ডিজিটাল বাংলাদেশঃ বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা

16043

Published on জুলাই 16, 2018
  • Details Image

মোস্তাফা জব্বারঃ

বিশ্ব সভ্যতার ক্রমরূপান্তরের ক্ষেত্রে আমরা এমনটি জেনেছি যে, মানুষ আগুনের যুগ বা পাথরের যুগের মতো আদিযুগ অতিক্রম করে কৃষিযুগে পা ফেলে। আদিযুগে মানুষ প্রধানত প্রকৃতিনির্ভর ছিল। প্রকৃতিকে মোকাবেলা করতো সে এবং প্রকৃতিকে নির্ভর করেই তার জীবন যাপিত হতো। বস্তুত কৃষিযুগ ছিল মানুষের সৃজনশীলতার প্রথম ধাপ যখন সে উৎপাদন করতে সক্ষম হয়। সে জ্ঞান অর্জন করে কেমন করে বীজ বপন করতে হয়, তার থেকে চারা ও বৃক্ষ হয় এবং সেই বৃক্ষের ফল সে নিজে খাবার জন্য ব্যবহার করতে পারে।

দিনে দিনে সে প্রযুক্তি আয়ত্ত্ব করে। গাছে পানি দিলে তার বৃদ্ধি ঘটে, সার দিলে সে বেড়ে ওঠে ইত্যাদি; তার শেখা হয়। সে শিখে, মাটি কর্ষণ করলে ফসলের ফলন বাড়ে। সেচ আর সার দিলে ফলন আরও বাড়ে। দিনে দিনে সে ফসলের বৈচিত্র্য আনতে পারে এবং তার কৃষিজ্ঞানের নিরন্তর বিকাশ ঘটে। এরপর অষ্টাদশ শতকে ইংল্যান্ডে যান্ত্রিক যুগ বা শিল্প বিপ্লবের সূচনা হয়। সেটিকে এখন সবাই শিল্প বিপ্লবের প্রথম স্তর বলে চিহ্নিত করে।

প্রধানত কৃষিনির্ভর, গ্রাম্য ইউরোপ ও আমেরিকাকে যন্ত্রনির্ভর ও শহুরে হিসেবে গড়ে তুলে এই শিল্প বিপ্লব। হাতে তৈরি যন্ত্র, কায়িক শ্রম ইত্যাদির সহায়তায় কুটির শিল্পের মতো যে উৎপাদন ব্যবস্থা ছিল তাতে বিশেষায়িত যন্ত্র, কারখানা ও শক্তির সংযুক্তি ঘটে। আসে গণ উৎপাদনের সময়। লোহা ও বস্ত্র শিল্পের সাথে বাষ্পীয় কলের উদ্ভাবন, উন্নততর পরিবহন ব্যবস্থা, যোগাযোগ ব্যবস্থা, ব্যাংকিং ইত্যাদির সূচনা হয়। একই সাথে শিল্প বিপ্লবের সাথে সম্পৃক্ত হতে পারেননি এমন মানুষেরা চরম বিপদের মুখোমুখি হয়।

কর্মহীনতা ও সামগ্রিক পরিস্থিতি তাদেরকে মানবেতর জীবন যাপনে বাধ্য করে। অবশ্য শিল্প বিপ্লবের আগেও তাদের জীবন দুঃসহই ছিল। তবে যেহেতু তারা উন্নত জীবনটি শিল্প বিপ্লবের আগে দেখেনি এবং যন্ত্র এসে সভ্যতার রূপান্তরটি ঘটিয়েছিল সেহেতু তারা মনে করেছিলো যে তাদের দুরাবস্থার জন্য শিল্প বিপ্লবই দায়ী। সেই ধারণা থেকেই শিল্প বিপ্লবের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত মানুষেরা উনিশ শতকে ইংল্যান্ডে শত শত কারখানায় হামলা চালিয়েছিল, যন্ত্রপাতি ভাঙচুর করেছিল ও হাজার খানের হরতাল বা ধর্মঘট করেছিল। নেড লুট নামক এক ইংরেজ এর নেতৃত্ত্ব দিয়েছিল বলে সেইসব কর্মকাণ্ডকে লুডিটি বলা হতো।

আমরা যখন চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের বিষয় নিয়ে আলোচনা করছি তখনও সম্ভবত নেড লুটের মতো নেতা ও তার অনুসারীদের সৃজন হবার সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে। হাজার হাজারের বদলে লাখো লাখো ধর্মঘট প্রযুক্তি ভাঙচুর, প্রযুক্তি প্রতিরোধ এবং কায়িক শ্রমবিলীনকারী প্রযুক্তি প্রতিহত করার মতো অবস্থা ঘটতে পারে।

বর্তমানে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো প্রচলিত শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটালেও শিক্ষিত মানুষের বেকারত্ব এইসব রাষ্ট্রের জন্য বিশাল ও ভয়ংকর চ্যালেঞ্জ হয়ে ওঠেছে। এর কারণটি খুবই সরল অঙ্কে দেখা যায়। প্রথম শিল্পযুগের শিক্ষা চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের জন্য দক্ষতা দিতে পারেনা। অবস্থাটি আরও বদলাবে এবং শিক্ষিত মানুষের বেকারত্বের চাপটি আরও বাড়বে। এর প্রধানতম কারণ হচ্ছে প্রচলিত জ্ঞান নিয়ে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে টিকে না থাকার সম্ভাবনা।

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ফলে প্রচলিত কারখানা, প্রচলিত শ্রম, বিদ্যমান অফিস-আদালত, ব্যবসা বাণিজ্য, সরকার ব্যবস্থা, শিক্ষা ও জীবনধারার অকল্পনীয় রূপান্তর ঘটছে। বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর জন্য এটি অন্যদের-বিশেষত শিল্পোন্নত ও বয়স্ক জনগোষ্ঠীর দেশগুলোর চাইতে অনেক বেশি চ্যালেঞ্জযুক্ত।

আমরা স্মরণ করতে পারি প্রথম শিল্প বিপ্লবের প্রাথমিক ধাক্কাটা সামাল দেবার পর বিশ্ব প্রধানত প্রযুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছে এবং তার জীবন মানের উন্নতি ও সভ্যতার বিবর্তনে প্রযুক্তিকেই কাজে লাগিয়েছে। সেই কারণেই ১৮৭০ সালে বিদ্যুৎ আবিষ্কারের পরের সময়টাকে দ্বিতীয় এবং ১৯৬৯ সালের ইন্টারনেটের সূচনার পরের স্তরকে তৃতীয় শিল্প বিপ্লব বলে চিহ্নিত করা হলেও প্রযুক্তির প্রভাবে প্রথম শিল্প বিপ্লবের সময় যে ধাক্কাটা এসেছিল ত্বিতীয় বা তৃতীয় শিল্প বিপ্লবের সময় বিশ্ব তেমন বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়নি।

বরং দ্বিতীয় ও তৃতীয় শিল্প বিপ্লবের প্রযুক্তি সারা বিশ্বের মানুষের জীবন মানকে অসাধারণ উচ্চতায় স্থাপন করেছে। তবে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সময়ে আমাদের জন্যে ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুটো বিষয়ই রয়েছে। আমরা তিনটি শিল্প বিপ্লবে তেমন শরীক না হবার ফলে সেই তিন বিপ্লবের ভুলগুলো না করার ইতিবাচক সময়ে রয়েছি।

অন্যদিকে তিনটি শিল্প বিপ্লব মিস করার জন্য আমাদের চ্যালেঞ্জটা বেড়েছে। আমরা সমাজ সভ্যতা তিনটি শিল্প বিপ্লবের রূপান্তর মিস করার ফলে আমরা আমাদের নাগরিকদেরকে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের জন্য ন্যূনতম যোগ্যতা দিতে পারিনি। তৃতীয় শিল্প বিপ্লবের পর থেকেই বিশ্বসভ্যতা ডিজিটাল যুগে পা দিলেও এখন বিশ্ব কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবোটিক্স, আইওটি, বিগডাটা এবং ৫জি মোবাইল ব্রডব্যান্ডের যুগের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে।

আমরা যারা দুনিয়ার ডিজিটাল বিপ্লব, চতুর্থ শিল্প বিপ্লব, ডিজিটাল সমাজ, সৃজনশীল অর্থনীতি, ডিজিটাল অর্থনীতি, ই-দেশ, ইউবিকুটাস দেশ ইত্যাদি বলছি তাদেরকেও বুঝতে হবে নতুন প্রযুক্তিসমূহ বিশ্বকে একটি অচিন্ত্যনীয় যুগে নিয়ে যাচ্ছে। এখনই এইসব প্রযুক্তিসমূহের অতি সামান্য প্রয়োগ সবাইকে তাক লাগিয়ে দেবার ঘটনা ঘটাচ্ছে। আগামীতে আমরা এসব প্রযুক্তির সাথে খাপ খাওয়াতে পারবো কিনা সেটিই ভাবনার বিষয়।

অন্যসব আলোচিত নবীন প্রযুক্তি যেমন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবোটিক্স, আইওটি, ব্লক চেইন ইত্যাদির আলোচনা কমও যদি করি, তবুও এটি বলতেই হবে যে, মোবাইলের প্রযুক্তি যখন ৪জি থেকে ৫জিতে যাচ্ছে তখন দুনিয়া একটি অভাবনীয় রূপান্তরের মুখোমুখি হচ্ছে। আমরা ৫জির প্রভাবকে যেভাবে আঁচ করছি তাতে পৃথিবীতে এর আগে এমন কোন যোগাযোগ প্রযুক্তি আসেনি যা সমগ্র মানবসভ্যতাকে এমনভাবে আমূল পাল্টে দেবে।

২০২০ সাল নাগাদ এই প্রযুক্তি বিশ্ববাসী ব্যাপকভাবে ব্যবহার করবে। মোবাইলের এই প্রযুক্তি ক্ষমতার একটু ধারণা পাওয়া যেতে পারে এভাবে যে আমরা এখন যে ৪জি প্রযুক্তি ব্যবহার করছি তার গতির হিসাব এমবিপিএস এ। অন্যদিকে ৫জির গতি জিবিপিএস এ। এমন ৫জির সাথে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবোটিক্স, আইওটি, বিগ ডাটা, ব্লক চেইন বা এ ধরনের যুগান্তকারী ডিজিটাল প্রযুক্তি যেমনি করে নতুন সুযোগ তৈরি করবে তেমনি করে নতুন চ্যালেঞ্জেরও জন্ম দিচ্ছে।

আমাদের জন্য এটি খুবই প্রয়োজনীয় হবে যে আমরা যেন প্রযুক্তিকে আমাদের জনগোষ্ঠী, সমাজ-সংস্কৃতি ও দেশ-কালের সাথে সমন্বয় করে ব্যবহার করতে পারি। এসব প্রযুক্তি একদিকে জীবনকে বদলে দেবে, অন্যদিকে কায়িক শ্রমকে ইতিহাস বানিয়ে দেবে। আমাদের মতো জনবহুল কায়িক শ্রমনির্ভর দেশের জন্য এটি একটি মহাচ্যালেঞ্জ। অন্যদিকে আমাদের মতো তরুণ জনগোষ্ঠীর দেশের জন্য সেই জনগোষ্ঠীকে এসব প্রযুক্তিজ্ঞানসমৃদ্ধ করে কাজে লাগিয়ে বিশ্ব জয় করার একটি অপার সম্ভাবনাও তৈরি করছে এইসব প্রযুক্তি।

বাংলাদেশ প্রধানত একটি কৃষিপ্রধান দেশ হিসেবে নিজেকে একুশ শতক অবধি টেনে এনেছে। খুব সাম্প্রতিককালে কিছু মৌলিক শিল্পায়ন ছাড়া দেশটি কৃষিনির্ভরই ছিল। তবে জিডিপির চিত্রটা এরই মাঝে দারুণভাবে বদলে গেছে। ২০১৭ সালে বাংলাদেশের জিডিপিতে কৃষির অবদান ছিল মাত্র শতকরা ১৯ ভাগ। সেবা খাত কৃষি ও শিল্পকে অতিক্রম করে জিডিপিতে শতকরা ৫০ ভাগের বেশি অবদান রাখতে শুরু করেছে।

এই পরিবর্তনের প্রধান কারণ দেশটির সামগ্রিক রূপান্তর। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অসাধারণ নেতৃত্বএমন অসম্ভবকে সম্ভব করেছে। বিশেষ করে তার নেতৃত্বে ঘটা আমাদের ডিজিটাল রূপান্তর এমন এক সুযোগ তৈরি করেছে যা এর আগে আমরা কখনও ভাবতেও পারিনি।

শেখ হাসিনার অসাধারণ নেতৃত্ব ডিজিটাল বাংলাদেশের ভিত রচনা করেছে। এই দেশে কম্পিউটার আসে ৬৪ সালে। ১৯৭৩ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্ব টেলিযোগাযোগ সংস্থার সদস্যপদ গ্রহণ করে দেশটির বিশ্ব সংযুক্তির সূচনা করেন। এরপর ১৯৭৫ সালের ১৪ জুন তিনি বেতবুনিয়া ভূ উপগ্রহ স্থাপন করে আমাদের সংযুক্তির পথটাকে আরও অনেক দূর সামনে নিয়ে যান।

এরপর সরকারিভাবে তথ্যপ্রযুক্তির বিষয়ে সরকারের কোন প্রকারের সহায়তা ছিলইনা। ৯৬ সালে জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকার প্রথমবারের মতো সরকার গঠন করার পর আমরা ডিজিটাল যুগে যাত্রা শুরু করি। এর আগে ৮৭ সাল থেকে বেসরকারিভাবে ঘটে যাওয়া ডিটিপি বিপ্লবের আগে কম্পিউটারের সাথে সাধারণ মানুষের সম্পর্কও ছিলনা।

বিশেষজ্ঞরাই কম্পিউটার চর্চা করতেন। ডিটিপি ও কম্পিউটারে বাংলা ভাষার ব্যবহার ডিজিটাল প্রযুক্তিকে তৃণমূলের সাথে সম্পৃক্ত করে তোলে। সার্ক বিবেচনায় বস্তুত প্রকৃত ডিজিটাল বিপ্লবের সূচনা ঘটে জননেত্রী শেখ হাসিনা যখন ১৯৯৬ সালে প্রথমবারের মতো দেশ শাসনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

সেই সময়ে ৯৮/৯৯ সালের বাজেটে শেখ হাসিনা কম্পিউটারের ওপর থেকে শুল্ক ও ভ্যাট সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করেন, মোবাইলের মনোপলি ভাঙেন, অনলাইন ইন্টারনেটকে সচল করেন ও দেশে দশ হাজার প্রোগ্রামার তৈরির নির্দেশনা প্রদান করেন। সেই সময়ে কেমন করে বাংলাদেশ থেকে সফটওয়্যার রপ্তানি করা যায় তার সুপারিশের জন্য একটি টাস্ক ফোর্স গঠন করা হয়। সেই টাস্কফোর্স ৪৫টি সুপারিশ পেশ করে যা সরকার গ্রহণ করে ও বেশির ভাগ সুপারিশ বাস্তবায়ন করে।

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে শেখ হাসিনার ডিজিটাল রূপান্তরের স্বপ্ন থেমে যায় ২০০১ সালে সরকার বদলে যাবার ফলে। এরপর আবার বাংলাদেশের ডিজিটাল নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা হয় ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর। সেই নির্বাচনের আগেই ২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বর জননেত্রী শেখ হাসিনা তার দলের নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করার সময় রূপকল্প ২০২১ এর অংশ হিসেবে ২০২১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা প্রদান করেন।

স্মরণ করা উচিত যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই ঘোষণার পর ব্রিটেন ২০০৯ সালের ২৯ জানুয়ারি ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ২০১৪ সালের ১৫ আগস্ট নিজেদের দেশকে ডিজিটাল দেশে রূপান্তরের কর্মসূচি ঘোষণা করে। এখন দেখছি নেপাল ডিজিটাল নেপাল বলে চিৎকার করছে। এখন বস্তুত বিশ্বের সকল দেশ ইলেকট্রনিক, ইউবিকুটাস বা ডিজিটাল শব্দ দিয়ে তাদের ডিজিটাল যুগের কর্মসূচি প্রকাশ করছে।

বাংলাদেশের আগে অন্য কেউ ডিজিটাল শব্দটি ব্যবহার করেনি। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম যেমন করে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবকে গুরুত্ব দিচ্ছে তেমনি বিশ্ব তথ্যসংঘ সমাজ জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাও ২০৪১ সালে বাংলাদেশকে কেবল একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশেই পরিণত করতে চাননি, তিনি একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার কথাও ঘোষণা করেছেন।

২০১৪ সালে ঘোষিত তার দলের নির্বাচনী ইশতেহারে তিনি এই ঘোষণা প্রদান করেন। বিশ্বের বহু দেশ জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি, সৃজনশীল অর্থনীতি, ডিজিটাল অর্থনীতি এবং সর্বত্র বিরাজমান প্রযুক্তির কর্মসূচির কথা বলে যাচ্ছে। অনেক দেশই এমন নতুন পরিস্থিতির প্রকৃত রূপটা উপলব্ধি করতে পারেনি। তবে বাংলাদেশ ভাগ্যবান যে তার নেত্রী শেখ হাসিনা, যিনি পঞ্চাশ বছর সামনে দেখার দূরদর্শিতার অধিকারিণী।

আমরা বাংলাদেশের জনগণ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তোলার সংগ্রাম করছি বলেই প্রযুক্তি ও সভ্যতায় পিছিয়ে থাকতে পারিনা। একাত্তরে রক্ত দিয়ে যে দেশটাকে আমরা গড়েছি সেই দেশটা বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত দেশ হবে এটিই জাতির জনকের স্বপ্ন ছিল। আমরা সেই স্বপ্নেই মুক্তিযুদ্ধ করেছি এবং আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই স্বপ্নপূরণে তার জীবন ও কর্মকে উৎসর্গ করে যাচ্ছেন। আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জ হচ্ছে প্রযুক্তি ও জীবনধারায় পেছনে থাকার বদলে দুনিয়াকে ডিজিটাল যুগে নেতৃত্ব দেয়া। আমাদের জন্য স্বপ্ন হচ্ছে ২০২১ ও ২০৪১ সালের রূপকল্প বাস্তবায়ন করা।

জাতীয় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নীতিমালা হচ্ছে তেমন একটি দলিল যাতে আমরা আমাদের ২১ ও ৪১ এর রূপকল্পকে বাস্তবায়ন করার পথরেখার বিবরণ প্রদান করছি। এখনকার সময়ে অবস্থান করে ৪১ সালের অবস্থাটি আমাদের জন্য আন্দাজ করাও দুরুহ। এমনকি ২১ সালে আমরা কেমন পৃথিবীতে বাস করবো সেটিও অনুমান করা কঠিন। তবুও আমরা কিছু মৌলিক ও কৌশলগত বিষয় চিহ্নিত করে একটি কর্ম পরিকল্পনার রূপরেখা তৈরি করছি। বলার অপেক্ষা রাখেনা এর সবই পরিবর্তনশীল। ২১ ও ৪১ এর লক্ষ্যটা স্থির রেখে সময়ে সময়ে এর আনুষঙ্গিক বিষয়াদি আপডেট করতে হবে। যেসব মৌলিক উপাদান আমাদের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেবে সেগুলোর মাঝে রয়েছে দেশের সকল মানুষের জন্য ডিজিটাল সংযুক্তি, মানবসম্পদ উন্নয়ন, ডিজিটাল সরকার প্রতিষ্ঠা ও ডিজিটাল শিল্পখাতের বিকাশ।

আমরা মনে করি এর ফলে আমাদের জনগণ একটি ডিজিটাল জীবনধারায় বসবাস করবে। ডিজিটাল বাংলাদেশ যে একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ করার প্লাটফরম রচনা করবে সেটিও আমরা ভাবছি। আমরা দেশটিকে ডিজিটাল অর্থনীতি, সৃজনশীল অর্থনীতি, মেধাভিত্তিক শিল্পযুগ বা সমৃদ্ধ ও উন্নত দেশ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য অন্তত চারটি সময়কালের লক্ষ্যকে সামনে রেখে এগিয়ে যাচ্ছি।

একথাটি খুব স্পষ্ট করে বলা দরকার যে ২০০৯ সালে বাংলাদেশের জাতীয় তথ্যপ্রযুক্তি নীতিমালা অনুমোদনের পর দেশটিতে সকল স্তরে ডিজিটাল বিপ্লব ঘটে। তৃণমূলের সাধারণ মানুষ থেকে রাষ্ট্রীয় জীবনের সর্বোচ্চ স্তর অবধি এই বিপ্লব এখন বহমান। এবারের নীতিমালাটি অতীতের সকল নীতিমালাকে অতিক্রম করে আমাদের সামনে চলার পথ তৈরি করছে।

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নীতিমালার সূচনা ২০০৩ সালে হলেও বস্তুত সার্বিক দিকগুলো ও কর্ম পরিকল্পনাসহ প্রথম পূর্ণাঙ্গ একটি নীতিমালা প্রণীত হয় ২০০৯ সালে। সরকার, শিল্পখাত, একাডেমিয়াসহ সকলের মতামত নিয়ে প্রণীত হয়েছিল সেই নীতিমালাটি। সেই অনন্য নীতিমালাটি নবায়ন হয় ২০১৫ সালে। শুরুর প্রায় এক দশক পর আমরা ২০০৯ সালের নীতিমালাটিকে একদম নতুন করে গড়ে তুলছি। ২১ ও ৪১ সালকে লক্ষ্য হিসেবে রেখে এই সময়ের বিশ্ব সভ্যতার রূপান্তর, বিগত সময়কালে আমাদের নিজেদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা এবং বিদ্যমান প্রযুক্তির সাথে আগামী দিনের প্রযুক্তিকে বিবেচনায় রেখে এই নীতিমালা প্রণীত হল।

২০০৯ ও ১৫ সালের নীতিমালার আলোকে বিগত সময়ে বাংলাদেশের ডিজিটাল রূপান্তরে বিপুল কর্মযজ্ঞ আয়োজিত হয়েছে এবং চলমান রয়েছে। সমগ্র দেশে ডিজিটাল সংযোগ স্থাপন, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট মহাকাশে উৎক্ষেপণ, ৪জির প্রবর্তন, জনগণের হাতে সরকারি সেবা পৌঁছানো তথা সরকারের ডিজিটাল রূপান্তর, শিক্ষার ডিজিটাল রূপান্তর, ডিজিটাল যুগের উপযোগী মানবসম্পদ উন্নয়ন, অভ্যন্তরীণ ও রপ্তানীর ক্ষেত্রে ডিজিটাল শিল্পের বিকাশ ও জনগণের জীবনযাপনের মান উন্নয়নে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহারে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের কাছে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

তলাহীন ঝুড়ির দেশ বা প্রযুক্তিতে ৩২৪ বছর পেছনে পড়া দেশ এখন বহু ক্ষেত্রে বিশ্বকে পথ দেখায়। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং অনুন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হবার প্রেক্ষিতে আমাদের এই নীতিমালা অসাধারণ ভূমিকা পালন করবে। আমরা বিবেচনায় রেখেছি যে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি দ্রুত পরিবর্তনশীল। এরফলে, নীতিমালায় বর্ণিত কিছু করণীয় বিষয়ের প্রাসঙ্গিকতা ক্ষেত্র বিশেষে হ্রাস পেয়েছে।

অন্যদিকে, সর্বাধুনিক প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে কীভাবে এদেশের উন্নতি ও সমৃদ্ধি অর্জন করা যায় সে বিষয়ে দৃষ্টিপাত করা আবশ্যক হয়ে পড়েছে। এছাড়া সরকারের রূপকল্প-২০২১, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা-২০৩০ (এসডিজি) ও রূপকল্প-২০৪১ এর লক্ষ্যসমূহ অর্জন এবং বৈশ্বিক পরিবর্তনশীলতাকে ধারণ করতেই ‘জাতীয় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নীতিমালা ২০১৫’ কে নতুন করে প্রণয়ন করা প্রয়োজন হয়।

এ বাস্তবতায় ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ বাস্তবায়নের মাধ্যমে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ে তুলে বাংলাদেশকে উন্নত এবং সমৃদ্ধ জাতিতে পরিণত করে জাতির পিতার স্বপ্নের স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তোলার লক্ষ্যে ‘জাতীয় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নীতিমালা ২০১৮’ প্রণয়ন করা হল।

লেখক : মন্ত্রী, ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়।

প্রকাশঃ জাগোনিউজ২৪.কম

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত