বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় মুখ্য ভুমিকা পালনে জাতিসংঘের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর আহবান

1550

Published on সেপ্টেম্বর 27, 2014
  • Details Image

অস্থিতিশীল বৈশ্বিক নিরাপত্তা এবং ধর্মীয় জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদের উত্থানে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেন, বিশ্বব্যাপী অবনতিশীল নিরাপত্তা পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক উন্নয়নকে চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিচ্ছে।

শেখ হাসিনা বলেন, বিশ্বের কোন স্থানে শান্তির জন্য হুমকি সৃষ্টি হলে তা সমগ্র মানবতার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। আমরা স্থায়ী শান্তি ও নিরাপত্তা ব্যতীত টেকসই উন্নয়ন অর্জন করতে পারব না।

প্রধানমন্ত্রী আজ জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৬৯তম অধিবেশনে ভাষণকালে আরো বলেন, বাংলাদেশ বিশ্ব শান্তি, নিরাপত্তা এবং উন্নয়নের বৈধ রক্ষক হিসেবে জাতিসংঘের ভূমিকার প্রতি দৃঢ়ভাবে আস্থাশীল।

শেখ হাসিনা বলেন, সন্ত্রাসবাদ ও চরমপন্থা বিশ্বশান্তি ও উন্নয়নের পথে প্রধান অন্তরায়। বাংলাদেশ সবধরনের সন্ত্রাসবাদ সহিংস চরমপন্থা উগ্রবাদ এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতির প্রতি জিরো টলারেন্স নীতিতে বিশ্বাসী।

তিনি বলেন, প্রতিবেশী বা অন্যদের বিরুদ্ধে যে কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কোন ধরনের সন্ত্রাসী কার্যক্রমে বাংলাদেশের মাটি ব্যবহার করতে না দেয়ার ক্ষেত্রে আমরা অঙ্গীকারাবদ্ধ।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি আমাদের রাষ্ট্রের প্রগতিশীল এবং উদার চরিত্রকে নস্যাৎ করতে সদা তৎপর। তারা সুযোগ পেলেই ধর্মীয় উগ্রবাদ ও সহিংসতা ছড়িয়ে দেয়। তিনি বলেন, তাঁর সরকার শান্তি ও আইনের শাসন সমুন্নত রাখতে এবং দন্ড অব্যাহতি সংস্কৃতি অবসানে ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করতে অঙ্গীকারাবদ্ধ।

শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটনকারি কয়েকজনের বিচার ইতোমধ্যেই সম্পন্ন হয়েছে। তিনি বাংলাদেশের জনগণের দীর্ঘ প্রতীক্ষিত ন্যয়বিচারপ্রাপ্তির এই আকাক্সক্ষার প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পূর্ণ সমর্থন কামনা করেন।

চার দশক আগে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রথম ভাষণের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু একটি নতুন বিশ্বব্যবস্থার স্বপ্ন দেখেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “বাঙালি জাতি শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থান, সামাজিক ন্যায়বিচার, এবং দারিদ্র্য-ক্ষুধা-আগ্রাসনমুক্ত এবং বৈষম্যহীন একটি সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে অঙ্গীকারাবদ্ধ।” তাঁর সেই স্বপ্নই বাংলাদেশের জাতীয় উন্নয়ন অভিযাত্রা এবং বৈশ্বিক কর্মকান্ডে মূলভিত্তি।’

স্থায়ী শান্তি এবং নিরাপত্তাকে টেকসই উন্নয়নের চাবিকাঠি হিসেবে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, আন্তর্জাতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে অস্থিতিশীল বৈশ্বিক নিরাপত্তা অবস্থা এখনও বড় ধরণের চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে। তিনি বলেন, বিশ্বের যেকোন স্থানে শান্তি বিঘ্নিত হলে তা গোটা মানবজাতির জন্য হুমকিস্বরূপ।

প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি গাজায় ইসরায়েলি বাহিনী কর্তৃক ফিলিস্তিনি নারী ও শিশুসহ শত শত সাধারণ নাগরিক হত্যার তীব্র নিন্দা এবং ফিলিস্তিনি জনগণের আত্ম-নিয়ন্ত্রণ অধিকারের বৈধ সংগ্রামের প্রতি পূর্ণ সংহতি প্রকাশ করেন। তিনি ১৯৬৭-পূর্ব সীমানার ভিত্তিতে আল কুদস আল শরীফ-কে রাজধানী করে একটি স্বাধীন এবং স্থায়ী ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনের মাধ্যমে এই দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতের টেকসই সমাধান প্রত্যাশা করেন।

‘জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে তাৎপর্যপূর্ণ শান্তি ও অহিংস সংস্কৃতির প্রস্তাবের ফলেই আন্তর্জাতিক শান্তির প্রতি আমাদের প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন ঘটেছে’ উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, শান্তির পক্ষে নেতৃত্বের ক্ষেত্রে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে সর্বোচ্চ সৈন্য ও পুলিশ সদস্য প্রেরণের মাধ্যমে বাংলাদেশের অবস্থান আবারও সুদৃঢ় হয়েছে। এ পর্যন্ত আমরা ৫৪টি মিশনে ১ লাখ ২৮ হাজার ১৩৩ জন শান্তিরক্ষী প্রেরণ করেছি। তিনি গর্বের সংগে উল্লেখ করেন, শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ সর্বোচ্চ সংখ্যক মহিলা পুলিশ পাঠিয়েছে।

সন্ত্রাসবাদ এবং চরমপন্থাকে বিশ্বশান্তি ও উন্নয়নের প্রধান অন্তরায় বর্ণনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর সরকার সব ধরণের সন্ত্রাসবাদ, সহিংস চরমপন্থা, উগ্রবাদ এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতির প্রতি শূণ্য-সহনশীল নীতিতে বিশ্বাসী। তিনি বলেন, প্রতিবেশী বা অন্যদের বিরুদ্ধে যেকোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠির কোন ধরণের সন্ত্রাসী কার্যক্রমে বাংলাদেশের মাটি ব্যবহার করতে দেয়া হবে না।

শেখ হাসিনা বলেন, স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি আমাদের রাষ্ট্রের প্রগতিশীল এবং উদার চরিত্রকে নস্যাৎ করতে সদা তৎপর। তারা সুযোগ পেলেই ধর্মীয় উগ্রবাদ এবং সহিংসতা ছড়িয়ে দেয়। বিএনপি-জামাত জোট সরকারের প্রত্যক্ষ মদদে ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত সন্ত্রাসী গোষ্ঠী বোমা ও গ্রেনেড হামলার মাধ্যমে অসংখ্য উদার রাজনৈতিক নেতা-কর্মীকে হত্যা করেছে। তাঁর সরকার গত তিন বছরে সংশোধিত সন্ত্রাস বিরোধী আইন ২০১৩ এবং অর্থ পাচার আইন ২০১২-সহ সর্বোচ্চ সন্ত্রাস বিরোধী আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

তিনি বলেন, সন্ত্রাসবাদ এবং চরমপন্থা নির্মূলের জন্য বর্তমান সরকার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, নারীর ক্ষমতায়ন এবং সকল ধর্মের মানুষের ধর্ম পালনের স্বাধীনতার প্রতি গুরুত্ব দিয়েছে। শাসন ব্যবস্থায় সচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন এবং তথ্য কমিশনকে শক্তিশালী করা হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি জ্ঞানভিত্তিক প্রযুক্তিনির্ভর মধ্যম-আয়ের দেশ হিসেবে পরিণত করতে জাতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় এবং রূপকল্প-২০২১-এ এমডিজি'কে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই এমডিজি-১, ২, ৩, ৪, ৫ এবং ৬ অর্জন করেছে অথবা অর্জনের ক্ষেত্রে সঠিক পথে এগুচ্ছে। দারিদ্র্যের হার ১৯৯১ সালের ৫৭ শতাংশ থেকে বর্তমানে ২৫ শতাংশের নীচে নেমে এসেছে।

শেখ হাসিনা বলেন, বিশ্বমন্দা সত্ত্বেও গত পাঁচ বছরে জিডিপি’র গড় প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬.২ শতাংশ। রপ্তানি আয় ২০০৬ সালের ১০ দশমিক ৫৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে বৃদ্ধি পেয়ে গত অর্থবছরে ৩০ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে- যা ৩ গুণ বেশি। প্রবাসীদের রেমিটেন্স প্রেরণের পরিমাণ ২০০৬ সালের ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে প্রায় ৩ গুণ বৃদ্ধি পেয়ে ১৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার হয়েছে। একই সময়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩ দশমিক ৪৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে ২২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে- যা সাড়ে ছয় গুণ বেশি।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের উন্নয়ন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচনের জন্য বেশ কয়েকটি বৃহৎ প্রকল্প বান্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। নিজস্ব সম্পদ দিয়ে দেশের দীর্ঘতম ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার পদ্মাসেতু নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে। এ ছাড়া চট্টগ্রামের সোনাদিয়ায় একটি গভীর সমুদ্র বন্দর স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা সমসাময়িক তথ্য-প্রযুক্তি নির্ভর রাষ্ট্রের এবং জনগণের সক্ষমতা তৈরি করছি। বর্তমানে সাড়ে চার হাজারেরও উপর ইউনিয়ন তথ্যসেবা কেন্দ্র থেকে জনগণ দু’শ’রও বেশি বিভিন্ন ধরণের সেবা গ্রহণ করছেন। ১৫ হাজারেরও বেশী কমিউনিটি ক্লিনিক এবং ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে গ্রামীণ জনগোষ্ঠি স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছেন। এসব নেটওয়ার্কের মাধ্যমে অত্যাবশ্যকীয় সরকারি সেবা অত্যন্ত স্বল্পখরচে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশে ১১ কোটি ৭০ লাখ মোবাইল সীম এবং ৪ কোটি ৮৪ লাখ ইন্টারনেট সংযোগ রয়েছে। ৭৮ শতাংশ মানুষের হাতে টেলিফোন সুবিধা পৌঁছেছে।

তিনি বলেন, তাঁর সরকার শিক্ষাক্ষেত্রে নিরলস প্রচেষ্টার মাধ্যমে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি এবং প্রাথামিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ছেলে ও কন্যা শিশুর ভর্তির অনুপাতে সমতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করেছে। সরকার দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত ছাত্র-ছাত্রীদের অবৈতনিক শিক্ষার ব্যবস্থা করেছে। দরিদ্র পরিবারের প্রায় ১ কোটি ২৮ লাখ ছাত্রছাত্রীকে উপবৃত্তি দেওয়া হচ্ছে। মোট ছাত্রীর ৭৫ শতাংশ উপবৃত্তির আওতায় এসেছে। প্রতিবছর মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত ৩১ কোটি ৮০ লাখ পাঠ্যপুস্তক বিনামূল্যে বিতরণ করা হচ্ছে।

নারীর ক্ষমতায়ন এবং জীবনের সকলক্ষেত্রে পুরুষের সঙ্গে নারীর সমান অংশগ্রহণকে টেকসই উন্নয়নের চাবিকাঠি হিসেবে বর্ণনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, উৎপাদনমুখী সম্পদে নারীর প্রবেশাধিকার এবং জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে তাঁদের প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধির মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়নের ফলাফল দৃশ্যমান হচ্ছে। সরকারের সময়োচিত নীতি গ্রহণের ফলে তৃণমূল পর্যায় থেকে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত নারী নেতৃত্ব বিকশিত হচ্ছে। বাংলাদেশ সম্ভবতঃ বিশ্বের একমাত্র দেশ যেখানে প্রধানমন্ত্রী একজন নারী, সংসদের স্পীকার একজন নারী, বিরোধীদলের নেতা এবং সংসদ উপনেতাও নারী। বিচার, প্রশাসন, জনপ্রশাসন, সশস্ত্র বাহিনী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সকল সরকারি চাকুরিতে ১০ শতাংশ পদ মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ৬০ শতাংশ পদ মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত।

তিনি বলেন, ইতিহাসে এমডিজি হচ্ছে সবচেয়ে সফল বৈশ্বিক দারিদ্র্য-বিরোধী কর্মসূচি। এই এমডিজির কারণেই বিশ্বের ১৯৯০ সালের তুলনায় দারিদ্র্যের সংখ্যা অর্ধেকে নেমে এসেছে। অধিক সংখ্যক কন্যা শিশু বিদ্যালয়ে যেতে পারছে; কম সংখ্যক শিশু অকালে মৃত্যুবরণ করছে এবং অধিক সংখ্যক মানুষ নিরাপদ পানি ও পয়ঃনিষ্কাষণ ব্যবহারের সুবিধা ভোগ করছেন। তবে এ অগ্রগতি বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলের মধ্যে এমনকি দেশের অভ্যন্তরেও সমানভাবে সম্পন্ন হয়নি। যদিও সমষ্ঠিগতভাবে এমডিজির আওতায় দারিদ্র্য বিমোচনের গড় লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়েছে, তথাপি বিশ্বের প্রায় ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন মানুষ এখনও চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করছেন।

২০১৫ পরবর্তী উন্নয়ন এজেন্ডায় বিভিন্ন লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে যোগসূত্র তৈরি করে দারিদ্র্য বিমোচনের উপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব আরোপ করে তিনি বলেন, এ নতুন কাঠামোয় টেকসই উন্নয়নের তিনটি স্তম্ভের মধ্যে ভারসাম্য থাকতে হবে। যেখানে বাংলাদেশের মত দেশগুলোর বিভিন্নমুখী প্রয়োজন পূরণের ব্যবস্থা থাকবে।

শেখ হাসিনা ভবিষ্যৎ উন্নয়ন এজেন্ডায় স্বল্পআয়ের উন্নয়নশীল দেশগুলোর সম্পদ এবং সক্ষমতা সংশ্লিষ্ট দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা সমাধানের উপায় সংক্রান্ত বিষয়গুলোর অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করার উপর জোর দিয়ে বলেন, এই নতুন উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় আমাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী একটি সমতাভিত্তিক, সমৃদ্ধশালী এবং টেকসই বিশ্ব গড়ার প্রত্যাশা পূরণের উপায় থাকতে হবে। যেখানে কোন ব্যক্তি বা দেশ বাদ পড়বে না। আগামী বছরের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন এজেন্ডা বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় অর্থায়নের জন্য বাংলাদেশ একটি স্পষ্ট প্রতিশ্রুতির উপর বিশেষভাবে গুরুত্ব দিচ্ছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

কিছু কিছু উন্নত দেশ প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তাদের সামষ্টিক জাতীয় আয়ের দশমিক সাত শতাংশ এবং ওডিএ হিসেবে জাতীয় আয়ের দশমিক দুই শতাংশ স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে প্রদান করায় সন্তোষ প্রকাশ করে তিনি বলেন, কিন্তু হতাশার কথা হচ্ছে, অধিকাংশ দেশই এখন পর্যন্ত এই প্রতিশ্রুতি পূরণ করেনি। একইসঙ্গে বিদ্যমান বৈশ্বিক অর্থনীতি এবং জ্ঞান-ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থায়, বাংলাদেশের মত স্বল্পোন্নত এবং জলবায়ু-সংবেদনশীল দেশগুলোর জন্য ওডিএ, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি-উদ্ভাবন এবং সক্ষমতা তৈরির ক্ষেত্রে আরও বেশি করে সমর্থন প্রয়োজন। উন্নত দেশগুলোর বাজারে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর সব ধরণের পণ্যের শুল্কমুক্ত এবং কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে হবে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশ্ব আজ এক অভূতপূর্ব মানব চলাচল প্রত্যক্ষ করছে। বাংলাদেশ আজ বৈশ্বিক অভিবাসন প্রক্রিয়ায় অন্যতম অংশীদার। আমাদের সামষ্টিক জাতীয় উৎপাদনে প্রবাসী আয়ের অবদান প্রায় ১৪ শতাংশ। বিভিন্ন দেশে আমাদের লাখ লাখ অভিবাসী কর্মীগণ দেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছেন। রেমিটেন্স ছাড়াও অভিবাসী এবং তাঁদের পরিবারবর্গ আমাদের অর্থনীতি এবং সমাজের জন্য যে বহুমুখী অবদান রেখে চলেছেন, তার স্বীকৃতি দেওয়া প্রয়োজন। সুতরাং ২০১৫ পরবর্তী উন্নয়ন এজেন্ডার দলিলে অভিবাসনকে তার যথার্থ স্থান দিতে হবে।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের মত দেশের জন্য জলবায়ু পরিবর্তন-জনিত চ্যালেঞ্জ অতীতের যেকোন সময়ের চেয়ে জটিল এবং ভয়াবহ। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক তার সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলেছে ২১০০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে প্রশমন ব্যয় দাঁড়াবে জাতীয় উৎপাদনের দুই থেকে নয় শতাংশের মধ্যে।

শেখ হাসিনা বলেন, ‘এরআগে এই অধিবেশনে আমি উল্লেখ করেছিলাম, এক ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বাড়লে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এক মিটার বৃদ্ধি পাবে। এরফলে বাংলাদেশের পাঁচ ভাগের এক ভাগ এলাকা ডুবে যাবে। ৩ কোটি মানুষ জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে। জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের জন্য একটি জীবনমরণ সমস্যা। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা মোকাবিলায় আমাদের জন্য অভিযোজন বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এ সমস্যা মোকাবিলায় আমাদের জন্য পর্যাপ্ত এবং অতিরিক্ত অর্থায়ন অত্যন্ত জরুরি। পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে উদ্ভাবিত লাগসই-প্রযুক্তির পর্যাপ্ত সরবরাহ এবং সক্ষমতা বৃদ্ধি ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো তৈরিতে সহায়তা প্রয়োজন।

প্রধানমন্ত্রী সমুদ্রসম্পদ কাজে লাগানোর জন্য বাংলাদেশের মত উপকূলবর্তী দেশগুলোর সক্ষমতা, প্রযুক্তি এবং প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর উন্নয়নে বৈশ্বিক সমর্থনের জন্য উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে বলেন, ২০১৫ পরবর্তী কাঠামোতে ব্লু ইকোনমি সম্পর্কিত নীতিমালা এবং কর্মকা-কে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে বাংলাদেশ জোরালো সমর্থন দিয়ে যাবে।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের তাৎপর্যপূর্ণ প্রস্তাবের প্রেক্ষিতেই ১৯৯৯ সালে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। মানবজাতির ৬ হাজার ৫০০ মাতৃভাষা সংরক্ষণের জন্য ঢাকায় একমাত্র আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট স্থাপন করা হয়েছে। এসব কর্মকা-ের মধ্য দিয়ে মাতৃভাষার প্রতি বাংলাদেশের অঙ্গীকারের বিষয়টি প্রতিফলিত হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী আবারও বিশ্বের প্রায় ৩০ কোটি মানুষের মুখের ভাষা বাংলাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের আহ্বান জানান। বাংলাদেশ এবছর জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভের ৪০ বছরপূর্তি উদ্যাপন করছে উল্লেখ করে তিনি এ বিশেষ মুহুর্তে বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ থেকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে পরবর্তী প্রজন্মের প্রতি যে আহ্বান জানিয়েছিলেন তা পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, ‘আসুন, আমরা সবাই মিলে এমন একটি বিশ্ব গড়ে তুলি, যা দারিদ্র্য, ক্ষুধা, যুদ্ধ এবং মানবিক দুঃখ-দুর্দশা নির্মুল করতে পারে এবং মানুষের কল্যাণের জন্য বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে’

তিনি জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৬৯তম অধিবেশনের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ায় সাম কুতেসাকে আন্তরিক অভিনন্দন জানান। একইসঙ্গে ৬৮তম সাধারণ অধিবেশনের সভাপতি হিসেবে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব প্রদানের জন্য রাষ্ট্রদূত জন এ্যাস এবং মানবকল্যাণে নিরলসভাবে প্রচেষ্টা চালানোর জন্য জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুনকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানান।

-বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস)
ছবিঃ সাইফুল ইসলাম কল্লোল

TAGS:

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত