বঙ্গবন্ধুর পাইপ, চশমা, বাগ্মিতা

5037

Published on অক্টোবর 4, 2020
  • Details Image

সৈয়দ বদরুল আহসানঃ

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন আমাদেরই একজন। বড় পরিসরে ইতিহাসের অংশ হলেও তিনি আমাদেরই অংশ।

পাইপ ছিল তার ট্রেডমার্ক। তিনি যেখানেই (কারাগার, বাড়ি, সংবাদ সম্মেলন কিংবা বিদেশি সরকারপ্রধানদের সঙ্গে বৈঠক) থাকুন না কেন, পাইপ ছিল তার নিত্যসঙ্গী। প্রিয় ওই পাইপটিতে এরিনমোর তামাক ভরতেন বঙ্গবন্ধু । ১৯৭২ সালের শুরুতে নামী ব্রিটিশ টেলিভিশন উপস্থাপক ডেভিড ফ্রস্টের সঙ্গে আলাপচারিতায় নিজ জীবনে পাইপের গুরুত্ব তুলে ধরেছিলেন তিনি।

নিজস্ব স্টাইলে সে পাইপ দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তেন বঙ্গবন্ধু, যাতে ফুটে উঠত তার ব্যক্তিত্বের বিশালতা। ইতিপূর্বে উল্লেখিত তার বিশাল ব্যক্তিত্বের সঙ্গে পাইপ শুধু ভিন্ন মাত্রা যোগ করত। পাইপটি ছিল একজন রাষ্ট্রনায়কের সঙ্গে মানানসই আভিজাত্যের এক ঝলক। এটি এমন এক অভ্যাস যা শুধু মুজিব ব্যক্তিত্বের সঙ্গেই খুব ভালোভাবে যেত।

গড়পরতা বাঙালিদের চেয়ে বেশি উচ্চতা (ছয় ফুটের বেশি) ও ঘন গোঁফ জনগণের কল্পনায় আটকে রাখত বঙ্গবন্ধুকে। অন্যদিকে দরাজ কণ্ঠ ও পুরনো ফ্রেমের চশমা তার ব্যক্তিত্বে ভিন্ন মাত্রা যোগ করত। বাঙালি জাতির নেতা দেশ-বিদেশের শ্রোতাদের মন্ত্রমুগ্ধ করতেন।

১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে লন্ডন থেকে দেশে ফেরার পথে দিল্লিতে বিরতি নেন বঙ্গবন্ধু। ৯ মাসের যুদ্ধ শেষে স্বাধীন বাংলাদেশে ফেরার পথে তাকে দেখতে আসেন বিপুলসংখ্যক ভারতীয় জনতা। তাদের উদ্দেশে বক্তব্য দেন বঙ্গবন্ধু, যার শুরুটা করেছিলেন ইংরেজিতে।

সে সময় উপস্থিত জনতা (যাদের বেশিরভাগই অবাঙালি) বাংলায় তার বাগ্মিতা দেখতে উন্মুখ ছিলেন। জনগণের চাওয়ার বিষয়টি বুঝতে পেরে বঙ্গবন্ধুকে মাতৃভাষা বাংলায় ভাষণ দিতে অনুরোধ করেন ইন্দিরা গান্ধি। ফল হলো রাজনীতি, সংগ্রামী দেশ, পরাধীনতার নাগপাশ থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করতে ভারতের অবদান নিয়ে তার অনর্গল বক্তৃতা।

মুজিব স্বরূপের সবটা ছিল এ বক্তৃতায়। সংবাদপত্র, রেডিও বা টেলিভিশন ছাড়াই পাকিস্তানে প্রায় ১০ মাসের নিঃসঙ্গ কারাবাসও রাজনৈতিক বক্তৃতায় তার আগ্রহে এতটুকু ভাটা ফেলেনি।

তিনি বলছিলেন কোনো নোট ছাড়াই, যেটা তিনি সবসময়ই করতেন। স্ক্রিপ্ট ছাড়া তার এ বক্তব্যই মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতেন শ্রোতারা। এটি তার স্বভাবেরই অংশ। বক্তৃতাই ছিল তার সব।

ঋজুভাবে দাঁড়িয়ে মাথা এপাশ-ওপাশ করে যখন তিনি বক্তব্য দিতেন, তখন মনে হতো উপস্থিত সবাই তার নজরসীমায়; প্রত্যেকেই অনুষ্ঠানের অংশ। এরপর বক্তৃতার ফাঁকে ফাঁকে কোনো বিষয়ে জোর দিতে তিনি তর্জনী উঁচু করে তুলে ধরতেন।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চের জনসমাবেশে সে আঙুল উঁচিয়ে ধরাটা ছিল তার সাহসিকতা ও দৃঢ়তার প্রতীক। এই আঙুল একই সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর শরীরী ভাষারও গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

কোনো দর্শনার্থী বা উপস্থাপকের সঙ্গে আলাপকালে চোখে চোখ রেখে কথা বলতেন বঙ্গবন্ধু। এর মধ্যে থাকত না কোনো চাতুরি, দুর্বলতা বা লাজুকতা।

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার কিছুদিনের মধ্যে ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাওয়ালপিন্ডিতে অনুষ্ঠিত এক গোলটেবিল বৈঠকে নিজ উৎপীড়ক আইয়ুব খানের সঙ্গে হাত মেলানোর সময় তার চোখে চোখে তাকান বঙ্গবন্ধু। পাকিস্তানের ইতিহাসের নাটকীয় ওই মুহূর্তে মুজিবের সঙ্গে একপাল্লায় নিজেকে রাখতে পারেননি আইয়ুব।

আত্মবিশ্বাস ছিল মুজিব চরিত্রের সহজাত বৈশিষ্ট্য। ১৯৭৪ সালে হোয়াইট হাউজে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ডের সঙ্গে কথা বলার সময় পা আড়াআড়ি করে বসে পাইপ টানছিলেন তিনি। সেখানেও ছিল পুরানো কারিশমা। তার সে কারিশমা সবসময়ই ছিল, যার ব্যত্যয় দেখা যায়নি। যে ঘরেই তিনি পা রাখতেন, সেটিই আলোকিত হতো তার আলোয়।

আনুষ্ঠানিকতার কমই ধার ধারতেন তিনি; তার মধ্যে ছিল আলাপচারিতার প্রাবল্য। তিনি যেখানেই যান, সেখানেই ধ্বনিত হতো তার সুউচ্চ কণ্ঠস্বর। এ কণ্ঠে হাস্যরস যুক্ত হলে ফল হতো চমক জাগানিয়া।

মুজিবের রসবোধ ছিল কিংবদন্তিতুল্য। তিনি কৌতুক করতে পারতেন; অনুকরণ করতে পারতেন অন্য রাজনীতিকদের। হাসতেও জানতেন তিনি। আলাপের সময় ভেতর থেকে আসত তার উচ্চকিত হাসি। তার এ হাসি ছিল খুবই সহজাত।

তিনি ছিলেন দলের প্রাণ। সাধারণ জনগণ থেকে শুরু করে বিখ্যাত রাজনীতিক ও রাষ্ট্রনায়করা বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে স্বস্তি বোধ করতেন। তার হাস্যরস, সদালাপ, প্রজ্ঞায় স্বস্তিবোধ করত উপস্থিত লোকজন।

তিনি একই সঙ্গে ছিলেন জাতির পিতা, প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্ট। কিন্তু আশপাশের সবাই, বাংলাদেশের সব নাগরিকের কাছে তিনি ছিলেন শেখ সাহেব বা মুজিব ভাই বা 'আমাগো মুজিবর'।

দেশে বড় পরিসরে তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধু। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ও নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর মতো উচ্চাসন পেয়েছিলেন তিনি। এ দুজনের প্রতিই হৃদয়ের গভীর থেকে ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা ছিল তার।

উল্লিখিত তিনজনই ছিলেন বাঙালি। তিনজনই ছিলেন অকপট, যেটা বাঙালি অনেক রাজনীতিকের মধ্যে ছিল।

সংগীতে অনুরাগ ছিল বঙ্গবন্ধুর। সংগীতে রাজনীতির নিগূঢ় অর্থ খুঁজতেন তিনি। এ অর্থ আসত রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের কাছ থেকে। 'আমার সোনার বাংলা' তার হৃদয়ের গভীরে প্রোথিত ছিল। নজরুলের বিদ্রোহী গানগুলো ছিল তার রাজনীতির অংশ।

নৌকায় করে বিভিন্ন প্রান্তে যাওয়ার সময় বাংলাদেশের নদীগুলোতে সুরের মূর্ছনা খুঁজে পেতেন তিনি। শত শত গ্রাম চষে বেড়ানোর সময় তিনি বুঝেছিলেন, সংগীতে উঠে আসছে বঞ্চিত মানুষের মুক্তির কথা। তিনি ছিলেন কবি, যিনি সেই সুরের কথা জুগিয়েছিলেন।

শেখ মুজিবুর রহমান মানুষকে সম্মান করতেন। শিক্ষক, বিশেষজ্ঞ ও অন্য অনেককে শ্রদ্ধা দেখাতে গিয়ে তিনি উঠে দাঁড়াতেন। তার অফিস কক্ষটি বিভিন্ন ধরনের মানুষের জমায়েত ও নানা ধারণা বিনিময়ের কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। তার কাছে আসা মানুষদের মধ্যে বিশাল ব্যক্তিত্ব ও বিনয়ী লোকজন ছিলেন।

গণমানুষের নেতা হিসেবে তিনি শ্রেণি-পেশায় ভেদাভেদ করতেন না। বিনয় ছিল তার শক্তি।

তেমনই এক মানুষ বঙ্গবন্ধু। নিজ বাড়িতে গেঞ্জি ও লুঙ্গি পরে খেতে বসা তার ছবিটি ভালোভাবে খেয়াল করলে সে চরিত্র খুঁজে পাওয়া যাবে। ছবিটি একজন লক্ষ্যাভিমুখী, প্রত্যয়ী বাঙালির, যাকে আপনি পাবেন প্রতিদিনকার যাপনে। নিজের মধ্যেই ব্যক্তিটিকে খুঁজে পাবেন।

আমাদের সবাইকে এক সুতোয় গেঁথেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান।

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, লেখক, গবেষক

সৌজন্যেঃ নিউজবাংলা২৪

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত