কপ-২৬ সম্মেলন: পৃথিবী বাঁচাতে বাংলাদেশের হাতে তিন এজেন্ডা

1036

Published on অক্টোবর 28, 2021
  • Details Image

স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে ৩১ অক্টোবর শুরু হতে যাচ্ছে জলবায়ু সম্মেলন কপ-২৬। এ সম্মেলনের দিকে এখন চোখ পুরো বিশ্বের। জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ এ সম্মেলনে পা রাখবে তিন এজেন্ডা নিয়ে। নিজেদের পাশাপাশি জলবায়ু ঝুঁকি ফোরামের (সিভিএফ) প্রধান হিসেবেও সম্মেলনে ভূমিকা রাখবে বাংলাদেশ।

জলবায়ু সম্মেলনে বাংলাদেশের নেতৃত্ব দেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একই সঙ্গে তিনি জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ ৪৮টি দেশের প্রতিনিধিত্ব করবেন।

সম্মেলনে ঢাকার পক্ষ থেকে তিনটি দাবি তুলে ধরা হবে। মাত্র তিন মিনিটের বক্তব্যে প্রথম দাবিতে বাংলাদেশ সর্বোচ্চ দূষণকারী দেশগুলোকে উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও কার্যকর এনডিসি দিতে আহ্বান জানাবে। বাংলাদেশের দ্বিতীয় দাবি হবে জলবায়ু তহবিলের জন্য উন্নত দেশগুলোর বার্ষিক ১০০ বিলিয়ন ডলারের অঙ্গীকার পূরণ করা। তৃতীয় দাবিতে সবুজ প্রযুক্তি হস্তান্তরে এগিয়ে আসার জন্য উন্নত দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানানো হবে।

৩১ অক্টোবর শুরু হয়ে মোট ১৩ দিন চলবে এ সম্মেলন। এতে সহ-আয়োজক হিসেবে থাকছে ইতালি। কোভিড-১৯ মহামারির কারণে গত বছর এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়নি। এবারের আয়োজনে ১২০টি দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান বা তাদের প্রতিনিধিরা অংশ নেবেন।

এদিকে এ সম্মেলন শুরুর মাত্র দিন কয়েক আগে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ; যেখানে জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণের কারণে যে হারে দূষণ বাড়ছে তাতে চলমান শতাব্দীতে পৃথিবীর তাপমাত্রা ২ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়তে পারে। অথচ প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনে ঠিক হয়েছিল, তাপমাত্রা এক দশমিক পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধির মধ্যে আটকে রাখতে হবে।

বাংলাদেশ এ সম্মেলনে যে তিনটি দাবি জানাবে তার প্রথমটির প্রসঙ্গে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, প্রত্যেক দেশ একটা পরিকল্পনা জমা দেয়। সেখানে দেশগুলো উল্লেখ করে তারা কত বছরে কী পরিমাণ দূষণ কমিয়ে আনবে। কিন্তু বড় দূষণকারী দেশগুলো যে এনডিসিগুলো আহ্বান করে সেটা নিরাপদ জোনে থেকে করে। কেউই দূষণ কমানোর দিকে যাচ্ছে না। আমরা বলছি, যেসব দেশ বেশি দূষণ করছে তাদের কার্যকর এনডিসি দিতে হবে। এ দাবি আমরা জোরালোভাবে তুলে ধরব। প্রথম দাবির আগে একটা শর্ত হচ্ছে, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমিত রাখতে হবে।

দ্বিতীয় দাবি প্রসঙ্গে এ কর্মকর্তা জানান, ২০১৫ সালে প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী জলবায়ু তহবিলের জন্য উন্নত দেশগুলো বার্ষিক ১০০ বিলিয়ন ডলার দেওয়ার অঙ্গীকার করে। সে তহবিল থেকে অভিযোজন ও প্রশমনের মধ্যে ৫০:৫০ বিতরণ করতে হবে। কিন্তু তারা সেটা দিচ্ছে না। আমরা চাই উন্নত দেশগুলো তাদের অঙ্গীকার পূরণ করবে। এ তহবিল যেন নিশ্চিত করা হয় সেটারও জোরালো দাবি আমরা জানাব।

তিনি আরও বলেন, আমরা দূষণ করছি খুবই সামান্য। এটাও আমরা কমাতে চাই। কিন্তু সেজন্য উন্নত দেশগুলোর সহযোগিতা লাগবে। আমরা তাদের কাছে প্রযুক্তি চাই। তারা বলছে, কয়লাভিত্তিক জ্বালানি বন্ধ করতে হবে। এগুলো বন্ধ করতে হলে আমাদের অন্য প্রযুক্তিতে যেতে হবে। কিন্তু সেগুলো খুবই ব্যয়বহুল এবং আমাদের কাছে নেই। আমাদের অনুরোধ হচ্ছে, উন্নত দেশগুলো যেন আমাদের গ্রিন প্রযুক্তি সরবরাহ করে; যেন সেটা আমরা খুব কম অর্থে পেতে পারি। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, নদীর ভাঙন, বন্যা ও খরার কারণে বাস্তুচ্যুত মানুষদের পুনর্বাসনের দায়িত্ব উন্নত দেশগুলোকে নিতে হবে। এগুলো বাংলাদেশ ও সিভিএফেরও দাবি। আমরা এসব তুলে ধরব।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ২০১৫ সালের প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনের পরে এবারের কপ-২৬ সম্মেলন জলবায়ু ইস্যুতে সবচেয়ে বড় সম্মেলন। শীর্ষ নেতারা এ সম্মেলনে নতুন কী কী সিদ্ধান্ত নেন সেটার ওপর নজর থাকবে জলবায়ুর প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত উন্নয়শীল দেশগুলোর। তাছাড়া উন্নত দেশগুলো জলবায়ু ইস্যুতে পুরনো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে কতটুকু কার্যকর ভূমিকা রাখার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করে তাতে নজর থাকবে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর।

জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, ‘আমরা খুবই আশাবাদী। আশা করছি, এবারের কপ-২৬ সম্মেলনে জলবায়ু ইস্যুতে কিছু কার্যকর পদক্ষেপ দেখতে পাব। এ সম্মেলন নিয়ে আমরা আশাবাদী এজন্য যে, এবার এটার আয়োজন করছে ব্রিটিশরা। প্রথমত, তারা (ব্রিটিশ) জলবাযু নিয়ে খুব সংবেদনশীল। দ্বিতীয়ত, বাইডেন প্রশাসন সেখানে থাকছে এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। বাংলাদেশ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সুন্দর পৃথিবী চায়। সেজন্য আমাদের চাওয়া বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমিত রাখা। প্রত্যেক দূষণকারী দেশকে অবশ্যই কার্যকর এনডিসি দিতে হবে। প্যারিস চুক্তিতে জলবায়ু তহবিলের জন্য উন্নত দেশগুলোর বার্ষিক ১০০ বিলিয়ন ডলারের অঙ্গীকার পূরণ করতে হবে। সেই অর্থ থেকে আমরা অভিযোজন ও প্রশমনে ৫০:৫০ কাজে লাগাতে চাই। জলবায়ুর প্রভাবে যারা উদ্বাস্তু হচ্ছে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। আমরা অধিক পরিমাণে নবায়নযোগ্য জ্বালানি চাই, সবুজ প্রযুক্তি চাই; উন্নত দেশগুলোকে এগুলোতে সহযোগিতা করতে হবে।

ড. মোমেন বলেন, ‘সিভিএফ প্রেসিডেন্ট হিসেবে আমরা উন্নয়শীল দেশগুলোর জন্য আরও বিনিয়োগ চাই। আমাদের আশা কপ-২৬ এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। সেটা খুব দ্রুতই নেবে। আগামীকাল নয়, আজই নিতে হবে।’

জাতিসংঘের উদ্যোগে ১৯৯৫ সালে শুরু হয় কপ সম্মেলন। ১৯৯৯ সালে ব্রাজিলের রিও ডি জেনেরিতে কপের জলবায়ু সম্মেলনে ‘জলবায়ু পরিবর্তন’ ইস্যুটি প্রথমবারের মতো সামনে আসে। এবার কপ-২৬ অনুষ্ঠিত হচ্ছে। পরবর্তী তথা আগামী বছর কপ-২৭ সম্মেলন হবে আফ্রিকার দেশ মিসরে। ২৮মত কপ অনুষ্ঠিত হবে এশিয়ায়, এতে দুটো দেশ দক্ষিণ কোরিয়া ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের নাম প্রস্তাবনায় রয়েছে। যেকোনো একটি দেশ এশিয়ার হয়ে কপ-২৮ সম্মেলন আয়োজনের দায়িত্ব পাবে।

জলবায়ু ঝুঁকি ফোরাম (সিভিএফ) কপ-২৬-এর ফাঁকে স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে আগামী ২ নভেম্বর একটি উচ্চপর্যায়ের ইভেন্টের আয়োজন করা হচ্ছে। সেখানে সিভিএফ প্রেসিডেন্ট হিসেবে নেতৃত্বে দেবেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এতে সিভিএফের ৪৮টি দেশের প্রতিনিধি অংশ নেবেন। 

গ্লাসগোতে কপ-২৬ সম্মেলনে নিজেদের যেসব দাবিদাওয়া তুলে ধরবে বাংলাদেশ সেগুলো যেন সফল হয় তার জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নকে (ইইউ) পাশে চায় ঢাকা। এ নিয়ে সম্মেলনের ১৩ দিন আগে গত ১৭ অক্টোবর ঢাকায় নিযুক্ত ইইউভুক্ত দেশগুলোর রাষ্ট্রদূতদের নিয়ে বৈঠক করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এ প্রসঙ্গে ড. মোমেন বলেন, ‘আমরা কপ-২৬ এ যাওয়ার আগে ইইউয়ের সহযোগিতা চেয়েছি। তাদের বলেছি, আমাদের সমর্থন দিতে। রাষ্ট্রদূতরা জানান, তারা নিজ নিজ দেশে আমাদের বার্তা পৌঁছে দেবেন। এছাড়া তারা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় আমাদের সঙ্গে কাজ করতে রাজি আছেন।’

গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণের কারণে দূষণ যেভাবে হচ্ছে তাতে চলমান শতাব্দীতে পৃথিবীর তাপমাত্রা ২ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়তে পারে। গতকাল মঙ্গলবার (২৬ অক্টোবর) এক রিপোর্টে এ তথ্য জানিয়েছে জাতিসংঘ। তাপমাত্রা বৃদ্ধির বিষয়টিকে ‘বিপর্যয়কর’ বলেও উল্লেখ করেছে সংস্থাটি ।

প্রতিবেদনে জলবায়ু-সম্পর্কিত বিপদের কারণে মোট বার্ষিক গড় ক্ষয়ক্ষতির তথ্যও উল্লেখ করা হয়েছে। ডব্লিউএমও বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে চীনের আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ২৩৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এরপরই ভারত ৮৭ বিলিয়ন, জাপান ৮৩ বিলিয়ন এবং দক্ষিণ কোরিয়া ২৪ বিলিয়ন ডলার ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে।

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত