মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ঃ সমৃদ্ধির নতুন মর্যাদায় বাংলাদেশ

10767

Published on মে 21, 2018
  • Details Image

মুনতাকিম আশরাফঃ

তথ্যপ্রযুক্তিতে যে বাংলাদেশ অনেক দূর এগিয়ে গেছে, সে কথা আর এখন নতুন কিছু নয়। সত্যিকার অর্থেই ডিজিটাল বাংলাদেশ বলতে যা বোঝায়, সে পথ ধরেই এগিয়ে চলছে দেশ। প্রযুক্তি খাত দেশের অভ্যন্তরীণ উন্নতিতে বড় ভূমিকা রাখতে শুরু করেছে। যাতে আমরা আশাবাদী, এ খাত শিগগিরই দক্ষ একটি জনশক্তি গড়ে তুলতে সক্ষম হবে। বিদেশে আরও দক্ষ জনশক্তি রপ্তানি করার সুযোগ তৈরি হবে। আমাদের দেশীয় বিশেষজ্ঞরা তখন বিদেশের মাটিতে দেশের প্রতিনিধিত্ব করবেন। তাতে বৈদেশিক মুদ্রাও যেমন আসবে, তেমনি বাড়বে সুনামও। ডিজিটাল বাংলাদেশের পথে সবচেয়ে বড় যে ধাপটি অতিক্রম করলাম আমরা, সেটি হলো দেশের প্রথম স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১।

বাংলাদেশের প্রথম এ স্যাটেলাইট নিয়ে আমাদের আগ্রহ ও উদ্দীপনার শেষ নেই। বিশ্বের ৫৭তম দেশ হিসেবে নিজস্ব স্যাটেলাইটের মালিক এখন আমরা। বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটের মূল অবকাঠামো তৈরি করেছে ফ্রান্সের মহাকাশ সংস্থা থ্যালেস অ্যালেনিয়া স্পেস। প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা খরচ করে তৈরি করা এ স্যাটেলাইট দিয়ে বাংলাদেশের মানুষ মূলত মোটাদাগে তিন ধরনের সুফল পাবে। প্রথমত, এ স্যাটেলাইটের সমতা বিক্রি করে বৈদেশিক মুদ্রা আয় ও সাশ্রয়। দ্বিতীয়ত, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ইন্টারনেট ও টেলিযোগাযোগ সেবার সম্প্রসারণ করা সম্ভব হবে। তৃতীয়ত, দুর্যোগ পরিস্থিতি মোকাবিলা ও ব্যবস্থাপনায় কার্যকর ভূমিকা রাখবে এ স্যাটেলাইট। এ ছাড়া জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কাজেও এ স্যাটেলাইটকে কাজে লাগানো সম্ভব বলে এরই মধ্যে গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে।

বাংলাদেশ একটি দুর্যোগপ্রবণ অঞ্চলে অবস্থিত। ঝড় বা বড় ধরনের দুর্যোগে যোগাযোগব্যবস্থা সচল রাখতেও এ স্যাটেলাইটকে আমরা ব্যবহার করতে পারব। বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগে মোবাইল নেটওয়ার্ক অনেক সময় অচল হয়ে পড়ে। এমন দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতিতে এ স্যাটেলাইট দারুণ কাজে আসবে। স্যাটেলাইটের মাধ্যমে প্রত্যন্ত অঞ্চলের যোগাযোগব্যবস্থা চালু রাখা সম্ভব হবে। সুবিধাবঞ্চিত ও পিছিয়ে পড়া অঞ্চলের মানুষের কাছে ইন্টারনেট ও ব্যাংকিং সেবাও পৌঁছে দেওয়া যাবে। এ স্যাটেলাইটের যে বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে, সেটি হলো বাংলাদেশের ভাবমূর্তি। বঙ্গবন্ধু-১-এর মাধ্যমে স্যাটেলাইট প্রযুক্তির অভিজাত দেশের কাবে বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু-১ তৈরির ঘোষণা আসার পর পরই ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় ন্যানো স্যাটেলাইট প্রকল্প নিয়ে কাজ শুরু করে। ব্র্যাক অন্বেষা নামের এই ন্যানো স্যাটেলাইটটি তৈরি করেছেন এ দেশেরই কয়েকজন তরুণ। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চারজন ইতোমধ্যে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট প্রকল্পে কাজ করছেন। এ তরুণেরা বলছেন, সরকারের দিক থেকে কিছুটা সহযোগিতা পেলে ২০২১ সালের মধ্যে দেশেই স্যাটেলাইট তৈরি করা সম্ভব। নিজেদের স্যাটেলাইট তৈরি হওয়ার কারণেই এমন বড় স্বপ্ন ও চিন্তাভাবনা করতে পারছেন। এ স্যাটেলাইটের বাণিজ্যিক সুফলও অনেক। এখন দেশে প্রায় ৩০টি স্যাটেলাইট চ্যানেল সম্প্রচারে আছে। এসব চ্যানেল সিঙ্গাপুরসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে স্যাটেলাইট ভাড়া নিয়ে পরিচালিত হচ্ছে। এ জন্য প্রতি মাসে একটি চ্যানেলের ভাড়া বাবদ গুনতে হয় ৩ থেকে ৬ হাজার মার্কিন ডলার। সব মিলিয়ে স্যাটেলাইটের ভাড়া বাবদ বছরে চ্যানেলগুলোর খরচ হয় ২০ লাখ ডলার বা প্রায় ১৭ কোটি টাকা। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট চালু হলে এই স্যাটেলাইট ভাড়া কমবে। আবার দেশের টাকা দেশেই থেকে যাবে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের ট্রান্সপন্ডার বা সমতা অন্য দেশের কাছে ভাড়া দিয়েও বৈদেশিক মুদ্রা আয় করার সুযোগ তৈরি হবে। এ স্যাটেলাইটের ৪০টি ট্রান্সপন্ডারের মধ্যে ২০টি ভাড়া দেওয়ার জন্য রাখা হবে। ইতোমধ্যে ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইনে এ স্যাটেলাইটের ট্রান্সপন্ডার বিক্রির জন্য সরকারের গঠন করা বঙ্গবন্ধু কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট কোম্পানি (বিসিএসবি) লিমিটেড কাজ শুরু করেছে।

বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) তথ্য অনুযায়ী, বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটে মোট ৪০টি ট্রান্সপন্ডারের মধ্যে ২৬টি কেইউ-ব্যান্ড ও ১৪টি সি-ব্যান্ড। প্রতিটি ট্রান্সপন্ডার থেকে ৪০ মেগাহার্টজ হারে তরঙ্গ বরাদ্দ (ফ্রিকোয়েন্সি) সরবরাহ পাওয়া সম্ভব। এ হিসাবে ৪০টি ট্রান্সপন্ডারের মোট ফ্রিকোয়েন্সিমতা হলো ১ হাজার ৬০০ মেগাহার্টজ। কিছু কারিগরি সীমাবদ্ধতার কারণে এই এক হাজার পুরোটা ব্যবহার করা যাবে না। তবে কমপে ১ হাজার ৪০০ মেগাহার্টজ ব্যবহার করা সম্ভব হবে। তবে স্যাটেলাইটের ব্যান্ডউইথ ও ফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহার করে ইন্টারনেট পাওয়া যাবে। দেশের ৭৫০ ইউনিয়নে এখন ফাইবার অপটিক ইন্টারনেটের সংযোগ নেই। ইন্টারনেটবঞ্চিত এমন এলাকার মধ্যে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ইন্টারনেট সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব। সব মিলিয়ে এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করল বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট।

১৯৭৫ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাঙ্গামাটির বেতবুনিয়ায় দেশের প্রথম ভূ-উপগ্রহকেন্দ্র স্থাপন করেছিলেন। তার উত্তরসূরি হিসেবে মহাকাশে দেশের প্রথম স্যাটেলাইট। প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় নিবিড় তদারকির মাধ্যমে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের কাজ সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। কার্যত এসব কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়িত হতে চলেছে বাংলার মাটিতে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটে বাংলায় ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগানটি লেখা রয়েছে। এ স্লোগান নিয়েই কক্ষপথের দিকে ছুটেছে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট। বাঙালির জন্য এ এক গৌরবের খবর।

দীর্ঘ ২১ বছর পর আবার সরকার গঠন করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। বিচক্ষণ রাজনীতিক ও দক্ষ নেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এগিয়ে চলে দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড। যার ভীতটা প্রযুক্তি খাত। বলতে গেলে, সনাতনী কার্যক্রম থেকে বের হয়ে এসে ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনের কাজ শুরু হয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরেই। ফলে মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে, যেমন স্যাটেলাইটের স্বত্বাধিকারীর মর্যাদা পাচ্ছে বাংলাদেশ। তেমনি প্রযুক্তিভিত্তিক তথ্য ও সেবা পৌঁছে গেছে সাধারণ মানুষের দোরগোড়াতেও। কানেক্টিভিটি ও আইসিটি অবকাঠামো, মানবসম্পদ উন্নয়ন, আইসিটি শিল্পের উন্নয়ন ও ই-গভর্ন্যান্স প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই এসেছে প্রযুক্তি খাতের সাফল্য যাত্রা শুরু। তথ্যপ্রযুক্তি খাতে ১০ বছর আগেও রপ্তানি বাজার ছিল মাত্র আড়াই কোটি ডলারের। বর্তমান সরকারের প্রচেষ্টায় তা এখন গিয়ে ঠেকেছে ৮০০ কোটি ডলারে। আর এ খাতে বেড়েছে দক্ষ জনবলের সংখ্যাও। ২০০৯ সালে বাংলাদেশে এই খাতে মাত্র ৩০০ কর্মী ছিল, এখন যা ছাড়িয়েছে ৫০ হাজারের ঘর। ২০২১ সালের মধ্যে বিপিও খাতে কর্মসংস্থান এক লাখ ছাড়িয়ে যাওয়ার বড় সম্ভাবনাও তৈরি হয়েছে। যার প্রমাণও মিলছে বিশ্বব্যাপী। গবেষণা ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান গার্টনারের মতে, বাংলাদেশ সেরা ৩০টি অফশোর তথ্যপ্রযুক্তি গন্তব্যের একটি। বিশ্বের সর্ববৃহৎ ফ্রিল্যান্স মার্কেট প্লেস ওডেস্কের মতে, বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা বিশ্বের তৃতীয় বৃহৎ আউটসোর্সিং শহর। বৈশ্বিক ব্যবস্থাপনা পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এটকারনারির মতে, বাংলাদেশ ২৬তম আকর্ষণীয় আইটি আউটসোর্সিং গন্তব্যের দেশ, যা আর্থিকভাবে প্রথম আকর্ষণীয় তথ্যপ্রযুক্তি গন্তব্যের দেশ। সরকারের উদ্যোগে ও সহযোগিতায় গঠিত শতাধিক আইটি প্রশিণ কেন্দ্রের মাধ্যমে বছরে প্রায় ১৫ হাজারেরও বেশি তরুণ-তরুণী প্রশিতি হচ্ছে। বাংলাদেশের তরুণদের কাজ বিশ্বমানের হওয়ায় অনেক আইটি প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ করতে এগিয়ে আসছে। মোবাইল প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান স্যামসাং গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে এরই মধ্যে ২ কোটির বেশি ডলার বিনিয়োগ করেছে। বাংলাদেশে স্থাপিত হয়েছে স্যামসাং মোবাইল তৈরির কারখানাও। এসব উদ্যোগের ফলে বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্ত হচ্ছে লাখো তরুণ। অগ্রযাত্রার এই ইতিহাস তৈরি হচ্ছে প্রযুক্তি খাতের উন্নয়নের মাধ্যমে, যা আরও এগিয়ে যাবে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের মাধ্যমে।

কম সময়ের ব্যবধানে কোনো দেশের উন্নয়নের নজির খুঁজে পাওয়া ভার। তবে বাংলাদেশের এই সাফল্যের পেছনের গল্পটা, দক্ষ আর যোগ্য নেতৃত্বই। যা এসেছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরেই। আর প্রযুক্তি খাতের উন্নয়নে সব দেখভাল করেছেন প্রধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়। সরকারের নানামুখী উদ্যোগের ফলে দেশ আজ উন্নয়নশীল দেশের অগ্রযাত্রায়। কাজেই উন্নয়নের এ ধারা অব্যাহত রাখতে প্রয়োজন দেশ পরিচালনার ভার বর্তমান সরকারের হাতে থাকা। এগিয়ে যাক বাংলাদেশ, সমৃদ্ধ হোক অর্থনীতি। স্যাটেলাইট যুগে প্রবেশের সব কৃতিত্বের ধারক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রাণঢালা অভিনন্দন।

লেখক: ভাইস প্রেসিডেন্ট, এফবিসিসিআই

সৌজন্যেঃ দৈনিক আমাদের সময়

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত