ভুট্টোর শেষ অনুরোধ

1325

Published on জানুয়ারি 9, 2022
  • Details Image

জাহাঙ্গীর আলম সরকারঃ

১৯৭১ সালে বিজয় দিবসের ৪ দিন পরে ২০ ডিসেম্বর তারিখে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নুরুল আমিনের কাছে প্রেরিত এক বার্তায় জেনারেল ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তিদানের আভাস দেন। সেদিন জেনারেল ইয়াহিয়ার পদত্যাগ সংবাদ ঘোষিত হওয়া পর্যন্ত পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুর মুক্তি না দেওয়ার সিদ্ধান্তে অটল ছিল। (দি ফাইনান্সিয়াল টাইমস্, লন্ডন, ২১ ডিসেম্বর ১৯৭১)। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি লন্ডনে এক সাক্ষাৎকারের সময় বঙ্গবন্ধু ‘দি সানডে টাইমস্’ এর সংবাদদাতা অ্যান্থনী ম্যাসকারেনহাসকে বলেন, প্রতিশোধ গ্রহণের সর্বশেষ প্রচেষ্টা হিসেবে জেনারেল ইয়াহিয়া খান তাকে ফাঁসী দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু তার প্রতি কারা-রক্ষকদের সহানুভুতির ফলে সহসাই এই পরিকল্পনা কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধির বিশ্ব জনমত সৃষ্টি করে এবং ৯৩ হাজার পাকিস্তানী সৈন্যদের বন্দি করে একটি এমন পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছিলেন যাতে করে ভুট্টো বাস্তবতাকে অনুধাবন করে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরের দিন ইয়াহিয়া খান তথাকথিত রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে বঙ্গবন্ধুর বিচারকারী ট্রাইবুন্যাল সদস্যদের ডেকে নিয়ে তার ফাসীর রায় লিপিবদ্ধ করার নির্দেশ দেন। ১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত সেই রায় স্থগিত রাখায় হয়েছিলো। ঢাকায় পাকিস্তান সৈন্যবাহিনীর আত্মসমর্পণ অবশ্যম্ভাবী বলে বুঝতে পেরে তিনি ফাসীর রায় কার্যকর করার নির্দেশ দেন। তিনি তখন উদ্বেগ অস্থির ছিলেন। ঝোকের মাথায় তিনি ঘোষনা করেন- ‘এই লোকটিকে যেদিন আমি বন্দি করার হুকুম দিয়েছিলাম, সেই দিনই তাকে হত্যা করা উচিত ছিল। এখন তাকে ফাসী দাও’। তার নির্দেশ অনুযায়ী রাওয়ালপিন্ডি থেকে একটি সামরিক দল মিয়াওয়ালীর কারাগারের দিকে পাঠানো হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী তারা বঙ্গবন্ধুর ‘সেল’ এর পাশের ‘সেল’ এ একটি অগভীর কবর খোড়ে। তাকে বলা হয়, বিমান-আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার প্রস্তুতি হিসেবে এটি খোড়া হয়েছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু এর আসল উদ্দেশ্য জানতেন এবং তিনি চরম পরিণতির জন্য তৈরী ছিলেন। ইয়াহিয়া খানকে শীঘ্রই ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে বুঝতে পেরে এবং বঙ্গবন্ধুর প্রতি দয়া পরবশ হয়ে কারাগারের জনৈক অফিসার তাকে গোপনে কারাগারের অভ্যন্তরে নিজের বাড়ীতে নিয়ে দু’দিন লুকিয়ে রাখেন। এরপর সেই অফিসার তাকে একটি আবাসিক কলোনীর নির্জন এলাকায় সরিয়ে নিয়ে যান। সেখানে তাকে চার-পাঁচ কিংবা ছ’দিন রাখা হয়েছিল। (দি সানডে টাইমস্, লন্ডন, ৯ জানুয়ারি, ১৯৭২)। ফলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সেই যাত্রায় প্রানে বেচে যান।

জাতিসংঘের বিশেষ অধিবেশনে পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করার পর লন্ডন হয়ে ১৯৭১ সালের ২০ ডিসেম্বর সকাল বেলা জুলফিকার আলী ভুট্টো রাওয়ালপিন্ডিতে ফিরে যান। ২১ ডিসেম্বর তিনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ গ্রহণ করেন। সেদিন সন্ধ্যাবেলা বিদেশী কূটনীতিবিদ ও সাংবাদিকদের জন্য আয়োজিত এক অভ্যর্থনা অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, শেখ মুজিবকে শীঘ্রই কারামুক্তি দিয়ে গৃহবন্দী করে রাখা হবে। (দি ফাইনান্সিয়াল টাইমস, ২২ ডিসেম্বর, ১৯৭১)। ইয়াহিয়া খানের কাছ থেকে প্রেসিডেন্ট হিসাবে ক্ষমতা গ্রহণের পর বঙ্গবন্ধুকে হত্যার জন্য নিয়োজিত সৈন্যদল ফাসীর আদেশ পুনরায় বৈধ করার জন্য ভুট্টোকে অনুরোধ জানায়। তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। (দি সানডে টাইমস্, লন্ডন, ২৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১)। ১৯৭১ সালের ২৭ ডিসেম্বর রাত্রিবেলা সাংবাদিকের সঙ্গে আলোচনাকালে ভুট্টো বলেন, আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তিনি আলোচনা শুরু করেছেন। শেখ মুজিবকে তিনি ‘পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচিত নেতা’ হিসেবে উল্লেখ করেন। রাওয়ালপিন্ডি থেকে প্রেরিত উল্লিখিত সংবাদে ‘দি গার্র্ডিয়ান’ এর সংবাদদাতা মার্টিন উলাকোট বলেন- পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে সর্ম্পক বজায় রাখা সম্বন্ধে কোনো রকম প্রতিশ্রুতি না দিয়েই কিংবা মামুলি আশ্বাস দিয়ে কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই শেখ মুজিব ঢাকার পথে রওয়ানা হবেন বলে কোনো কোনো কূটনীতিবিদ মনে করেন (দি গার্ডিয়ান, ২৮ ডিসেম্বর, ১৯৭১)। নয়াদিল্লী থেকে প্রেরিত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়, ২৪ ডিসেম্বর ভুট্টোর ও শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় (দি টাইমস, লন্ডন, ২৮ ডিসেম্বর, ১৯৭১)। ১ জানুয়ারি, ১৯৭২ সালে মার্কিন সাপ্তাহিক ‘টাইম’ পত্রিকা সূত্রে প্রাপ্ত এক সংবাদে বলা হয়, আগামী দু’এক দিনের মধ্যে বাংলাদেশের বন্দি নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দেওয়ার কথা প্রেসিডেন্ট ভুট্টো বিবেচনা করছেন। ওয়াশিংটন থেকে প্রেরিত এই সংবাদটি ‘দি সানডে টাইম্স’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সাপ্তাহিক ‘টাইম’ প্রদত্ত সংবাদে ভুট্টোর বক্তব্য উদ্ধৃত করে বলা হয়, শেখ মুজিবের হৃদয়ে এখনো পর্যন্ত পাকিস্তানের আগুন জ্বলজ্বল করছে- এই আশা ও বিশ্বাস নিয়ে তিনি তাকে দ্’ুএকদিনের মধ্যে নি:শর্ত মুক্তিদানের কথা ভাবছেন। ভুট্টো বলেন- ‘আমি তার থেকে কেনো প্রতিশ্রুতি আদায় করছি না। তার উপর চাপ প্রয়োগ করে আমি আলোচনা চালাচ্ছি না, বরং পাকিস্তানের দু’অংশে নির্বাচিত নেতাদের মধ্যেই এই আলোচনা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। “অত্যন্ত ঢিলেঢালা একটা ব্যবস্থা সর্ম্পকে একমত হওয়া সম্ভব, কিন্তু পাকিস্তানের নামটি অন্তত:পক্ষে থাকা উচিত। এটা উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত আমাদের হাজার বছরের সম্পদ এবং আমরা তা বিসর্জন দিতে পারি না।’ ব্রিটিশ লেখক রবার্ট পেইন তার একটি গ্রন্থে বাংলাদেশ ভবিষ্যতে পাকিস্তানের সঙ্গে সর্ম্পক বজায় রাখবে কি-না, সে সম্বন্ধে জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে বঙ্গবন্ধু ও ভুট্টোর কথোপথকন বিস্তাবিতভাবে উল্লেখ করেছেন। ভুট্টো বঙ্গবন্ধুকে বলেন- ‘প্রথম জিনিস সর্ম্পকে আমাদের প্রথমেই আলাপ করা উচিত। আমাদের দুটি পৃথক জাতি হওয়া চলবে না, শেখ সাহেব। যেমন করেই হোক আমাদের সর্ম্পক বজায় রাখতেই হবে, অবশ্য ঠিক আগের মতো নয়, তবে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান বলে চেনা যায়, এমন একটি দেশ হিসেবে। আর যাই হোক, আমাদের ধর্ম এক, উদ্দেশ্যেও এক। দেখুন, শেখ সাহেব, সবকিছুর পরেও আমরা এখনও এক জাতি-সেই সত্যের মুখোমুখি আমরা হয়েছি। আমাকে বিশ্বাস করুন, আমরা এই বন্ধন ছিন্ন করতে পারি না। একথা আমাদের উভয়ের ভাবা উচিত। অবশ্য পশ্চিম পাকিস্তানে বসে একথা আমাদের আলোচনা করতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। আমরা একটা নিরপেক্ষ দেশে আলোচনার জন্য মিলিত হতে পারি’।

এখন আমরা যেমন মিলিত হয়েছি ব্যঙ্গোক্তির অভাস দিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান বলেন। ‘ঠিক তাই, আমি আপনার সঙ্গে একমত। কোনো রকম বাধা-বিপত্তি ছাড়া আমরা এখানে কাজটা সেরে ফেলতে পারি। জুলফিকার আলী ভুট্টো বঙ্গবন্ধুকে বলেন- আপনি ও আমি, আমার দুজনে নীতি সম্পর্কিত একটি বিবৃতি তৈরী করতে পারি। আমরা ব্যাপারটার চূড়ান্ত সমাধান করতে পারি। আমি একটা খসড়া তৈরী করেছি। আপনার তা পছন্দ হবে বলে আমি মনে করি। আপনাকে আমি এটা দেখাতে চাই।
বঙ্গবন্ধু জবাবে বলেন- ’না।’
ভুট্টো বলেন- ’কেন নয়?’
বঙ্গবন্ধু বলেন- ‘কারণ, আমি এখনও পর্যন্ত আপনার বন্দি। আমার মন্ত্রীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা না করে কীভাবে, আমার সামনে আপনি যে কাগজের টুকরো রেখেছেন, তাতে আমি দস্তখত করতে পারি? আপনার ইচ্ছা পুরনের জন্য আপনি আমাকে জোর করে রাজী করানোর চেষ্টা করছেন। আপনি আমাকে গুলি করতে পারেন, কিন্তু ঢাকায় গিয়ে আমার মন্ত্রীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ না হওয়া পর্যন্ত আমি কোনো কাগজে দস্তখত দেবো না।’

ভুট্টোর শেষ অনুরোধ- “একটি অখন্ড এবং অবিভাজ্য পকিস্তান গঠনের ব্যাপারে আপনি কি আমাকে সাহায্য করবেন, নাকি করবেন না? শেখ মুজিব খানিকটা নিরব নীরব থাকেন। (The Tortured and the Damned, P. 146) সাবেক ভারতীয় কূটনীতিবিদ শশাঙ্ক এস. ব্যানার্জী তার ‘এ লং জার্নি টুগেদার ইন্ডিয়া, পাকিস্তান অ্যান্ড বাংলাদেশ গ্রন্থে বলেন- কারামুক্তির পর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাতকালে ভুট্টো তাকে পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সংবর্ধনা জানান। তার উক্তির প্রতিবাদ করে শেখ মুজিব বলেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের নয়, বরং সারা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন। ভুট্টো তার চালাকিপূর্ণ মন্তব্য পরিহার করে অবশেষে পরিষ্কার ভাষায় বলেন, পূর্ব পকিস্তান বাংলাদেশে পরিণত হয়েছে এবং তিনি (শেখ মুজিব) ঢাকায় গিয়ে নতুন জাতির নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন। বিদায় দেওয়ার আগে ভুট্টো অত্যন্ত সর্তকতার সঙ্গে শেখ মুজিবের কাছ থেকে জানতে চান, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান মৈত্রীবদ্ধ রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মাধ্যমে একত্রিত হওয়ার ধারণার প্রতি তিনি বিরূপ কিনা। শেখ মুজিব বুদ্ধিমানের মতো তার মনোভাব প্রকাশ না করার সিদ্ধান্ত নিয়ে উত্তর দানে বিরত থাকেন। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি লন্ডন থেকে দিল্লী হয়ে বিমানযোগে ঢাকায় যাওয়ার পথে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তার সহযাত্রী ব্যানার্জীর কাছে উল্লিখিত কথোপকথন বর্ণনা করে উচ্চ হাসিতে ফেটে পড়েন। ঔৎসুক্য বশতঃ ব্যানার্জী জানতে চাইলেন, ভুট্টোর প্রস্তাব সর্ম্পকে ভেবে দেখার জন্য কিছু সময় পাওয়ার পর তার উত্তর কী হতে পারতো বলে তিনি ভাবছেন? বঙ্গবন্ধু স্পষ্টভাবে তখন বলেছিলেন- ‘আমার জীবনকালে নয়’

লেখক: আইনজীবী ও পিএইচডি গবেষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

(মতামত লেখকের নিজস্ব। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ-এর অফিসিয়াল ওয়েবসাইটের সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত