্তু দশ বছর পর ১৯৬১ সালে পূর্ব পাকিস্তানে গ্রাজুয়েট তৈরি হয় ২৮,০০০,পশ্চিম পাকিস্তানে সেই সংখ্যা দাঁড়ায় ৫৪,০০০ এ। ১৯৪৭ এ পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে অর্থনৈতিক উন্নয়ন বা মাথাপিছু আয়ের বিবেচনায় তেমন কোন তারতম্য না থাকলেও অব্যাহত বৈষম্যের পরিনতিতে পরের ২৫ বছরে পূর্ব পাকিস্তানের মাথাপিছু আয়ের চেয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের আয় প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়। এছাড়া সরকারি বিভিন্ন চাকরিতে পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় পূর্ব পাকিস্তানের পরিমান ছিল খুবই নগন্য। সেনাবাহিনীতে নিয়োগের ক্ষেত্রেও একই দৃশ্য দেখা যেত। ১৯৭০ সালে ইয়াহিয়া খানের সেনাবাহিনীতে বাঙালি সৈনিক বাড়ানোর অঙ্গীকার করার পরও সেনাবাহিনীতে বাঙালি অফিসার সংখ্যা দাঁড়ায় ছয় হাজারে তিনশত জন। সিংহভাগই নিন্মপদের কর্মকর্তা। বঙ্গবন্ধু যখন যেভাবে পেরেছেন পাকিস্তান সরকারের অন্যায়,অত্যাচারের প্রতিবাদ করেছেন।

১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা খুবই নাজুক হয়ে পড়ে।পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের নিরাপত্তা এতটাই সঙ্কটাপন্ন হয়ে পড়ে যে,ভারত চাইলেই পাকিস্তানের এই অংশ দখল করে নিতে পারতো।পূর্ব পাকিস্তানিরা ভাগ্য এবং ভারতীয় করুণার উপর নির্ভরশীল ছিল। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী পশ্চিম পাকিস্তান নিয়েই ব্যস্ত ছিল।তাদের মনোভাব এমন ছিল যেন পশ্চিম পাকিস্তান রক্ষা পেলেই পূর্ব পাকিস্তান রক্ষা!

পাক-ভারত যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে রাজনীতিবিদদের কাছে,সর্বোপরি দেশের মানুষের কাছে পূর্ব পাকিস্তানের নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি ফুটে উঠে। প্রত্যেকের কাছে বিষয়টি সুস্পষ্ট হলেও কেউ বুঝে উঠতে পারছিলো না বিষয়টি কিভাবে উথাপন করবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বুঝতে পারেন একটি স্থায়ী সমাধান ব্যতীত, এদেশ পরিচালনার দায়িত্ব এদেশের মানুষের হাতে অর্পিত হওয়া অবধি এদেশের মানুষের নিস্তার নেই। পাক-ভারত যুদ্ধের পর ১৯৬৬ সালের ৫-৬ ফেব্রুয়ারী লাহোরে অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের দুই অংশের বিরোধী দলের কনভেনশনে বঙ্গবন্ধু দলের অনুমতি ব্যতীত নিজের একার সুদুরপ্রসারি চিন্তার ফসল ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবি পেশ করেন। পাকিস্তানি শাসকরা তাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে ঘোষণা দেয়। বঙ্গবন্ধু অনুষ্ঠিতব্য সম্মেলনে অংশগ্রহণ না কর দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। দেশে ফিরে ২১ ফেব্রুয়ারী আওয়ামীলীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় ছয় দফা পাস করান। ২৩ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে ছয় দফা উথাপন করা হয় লাহোর প্রস্তাবের সাথে মিল রেখে। এরপর 'আমাদের বাঁচার দাবিঃ ছয় দফা কর্মসূচি' শিরোনামে একটি পুস্তিকা বের করা হয়। অল্পদিনের মধ্যে সারা বাংলার ঘরে ঘরে পৌঁছে যায় এই বই। হ্যান্ডবিল,পোস্টার বিলি করে মানুষকে বুঝানোর চেষ্টা করা হয় ছয় দফার গুরুত্ব। বই, পোস্টার, হ্যান্ডবিল পৌঁছানোর পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু দেশের বিভিন্ন স্থানে সফর করতে থাকেন। তাঁর বক্তব্য, বিবৃতিতে ছয় দফা এ দেশের মানুষের অধিকার এ কথা বিশেষভাবে ফুটে উঠে। মানুষও বুঝতে শুরু করে বন্দুকের নল ঠেকিয়ে যারা শাসন করে যাচ্ছে, তারা এদেশের আপনজন নয়। একদিকে চলছিলো বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ছয় দফার পক্ষে জনমত,অন্যদিকে চলছিলো স্বৈরশাসকের দমন পীড়ন নীতি। বঙ্গবন্ধু যেখানেই যেতেন সেখানেই গ্রেফতার করা হতো। বঙ্গবন্ধুর জীবনে ১৪ বার কারাবরণ করেছিলেন, তার মধ্যে ছয় দফা উথাপনের পর দুই মাসের ভেতর তাকে আটবার কারাবরণ করতে হয়। জীবনের সবচেয়ে দীর্ঘ কারাবরণও করতে হয় ছয় দফা উথাপনের ফলস্বরূপ। বঙ্গবন্ধু তবুও ছিলেন আপোষহীন। একদা তাঁকে বলা হয়েছিলো "তুমি যেই দাবি উথাপন করেছো তার জন্য তোমাকে ফাঁসিতে ঝুলতে হবে। "বাঙালির জন্য অন্তঃ প্রান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেদিন নির্ভীকচিত্তে বলেছিলেন "কেউ ফাঁসিতে না ঝুললে দাবি আদায় হবে কিভাবে।" দেশের বিভিন্ন স্থানে বঙ্গবন্ধুর বক্তব্যের ফলে ছয় দফার পক্ষে জনমত তুঙ্গে উঠে।

১৯৬৬ সালের ১৩ মে আওয়ামী লীগ আয়োজিত পল্টনের জনসভা থেকে ৭ জুন হরতাল কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। সামরিক জান্তা সরকারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে রাস্তায় কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, মজুরের ঢল নামে। ভেদাভেদ ভুলে সেদিন সবাই ছয় দফার পক্ষে একাট্টা ছিল। উপায়ন্তর না দেখে পাকিস্তানি জান্তাবাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরস্ত্র বাঙালির উপর। জান্তাবাহিনীর গুলিতে রক্তে রঞ্জিত হয় রাজপথ। নিহত হয় মনু মিয়াসহ ১১ জন। ছয় দফা দাবির প্রবক্তা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে দেওয়া হয় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। ছয় দফার পক্ষে জনমত আরো বাড়তে থাকে। পাকিস্তানি জান্তা সরকার আন্দোলনকারীদের বিচ্ছিন্ন আর বঙ্গবন্ধুকে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নেতা হিসেবে ঘোষনা দেয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বক্তব্য ছিল "আমরা সংখ্যায় ৫৬ ভাগ, সংখ্যাগুরু। আমরা বিচ্ছিন্ন হব কেন? আমরা ন্যায্য অধিকার চাই, স্বাধীনভাবে বাঁচতে চাই। যারা সংখ্যালঘু, তারা বিচ্ছিন্ন হতে পারে, সংখ্যাগরিষ্ঠরা নয়।"

আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। ছাত্ররা ৬ দফাসহ ১১ দফা দাবি পেশ করে। রাস্তায় রাস্তায় স্লোগান হতে থাকে "জেলের তালা ভাঙবো,শেখ মুজিবকে আনবো।" তারপরের ইতিহাস সবার জানা। আন্দোলন গনঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। আইয়ুব সরকারের পতন ঘটে, ৭০ এর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বিজয়ী বাঙালির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করায় শুরু হয় সর্বাত্মক আন্দোলন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবরের সাড়া দিয়ে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাঙালিরা অর্জন করে তাদের অধিকার,স্বাধীনতা।

বঙ্গবন্ধুকে ন্যাপ এর প্রধান অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ জিজ্ঞেস করেছিলেন "আপনি এইযে ছয় দফা দিলেন, তার মূল কথাটা কি?" আঞ্চলিক ভাষায় বঙ্গবন্ধু বলেন "আরে মিয়া বুঝলা না, দফা তো একটাই।" সেদিনের সুদুরপ্রসারি এক দফাঃ স্বাধীনতা, বাঙালিরা তাদের রক্তের বিনিময়ে অর্জন করে।

ইতিহাস পর্যালেচনা করলে আমরা দেখতে পাই বঙ্গবন্ধু ছয় দফা উথাপন না করলে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা হতো না,আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা না হলে গনঅভ্যুত্থান হতো না,গণঅভ্যুত্থান না হলে নির্বাচন হতো না,নির্বাচন না হলে স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ হতো না,আমরা স্বাধীনতা লাভ করতে পারতাম না।সবকিছুর মূলে ছয় দফা।তাইতো ছয় দফাকে বলা হয় বাঙালির ম্যাগনাকার্টা / মুক্তির সনদ। আর এর উত্থাপক বঙ্গবন্ধুকে বলা হয় বাঙালি জাতির পিতা!

লেখকঃ শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত