বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ

13745

Published on জুলাই 23, 2019
  • Details Image

ড. মো. আনিসুজ্জামানঃ

যুদ্ধকালীন ও যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন বাঙালি জাতির এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা। মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকার গঠন, সেই সরকারকে সঠিক পরিকল্পনা এবং নির্দেশনা দিয়েছেন তাজউদ্দীন আহমদ। বঙ্গবন্ধুর নামে পরিচালিত সরকারে তাঁর নেতৃত্বে ৯ মাসে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। তিনি ছিলেন সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা এবং স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির আশ্রয়স্থল।

২৫ মার্চ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ৩২ নম্বরের বাসভবন থেকে রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তুলে নিয়ে যায়। এই দিন সন্ধ্যায় তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর শেষ দেখা হয়েছিল। তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে ছিলেন ডক্টর কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলাম। তাজউদ্দীন আহমদ বঙ্গবন্ধুর বাসা থেকে ফিরে ২৭ নম্বরের বাসায় এসে প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস বাজারের ব্যাগে নিয়ে বাড়ি থেকে অজানার উদ্দেশে বের হন। সঙ্গে ছিলেন ব্যারিস্টার আমীর-উল- ইসলাম। যাওয়ার সময় স্ত্রী সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনকে লিখে যান সাত কোটি বাঙালির সঙ্গে মিশে যাওয়ার জন্য এবং শেষে লেখেন বিজয় অনিবার্য। তাজউদ্দীন আহমদের আত্মবিশ্বাস ছিল বাঙালির জয় হবেই। আত্মবিশ্বাসী মানুষের সংকল্প দৃঢ় হয়। তাঁর সংকল্প দৃঢ় ছিল এবং সেই অনুসারে পরিকল্পনা করেছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি পরিকল্পনামন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি তাজউদ্দীন আহমদের অনন্য সৃষ্টি।

তাজউদ্দীন আহমদ মানুষকে ভালোবাসতেন। মানুষের ওপর তাঁর আস্থা ছিল। মানুষকে তিনি শত্রু মনে করতেন না। চরম শত্রুকেও তিনি আপন করে নিয়েছেন। যুদ্ধ চলাকালে খন্দকার মোশতাকপন্থীদের অবস্থান সম্পর্কে তাজউদ্দীন আহমদের ধারণা ছিল সুস্পষ্ট। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিরোধী শিবির সম্পর্কে তিনি স্পষ্টই জানতেন। কাউকে দূরে সরিয়ে দিয়ে নয়; বরং কাছে রেখে একসঙ্গে পথ চলে স্বাধীনতা অর্জনই ছিল তাঁর অভীষ্ট লক্ষ্য। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক শত্রু শিবিরকে দক্ষতার সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদ মোকাবেলা করেছেন। শুধু শত্রু শিবিরকে মোকাবেলা নয়, সেই সঙ্গে দৃঢ় সংকল্প নিয়ে যুদ্ধ পরিচালনা করা, যুদ্ধের অর্থ ও রসদ সংগ্রহ করা, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবাদান, যুদ্ধশেষে রাষ্ট্র গঠনে তাঁর পরিকল্পনা এবং কর্মযজ্ঞের কোনো কমতি ছিল না। এসবের মূলে ছিল তিনি মানুষ ভালোবাসতেন। মানুষকে বিশ্বাস করতেন। মানুষের ওপর তিনি কখনো আস্থাহীন হননি। মানুষ সম্পর্কে তাজউদ্দীন আহমদের কোনো নেগেটিভ বক্তব্য পাওয়া যায় না। তাজউদ্দীন আহমদের মানুষ কোনো একক মানুষ নয়, সামগ্রিক মানুষ। এই মানুষ চণ্ডীদাসের ‘সবার ওপর মানুষ সত্য’ সেই মানুষ। তাজউদ্দীন আহমদের মানুষও ছিল সবার ওপর সত্য। গ্রিক দার্শনিক প্রোটাগোরাস বলতেন, মানুষই সব কিছুর পরিমাপক। তাজউদ্দীন আহমদও বিশ্বাস করতেন মানুষই সব কিছু নির্ধারণ করে। ভবিষ্যতের পথরেখা মানুষই নির্ধারণ করে। আর সে কারণেই তিনি আগামী দিনের সূর্যোদয়ের স্বপ্ন দেখতেন।

গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস বলতেন, মানুষ শুধু গ্রিক নগর রাষ্ট্রগুলোর সদস্য নয়। এই মানুষ এথেন্স বা স্পার্টারও শুধু নাগরিক নয়। মানুষ হলো মহাবিশ্বের সদস্য। মানুষের চিন্তা-চেতনাকে তিনি গ্রিক দেব-দেবীর ঊর্ধ্বে স্থান দিয়েছিলেন। মানুষকে মানুষ হিসেবে মর্যাদা দেওয়ায় দাস মালিকদের পক্ষ থেকে সক্রেটিস সমালোচিত হয়েছিলেন এবং বিচারে দণ্ডিত হয়েছিলেন। তাজউদ্দীন আহমদ বাঙালিকে বিশ্বনাগরিকের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। ভীতু, কাপুরুষোচিত বাঙালিকে তিনি আত্মমর্যাদায় বলীয়ান বীরের জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। বিশ্বের বুকে বাঙালিকে নিজস্ব রাষ্ট্র গঠনে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। স্বাধীন রাষ্ট্র ছাড়া কোনো জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন হয় না। কোনো জাতি আত্মমর্যাদাসম্পন্ন হয় না। তাজউদ্দীন আহমদ তা ভালো করেই বুঝেছিলেন।

২৫ মার্চ থেকেই স্থানীয় পর্যায়ে প্রতিরোধ যুদ্ধ চলছিল। পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর আক্রমণের ভয়ে অনেকেই প্রতিবেশী দেশে চলে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মী সীমানার ওপারে আশ্রয় নিয়েছিল। তাজউদ্দীন আহমদ সীমান্তে যাওয়ার পর ভারত সরকারের প্রতিনিধি তাঁকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় গ্রহণ করে। তখনও সঙ্গে ছিলেন ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলাম।

যুদ্ধ চলাকালে তাজউদ্দীন আহমদের প্রথম এবং সফল কাজ ছিল নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সরকার গঠন করা। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি বাংলাদেশের মাটিতে বাংলাদেশ সরকার গঠন করেন। এই সরকারের নেতৃত্বেই মুক্তিযুদ্ধের বিজয় অর্জিত হয়। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালের পর এই সরকারই ঢাকায় স্থানান্তরিত হয়। এই সরকারই বাংলাদেশের প্রথম সরকার।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে দেশের লাখ লাখ মানুষ ঘরবাড়ি ছাড়া। এক কোটির ওপরে মানুষ শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছিল। এই সময় কোনো মানুষই সংসারধর্ম পালন করতে পারেনি। তাজউদ্দীন আহমদও সংসারধর্ম পালন করেননি। তিনি রাতদিন কাজ করতেন। প্রধানমন্ত্রী নিজের কাপড় নিজে পরিষ্কার করতেন। তাঁর সহকারী অসুস্থ হলে তিনি নিজেই সেবাযত্ন করেছেন। বর্তমানে উপজেলা পর্যায়ের কোনো নেতাকর্মী নিজের কাপড় নিজে পরিষ্কার করেন কি না সন্দেহ আছে। আমরা মাঝেমধ্যে বিভিন্ন মাধ্যমে দেখি বিদেশের কোনো মন্ত্রী-এমপি গণপরিবহনে চলাচল করছেন। সেই ছবি ফেসবুকে ভাইরাল হচ্ছে। অথচ আমরা কখনো ফেসবুকে দেখি না তাজউদ্দীন আহমদের সাধারণ কাজকর্মের কোনো ছবি। নিজের কাজ নিজে করার মধ্যে কোনো হীনম্মন্যতা নেই, তাজউদ্দীন আহমদ সেটা যুদ্ধকালেই প্রমাণ করেছেন। তাজউদ্দীন আহমদের জীবন দর্শনে দেখা যায় সব কাজকেই তিনি সমান গুরুত্ব দিতেন।

তাজউদ্দীন আহমদ বাঙালি জাতির জন্য একটি রাষ্ট্র গঠন করতে চেয়েছিলেন। স্বাধীন করা আর রাষ্ট্র গঠন করা এক নয়। রাষ্ট্র গড়ে তুলতে হয়। একাত্তর সালে রক্ত দিয়ে বাঙালি রাষ্ট্র অর্জন করেছে। কিন্তু রাষ্ট্রটি গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয় স্বাধীনতার পর। বাহাত্তরে রাষ্ট্র গঠনের জন্য সংবিধানে চার মূলনীতি গৃহীত হয়। চার মূলনীতি কয়েকজন মানুষ ঘরে বসে নির্ধারণ করেননি। কোনো বিশেষ মানুষের পরিকল্পনায় চার মূলনীতি সংবিধানে স্থান পায়নি। জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র হলো এ দেশের মানুষের দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের ফসল। এই চারটি আদর্শের ওপর ভিত্তি করে দেশ স্বাধীন হয়েছে। সংবিধানের চারটি মূলনীতি গ্রহণের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতিরাষ্ট্র গঠনের যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল পরবর্তীকালে সেখানেও ভাটা পড়ে। ফলে রাষ্ট্রটি স্বাধীন ভূখণ্ডের ওপর দাঁড়িয়ে থাকল ঠিকই কিন্তু রাষ্ট্রের অন্য আদর্শিক চরিত্রগুলো ক্রমেই দুর্বল হতে থাকে। রাষ্ট্রের দুর্বল দিকগুলো স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও সবল হয়নি। এক দিক থেকে যদি ঠিক করা হয় অন্যদিকে ঘুণে ধরে, যার মাসুল দিচ্ছে দেশের সাধারণ শ্রমজীবী মানুষ।

দেশে উন্নয়ন হচ্ছে। নতুন নতুন রাস্তাঘাট, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে। পদ্মা সেতু, মেট্রো রেলের কাজ এগিয়ে চলেছে। লোকসান সত্ত্বেও সময়মতো রেলগাড়ি ছেড়ে যাচ্ছে। অর্থনীতির চাকা ঘুরছে। বিশ্বের নামিদামি দোকানে বাংলাদেশের পোশাক। আম থেকে শুরু করে জাহাজ—আমরা সবই রপ্তানি করছি। আমেরিকার বাজারে যাচ্ছে বাংলাদেশের ওষুধ। অথচ ৪০ বছর আগেও বিদেশি ওষুধের ওপর আমরা নির্ভরশীল ছিলাম। কিন্তু আমদানি নির্ভরশীলতা কমেনি। সুচ থেকে শুরু করে গাড়ি, কল-কারখানার যন্ত্রপাতি সবই আমদানি হচ্ছে। দক্ষ জনশক্তিও আমদানি হয়। আমাদের গৌরব নিয়ে প্রতিনিয়ত তকমা বাজাচ্ছি। কিন্তু আমরা কী করতে পারি এ নিয়ে কোনো উদ্যোগ নেই। যথাযথ উদ্যোগ ও পরিচর্যার অভাবে হারিয়ে যায় বহু সম্ভাবনাময় তরুণ। দেশের চাহিদা অনুসারে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার উপযুক্ত প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। দক্ষ জনশক্তির জন্য অবকাঠামো এবং উপরি কাঠামো কোনোটিই চোখে পড়ার মতো নয়। নতুন নতুন জ্ঞান সৃষ্টির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান প্রায় শূন্যের ঘরে। মানববিদ্যার অবস্থা শোচনীয়। অথচ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ একটি আদর্শিক রাষ্ট্র গড়ে তোলার জন্য মানববিদ্যা অপরিহার্য। নীতি, নৈতিকতা, আদর্শবাদিতায় সমৃদ্ধ না হলে শুধু প্রযুক্তিনির্ভর কোনো সমাজে উন্নয়ন স্থায়ী হয় না।

তাজউদ্দীন আহমদ বাঙালিদের বাসযোগ্য একটি আদর্শ রাষ্ট্র নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন। যুদ্ধকালীনই তিনি রাষ্ট্র নির্মাণের পরিকল্পনা তৈরি করেছিলেন, যা স্বাধীনতার পর সীমিত সুযোগ ও অপ্রতুল সম্পদের ওপর নির্ভর করে ধীরে ধীরে বাস্তবায়নের দিকে নিয়ে যাচ্ছিলেন। তাজউদ্দীন আহমদের রাষ্ট্র নির্মাণের পরিকল্পনা শুরুতেই হোঁচট খায়। ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতি থেকে তিনি দূরে সরে যান। অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব থেকেও তাঁকে পদত্যাগ করতে হয়। বাকশালেও তিনি ছিলেন সাধারণ সদস্য। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট তিনি শুধু একজন সাধারণ দলীয় এমপি, তার পরও বাংলাদেশবিরোধী শক্তি তাজউদ্দীন আহমদকে নিরাপদ মনে করেনি। প্রথমে তাজউদ্দীন আহমদকে গ্রেপ্তার ও পরে পরিকল্পিতভাবে জেলখানায় হত্যা করে। বাংলাদেশের সপক্ষের শক্তি তাজউদ্দীন আহমদের বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনার মূল্যায়ন না করলেও বিরোধী শক্তি জানত একমাত্র তাজউদ্দীন আহমদই বাঙালি রাষ্ট্র গঠনে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন। ৩ নভেম্বরে জাতীয় চার নেতাকে জেলখানায় পরিকল্পিতভাবে হত্যার মধ্য দিয়ে শুধু কয়েকজন মানুষকে সরিয়ে দেওয়া হয়নি, বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনাকেও হত্যা করা হয়।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

সৌজন্যেঃ দৈনিক কালের কণ্ঠ

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত