3817
Published on সেপ্টেম্বর 9, 2020অধ্যাপক ড. সৈয়দ সামসুদ্দিন আহমেদ:
ক্রান্তিলঘ্নে বাঙালি জাতিকে সঠিক নেতৃত্ব দিয়ে যিনি দেশকে গৌরবের আসনে সমাসীন করেছেন সেই টানা তিনবারের রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা। তার অসাম্প্রদায়িক, উদার, প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক ও বিজ্ঞানমনস্ক দৃষ্টিভঙ্গি তাঁকে দিয়েছে এক আধুনিক ও অগ্রসর রাষ্ট্রনায়কের স্বীকৃতি। ২৮ সেপ্টেম্বর একুশ শতকের অভিযাত্রায় দিনবদল ও জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তোলার কাণ্ডারী শেখ হাসিনার জন্মদিন।
১৯৪৭ সালের এই দিনে গোপালগঞ্জের টুঙ্গীপাড়া গ্রামে তাঁর জন্ম হয়। পিতা শেখ মুজিব তখন কলকাতায় ভারত ভাগের পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতি, দাঙ্গা প্রতিরোধ এবং লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত। তাই জন্মের পর দাদা ও দাদীর স্নেহ-আশীর্বাদ নিয়ে শুরু হয় শেখ হাসিনার জীবন।
দাদা শেখ লূৎফর রহমান নাতনীর নাম রাখেন ‘হাসিনা’।
মা তাকে বুকের ভেতর মমতায় জড়িয়ে রাখতেন। প্রথম সন্তান জন্মের খবর পেয়ে বাবা হঠাৎ একদিন বাড়ি এসে মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে ডাকলেন, ‘হাচুমণি’। মেয়ে কোলে নিয়ে কপালে এঁকে দিলেন স্নেহের চুম্বন। কে জানতো- সেদিনের ছোট্ট পরী ‘হাচুমণি’ই হবেন বাংলাদেশের কাণ্ডারী; জনতার প্রিয় নেতা! বিশ্বনেতৃত্বে তিনি এখন অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত।
নদী-খাল-বিল ও হাওর-বাওড়ের দেশ বাংলাদেশের অন্যান্য দশটি গ্রামের মতই টুঙ্গীপাড়াও সবুজে আচ্ছাদিত একটি গ্রাম। ওই গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে বাইগার নদী। নদীতে মাছ ধরা, নৌকা চলার দৃশ্য দেখে এবং সবুজ প্রকৃতির গন্ধ মেখেই শেখ হাসিনার শৈশব কাটে। প্রাথমিক শিক্ষা-জীবন শুরু সেখানেই।
এরপর ঢাকায় এসে আজিমপুর গার্লস হাইস্কুল থেকে স্কুল পর্যায়ের শিক্ষা সমাপন করে তিনি ভর্তি হন গভর্নমেন্ট ইন্টারমিডিয়েট গার্লস কলেজ; যা বর্তমানে বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ হিসেবে পরিচিত। সেখান থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন।
ওই কলেজে পড়াকালে ১৯৬৬-৬৭ মেয়াদে কলেজ ছাত্রী সংসদের ভিপি নির্বাচিত হন তিনি। ১৯৭৩ সালে শেখ হাসিনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৬৮ সালে প্রখ্যাত পরমাণু বিজ্ঞানী ড. এম.এ ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন শেখ হাসিনা।
আজীবন সংগ্রামী বঙ্গবন্ধু মানুষের অধিকার আদায় করতে গিয়ে বারবার জেল-জুলুমের শিকার হয়েছেন। তাই মা শেখ ফজিলাতুন্নেছার ছায়াসঙ্গী হয়েই কেটেছে শেখ হাসিনার। এ সময় পিতার রাজনৈতিক জীবনকে খুব ঘনিষ্ঠভাবে দেখে দেখে নিজেকেও ওতপ্রোতভাবে রাজনীতিতে আদর্শ নেতা হিসেবে গড়ে তোলেন।
শেখ হাসিনা একজন আত্মপ্রত্যয়ী, মানবতাবাদী, দূরদর্শী নেতৃত্বের অধিকারী। যার প্রকাশ ঘটেছিল সেই ছাত্রজীবনেই। তবে তারুণ্যের সেই দিনগুলো থেকে আজকের শেখ হাসিনা অভিজ্ঞতায় অনেক সমৃদ্ধ। দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি খুবই ঋদ্ধ। বুদ্ধিমত্তা আগের মতই প্রখর, সহনশীলতা ও দৃঢ়তা, ধৈর্য, যেন তার চরিত্রগত ধর্ম।
ভালোবাসায় ও সহমর্মিতায় তিনি সবার কাছে প্রিয় এবং বাঙলার মানুষের অতি আপনজন। তাই আজ আমাদের কাছে গর্বের বিষয় শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রতীক হিসেবে জনগণের কাছে নন্দিত। তিনি জনমানুষের নেতা। সেখান থেকে এখন বিশ্বনেত্রীতে পরিণত হয়েছেন।
১৫ আগস্টের শোকাবহ ঘটনা শেখ হাসিনার জীবনে অনেক বড় বেদনাদায়ক ঘটনা, এক গভীরতম ট্রাজেডি। এই শোক তাকে দেশ ও মানুষের জন্য কাজ করে যেতে শক্তি দিয়েছে, করে তুলে তুলেছে আরও দায়িত্বশীল।
স্বাধীনতার পর সাড়ে তিনবছর; বঙ্গবন্ধু মহাব্যস্ত একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ার কাজে। এ সময়টায় পাশে থেকে তাঁকে সহযোগিতা করেন বাঙালির স্বপ্নজয়ের সারথি বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা। এর মাঝে জার্মানিতে অবস্থান করা স্বামী প্রখ্যাত পরমাণু বিজ্ঞানী ওয়াজেদ মিয়ার কাছে যান শেখ হাসিনা। সঙ্গে ছিলেন ছোটবোন শেখ রেহানা।
তাই পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট কালরাতে স্বাধীনতাবিরোধী ও ক্ষমতালিপ্সুদের ভয়াবহ আক্রমণ থেকে রক্ষা পান তারা। কিন্তু নৃশংসভাবে প্রাণ দিতে হয় জাতির পিতা শেখ মুজিবসহ পরিবারের অন্য সদস্যদের। ঘাতকের বুলেট রেহাই দেয়নি ১০ বছরের ছোট্ট শিশু রাসেলকে। জাতির জন্য বেশ লজ্জার ও গ্লানির। ইতিহাসের একটি কালো অধ্যায়।
স্বভাবতই এ ঘটনা শেখ হাসিনার জীবনে বেশ বড় একটি বেদনাদায়ক ও গভীরতম ট্র্যাজেডি। ওইদিন যেসব লোভী ও বিশ্বাসঘাতকেরা বঙ্গবন্ধুর পবিত্র রক্ত মেখে নিজেরা হয়েছিল ঘাতক ও খুনি; তাদের সেই ভিত সেদিন শক্ত হতে পারেনি। চরিতার্থ করতে পারেনি তাদের পাপী হৃদয়ের লালসা।
খুনি মোশতাকেরা বাঙালির অস্তিত্বকে মুছে ফেলার অপচেষ্টার প্রয়াস চালিয়েছিল। তাদের উচ্ছিষ্টভোগী লোভীরা কেউ কেউ তলে তলে তাদেরই সমর্থন করে গেছে। ক্যূ-পাল্টা ক্যূ ও হত্যা এবং অস্ত্রের ঝনঝনানিতে তারা ক্ষমতা দখলের অপচেষ্টা, গণতন্ত্র এবং রাজনীতিকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠেছিল। দেশজুড়ে কায়েম করা হচ্ছিল দুর্নীতি ও দুঃশাসনের রাজত্ব।
একই সঙ্গে ইমডেমনিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশ জারি করে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার বন্ধ করে মোশতাক ও তার দোসরেরা। পাশাপাশি খুনিদের বাংলাদেশের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দেওয়া হয়। পুনর্বাসন করা হয় রাজনৈতিকভাবেও।
১৯৭৫ থেকে ১৯৮১- দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছিল সঙ্কটময়। সংশয় প্রতিহিংসা-দমনপীড়ন ও শোষণে মানুষ অসহায় হয়ে পড়ে। কাণ্ডারীহীন ‘নৌকা’য় মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়ে। এর মাঝে ১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারিতে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল হয়; সেখানে সর্বসম্মতিক্রমে প্রবাসে অবস্থানরত বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে দলের সভাপতি করা হয়।
১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে প্রত্যাবর্তন করলেন জননেত্রী শেখ হাসিনা। ১৯৭৫ সালের পর টানা ছয়বছর তাকে দেশে ফিরতে দেয়া হয়নি। মুজিবহীন বাংলাদেশে তাঁকে পেয়ে যেন দেশের মানুষ নতুন করে স্বপ্ন বুনতে শুরু করলো। শেখ হাসিনার এই ফিরে আসা ছিল- গণতন্ত্রের ফিরে আসা, দেশের উন্নয়ন ও প্রগতি এবং আজকের ডিজিটাল বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবির ফেরা।
দেশে ফেরার পর বিমানবন্দরে তাঁকে স্বাগত জানায় বাংলাদেশের লাখ লাখ জনতা। তার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিনের সংবধর্নায় লাখ লাখ মানুষের ভালোবাসায়-ই সেদিন শেখ হাসিনা খুঁজে পেয়েছিলেন পিতৃ শোকের সান্ত্বনা, মা হারানোর বেদনা।
আপামর মানষের মাঝেই তিনি খুঁজে পেলেন হারানো পিতা-মাতা, ভাইসহ স্বজনদের ভালোবাসা। তখন থেকেই তাঁর ধ্যান-জ্ঞান একটাই-দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণ এবং বিশ্বদরবারে বাঙালিকে একটি উন্নত জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তোলা।
জনগণের উদ্দেশ্যে সেদিন তিনি বলেন, আমি বাংলার মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য এসেছি। আপনাদের বোন হিসেবে, মেয়ে হিসেবে, আমি বঞ্চিত মানুষের পাশে থাকতে এসেছি। বাবা, মা, ভাই সব হারিয়েছি। আপনারাই আমার পরম আত্মীয়। … আপনাদের ভালোবাসা নিয়ে মুক্তির সংগ্রামে নামতে চাই। মৃত্যুকে ভয় পাই না। বাংলার মানুষের মুক্তির জন্য আমার বাবা আজীবন সংগ্রাম করেছেন। বাংলার মানুষের জন্যই জীবন দিয়েছেন। আমিও প্রয়োজনে বাবার মতো আপনাদের জন্য জীবন দিব।
বঙ্গবন্ধুকন্যার এই বক্তব্যে তখন দিশেহারা বাঙালি জাতির মাঝে যেন নতুন প্রাণের সঞ্চারিত হলো। তারা জেগে উঠলো নতুন আশায়, নতুন স্বপ্ন ও উদ্যমে। দৃপ্ত স্বপ্ন, আপসহীন প্রতিশ্রুতি আর অসহায় মানুষ গুলো কে নিয়ে জাতির পিতার দেখা অসমাপ্ত স্বপ্নের লক্ষ্য পানে এগিয়ে যাওয়া শুরু করলেন শেখ হাসিনা।
তাঁর সেদিনের সেই প্রত্যয় আর দূরদর্শী নেতৃত্বের ফলেই আজ এক সময়ের দুর্যোগের দেশ হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ এখন সমৃদ্ধির পথে সাবলীল গতিতে এগিয়ে চলেছে। বিশ্বে বাংলাদেশ এখন রোল মডেল।
দেশ থেকে শেখ হাসিনার প্রচেষ্টায় যেমন মঙ্গা দূর হয়েছে, তেমনই সৃষ্টি হয়েছে কর্মসংস্থান। তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর উদ্যোক্তা তৈরিতেও তার রয়েছে নানা উদ্যোগ। তাঁর ডিজিটাল বাংলাদেশ এখন বাস্তব। যার ফল আমরা এই বৈশ্বিক মহামারি করোনাকালে বেশ ভালোভাবে ভোগ করছি। এখন ঘরে বসেই অনলাইন প্লাটফর্মে অফিসিয়াল কাজও সম্পন্ন হচ্ছে।
পাশাপাশি দক্ষ হাতে রাষ্ট্র পরিচালনা করে শেখ হাসিনা দেশের মানুষের মাঝে স্বস্তি ফিরিয়ে এনেছেন। যুদ্ধাপরাধী ও বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার করে জাতিকে করেছেন কলঙ্কমুক্ত। কিন্তু তাঁর এই দীর্ঘপথ মোটেই মসৃণ ছিলো না, ছিলো কণ্টকাকীর্ণ।
আর এই সংগ্রামে শেখ হাসিনাকে কমপক্ষে ২১ বার হত্যাচেষ্টা চালানো হয়েছে। এর মধ্যে সর্বশেষটি ছিলো ২০০৪ এর ২১ আগস্টের ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা। সৃষ্টিকর্তার অপার মহিমায় ওইদিন প্রাণে বেঁচে যান তিনি। তবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তার শ্রবণশক্তি।
হত্যাচেষ্টাসহ ঘড়যন্ত্রের জাল ছড়িয়ে থাকলেও দমে যাওয়ার মানুষ নন শেখ হাসিনা। তিনি আজ অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ, বুদ্ধিমত্তায় প্রখর; সহনশীলতা ও দৃঢ়তা এবং ধৈর্য যেন তাঁর চরিত্রগত ধর্ম।
ভালোবাসায় ও সহমর্মিতায়ও তিনি বাংলার মানুষের প্রিয় এক ভগিনী, অতি আপনজন এবং একজন মমতাময়ী মা। তাই তো আজ তিনি বাংলাদেশের জনগণের হয়ে বিশ্বনন্দিত। বিশ্বের শীর্ষ নারী শাসকের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এক্ষেত্রে সরকারপ্রধান হিসেবে ভারতের ইন্দিরা গান্ধী, ব্রিটেনের মার্গারেট থ্যাচার ও শ্রীলংকার চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গার রেকর্ড ভেঙে দিয়েছেন তিনি।
বিরোধীদলের নেত্রী হিসেবেও শেখ হাসিনা ছিলেন আপোষহীন, সংগ্রামে ও আন্দোলনে একজন দূরদর্শী নেতা। দেশে ফেরার পর তৎকালীন সরকার তাকে ৩২ নম্বরের বাড়িতে যেতে দেয়নি। পিতা-মাতাসহ স্বজনদের হত্যার ঘটনায় মামলা পর্যন্ত করতে পারেননি তিনি।
শত নির্যাতন ও মানসিক কষ্ট নিয়েও মানুষের দুঃখ লাঘবে ১৯৮১ থেকে ১৯৯৬ সাল পযন্ত স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন করেছেন শেখ হাসিনা। তার পাশে ছিলেন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা।
এরপর দেশের আনাচে-কানাচে ঘুরেছেন, দলকে সংগঠিত করেছেন। এই সফরেও তার ওপর হামলা হয়েছে। ১৯৯৪ সালে বিরোধীদলে থাকাকালে পাবনার ঈশ্বরদী রেলস্টেশনে শেখ হাসিনাকে বহনকারী ট্রেনে গুলি ও বোমা হামলা চালানো হয়।
কিন্তু জনগণের ভালোবাসা যার সঙ্গে থাকে তাকে কী আর কোনো বিপদে ফেলা যায়! স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাই ঢাল হয়ে তাকে রক্ষা করেন। পিতার মতো অসীম সাহসী, দৃঢ়তায় অবিচল, দেশপ্রেম ও মানবিক গুণাবলী সম্পন্ন একজন আদর্শবাদী নেতা হিসেবে শেখ হাসিনা মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন।
পূর্ব থেকে পশ্চিম, উত্তর থেকে দক্ষিণ-তিনি চষে বেরিয়েছেন শেখ হাসিনা। দেশের যেকোনো সঙ্কটে তার নেতৃত্ব দলমত নির্বিশেষে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি তিনি। ১৯৯৬ সালে প্রথমবার সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। তিনি হন প্রধানমন্ত্রী। ২০০১ সাল পর্যন্ত দেশশাসন করেন।
এর মাঝেই শেখ হাসিনা প্রমাণ করেন শাসক হিসেবে তিনি যেমন দেশনন্দিত, তেমনি গণতন্ত্র ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় বিশ্বনেতার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত। তাঁর শাসনামলে আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে হতদরিদ্র মানুষের মাঝে খাদ্য ও অর্থ বরাদ্দ এবং অন্যান্য সহযোগিতা মানুষকে অসহায়ত্ব থেকে রক্ষা করেছিল।
দেশকে খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তুলে তিনি দুর্ভিক্ষ ও দারিদ্র্যের কষাঘাত থেকে মানুষকে রক্ষা করে ভাগ্যোন্নয়নের পথে দাঁড় করেন। নারীর ক্ষমতায়নে গৃহীত বিভিন্ন কর্মসূচি এবং সন্তানের অভিভাবক হিসেবে সব ক্ষেত্রে পিতার পাশাপাশি মাতার নামের স্বীকৃতিও ছিল তার একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ।
কৃষি উন্নয়নের লক্ষ্যে কৃষকদের ঋণ প্রদান, কৃষি সামগ্রীর মূল্যহ্রাস এবং সহজ প্রাপ্যতাও ছিল বিরাট অবদান। ওই সময়-ই সম্পন্ন হয় পার্বত্য শান্তি চুক্তি। যার ফলশ্রুতিতে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে চলা দীর্ঘদিনের সশস্ত্র সংগ্রামের সমাপ্তি হয়।
১৯৯৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি শান্তি বাহিনীর প্রধান জ্যোতিরিন্দ্র প্রিয় লারমা খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে অস্ত্র সমর্পণ করেন। ১৯৯৮ সালে শেখ হাসিনা ভারত ও পাকিস্তান সফরে গিয়ে তাদের আহ্বান জানান, পরমাণু যুদ্ধ থেকে বিরত থাকার।
তখন ওই দু’দেশের মধ্যে তখন পরমাণু অস্ত্রের পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণের কারণে উত্তেজনা চলছিলো। শেখ হাসিনার নেতৃতে প্রথম সরকার মানুষের কাছে আস্থা এনে দিয়েছিল। পরবর্তীতে পাঁচবছর দেশ শাসনের নামে চলে লুটপাট ও দুর্নীতি এবং জঙ্গিবাদ।
তারপরও ক্ষমতায় থাকার জন্য বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের মদদে চলে বিরোধীদলকে দমন করার হিংসাত্মক কর্মকাণ্ড। ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশজুড়ে চলে সিরিজ বোমা হামলা। এরপরের ইতিহাস তো সবারই জানা। সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়। ওই সরকার দুই বছর দেশ শাসন করে।
একপর্যায়ে রাজনীতি ও রাজনৈতিক নেতাদের কারারুদ্ধ করে তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা গ্রেপ্তার-রিমান্ড ও নির্যাতন চালানো হয়। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাও কারারুদ্ধ হন। নিঃসঙ্গ কারাগারে তাঁর ওপর চলে মানসিক নির্যাতন।
এমনকি কারাগারেও স্লোপয়জনিং করে তাকে হত্যা করার অপচেষ্টা চালানোর খবরও প্রকাশিত হয় সংবাদমাধ্যমে। তবে ভেঙে পড়ার মানুষ নন শেখ হাসিনা। সাব জেলে কারাবন্দি অবস্থায় আদালতে মামলা চলে, সেখানেও তিনি সাহসিকতার সঙ্গে মোকাবেলা করেন। তাঁর বিরুদ্ধে সব মিথ্যা মামলার অভিযোগের কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন- তাঁকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেওয়ার ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র চলছে।
এক পর্যায়ে ওই সময়ের তত্ত্বাবধায়ক সরকার দেশে নির্বাচন দেয়। সে সময় তার প্রিয় বাঙলার জনগণ মুক্তিযুদ্ধেও চেতনার ধারক ও বাহক শেখ হাসিনার সঙ্গে ছিলো। যার প্রমাণ তারা দিয়েছে ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে ভোটের মাধ্যমে। বিপুল ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট।
এরপরই শুরু হয় শেখ হাসিনার দিন বদলের পদক্ষেপ। তিনি জাতিকে নতুন ভিশন দিয়েছেন, যার নাম রূপকল্প-২০২১; বাংলাদেশকে একটি মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত করাই এর ভিশন। দিয়েছেন রূপকল্প-২০৪১, শতবর্ষব্যাপী ডেল্টা প্ল্যান।
শেখ হাসিনা ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’র স্বপ্ন দেখিয়েছেন; যেখানে সর্বাধুনিক তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষ জনশক্তি থাকবে। আর সেই কর্মসূচি নেওয়া হয় একেবারে তৃণমূল থেকে। শেখ হাসিনার পরিকল্পনায় এই উদ্যোগের স্থপতি তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ও তাঁর সুযোগ্যপত্র সজীব ওয়াজেদ জয়।
ডিজিটাল বাংলাদেশ-এখন বাস্তব। পাশাপাশি শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি ও কর্মসংস্থানের ব্যাপক উন্নয়নের মাধ্যমে বাংলাদেশকে আজ মডেল হিসেবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন তিনি। নারীর ক্ষমতায়নে নেওয়া নানা উদ্যোগও বেশ প্রশংসিত হয়েছে। প্রায় ১১ লাখ নির্যাতিত রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে মানবতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
বঙ্গবন্ধুকন্যার কাছে দেশ ও দেশের মানুষ-ই হলো প্রধান কথা। এর বাইরে তিনি যেতে চান না, যেতে পারেন না এবং যানও না। এটাই তাঁর বড় গুণ। ২০০৯ সালে বিডিআর বিদ্রোহ দমনকালে তাঁর ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তা আমরা জানি। রাষ্ট্রনায়কোচিত বক্তব্য, জ্ঞান, আন্তর্জাতিক মহলে প্রশংসিত হয়েছে–এটা আমাদের কাছে অনেক বড় প্রাপ্তি।
বর্তমানে কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতেও নেওয়া পদক্ষেপে তাঁর সুযোগ্য ও দূরদর্শী নেতৃত্বের ছাপ রয়েছে। এসব উদ্যোগের ফলেই অদৃশ্য ভাইরাস দেশে সেভাবে ছড়াতে পারেনি। তাঁর পদক্ষেপ ও নেতৃত্বে করোনাপরিস্থিতি মোকাবেলা করে নতুন সূর্যের আলোয় আলোকিত হবে লাল-সবুজের বাংলাদেশ।
করোনা পরিস্থিতি-ই নয়, বর্তমান বিশ্ব যখন অর্থনৈতিক মন্দায় জর্জরিত, দেশে দেশে মূল্যবৃদ্ধিসহ সমস্যা জটিল হচ্ছে তখন একজন শেখ হাসিনার হাত ধরেই শক্তিশালী হচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। ২০০৫ সালে দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ৪০ শতাংশ। এখন তা নেমে এসেছে ২০ শতাংশে।
মহামারির মধ্যে বিশ্বের নানা দেশ অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়লেও বাংলাদেশে শুধু গত জুলাই মাসেই রেকর্ড রেমিট্যান্স অর্থাৎ ২.৬ বিলিয়ন (২৬০ কোটি) মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা।
তবে দেশে সমস্যা যে নেই তা নয়। বয়সে ৫০ এর কাছাকাছি থাকা দেশটির আরও এগিয়ে যেতে হবে। দেশের মানুষ ন্যূনতম শান্তি ও স্বস্তিতে জীবনযাপন করছে। ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য একটি সমৃদ্ধ ও নিরাপদ বাংলাদেশ করার উদ্যোগও নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী; যেখানে শিক্ষা-স্বাস্থ্য-কর্মসংস্থান ছাড়াও সৃজনশীল প্রতিভা বিকাশের সম্ভাবনা থাকবে।
রাজনীতি ও বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বিশ্বের অনেক প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্র শেখ হাসিনাকে সম্মানসূচক পুরস্কারে ভূষিত করেছে। এর মধ্যে- ইউনেস্কো’র হুফে বোয়নি শান্তি পুরস্কার (১৯৯৮), মাদার টেরিজা পুরস্কার (১৯৯৮), মহাত্মা গান্ধী পুরস্কার (১৯৯৮), বিশ্ব খাদ্য সংস্থার সেরেস পদক (১৯৯৯), পার্ল এস বাক পুরস্কার (১৯৯৯), যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক সম্মানসূচক ডক্টর অব লজ ডিগ্রি (ফেব্রুয়ারি ১৯৯৭), জাপানের ওয়াসেদা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানসূচক ডক্টর অব লজ ডিগ্রি (জুলাই ১৯৯৭), যুক্তরাজ্যের অ্যাবারটে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক সম্মানসূচক ডক্টর অব ফিলোসফি ডিগ্রি (অক্টোবর ১৯৯৭), ভারতের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ডিলিট সহ দেশিকোত্তম উপাধি (জানুয়ারি ১৯৯৯), অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক সম্মানসূচক ডক্টর অব লজ ডিগ্রি (অক্টোবর ১৯৯৯) এবং ব্রাসেলসের ক্যাথলিক বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক সম্মানসূচক ডক্টর অব লজ ডিগ্রি (ফেব্রুয়ারি ২০০০)। বিশ্ব শান্তি ও উন্নয়নে অবদান রাখার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ব্রিজপোর্ট বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ২০০০ সালের ৫ সেপ্টেম্বর সম্মানসূচক ডক্টর অব হিউমেন লেটারস প্রদান করে।
২০১০ সালে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যসমূহ (এমডিজি) অর্জনে বিশেষ করে শিশু মৃত্যুর হার হ্রাসে অবদানের জন্য জাতিসংঘের অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন প্রধানমন্ত্রী। ২০১৫ সালে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে আইসিটি’র ব্যবহারে প্রচারণার জন্য শেখ হাসিনাকে ‘আইসিটি সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট অ্যাওয়ার্ড’ প্রদান করা হয়। দেশের উন্নয়নে তার অব্যাহত অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ তাকে এ পদক প্রদান করা হয়।
উইমেন ইন পার্লামেন্ট (ডব্লিউআইপি) ও ইউনেস্কো বাংলাদেশ প্রধানমন্ত্রীকে ‘ডব্লিউআইপি গ্লোবাল ফোরাম অ্যাওয়ার্ড’ প্রদান করে। ২০১৯ সালের মার্চ মাসে দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় রাজনৈতিক অঙ্গনে লিঙ্গ বৈষম্য হ্রাসে অগ্রণী ভূমিকা পালনের জন্য তাকে এ পদক দেয়া হয়।
এছাড়া নারী শিক্ষা প্রসারের জন্য ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে শেখ হাসিনাকে ‘ট্রি অব পিস’ পুরস্কার দেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী ২০১১ ও ২০১৩ সালে দু’বার সাউথ-সাউথ অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন। স্বাস্থ্য খাতে তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে শিশু ও মাতৃ মৃত্যুর হার হ্রাস এবং ক্ষুধা ও দারিদ্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বিশেষ অবদান রাখার জন্য তাকে ওই সম্মাননা দেয়া হয়।
ইন্দিরা গান্ধী শান্তি পুরস্কার (২০০৯), ইন্দিরা গান্ধী স্বর্ণ পদক, হেড অব স্টেট পদক, গ্লোবাল ডাইভারসিটি অ্যাওয়ার্ড (২০১১, ২০১২) ও নেতাজী স্মৃতি পুরস্কার (১৯৯৭) পেয়েছেন শেখ হাসিনা। পাশাপাশি, যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল ইউনিভার্সিটি ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে শেখ হাসিনাকে একটি সনদ প্রদান করে। খাদ্য উৎপাদনের স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন ও আইসিটি উন্নয়নে অবদান রাখার জন্য তাকে ওই স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
২০০৫ সালে রাশিয়ার পিপলস ফ্রেন্ডশিপ বিশ্ববিদ্যালয়ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করে।
শান্তি, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষায় অবদানের জন্য তাকে ওই সম্মাননা দেওয়া হয়। ২০১৫ সালে শেখ হাসিনা পরিবেশ বিষয়ক সর্বোচ্চ বৈশ্বিক পুরস্কার চ্যাম্পিয়নস অব দ্য আর্থ পুরস্কার লাভ করেন। বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবেলায় দূরদর্শী পদক্ষেপে নেয়ায় তাকে সেই স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
২০১৬ সালে শেখ হাসিনাকে ‘এজেন্ট অব চেঞ্জ’ পুরস্কার ও ‘প্লানেট ৫০-৫০ চ্যাম্পিয়ন’ প্রদান করা হয়। নারী ক্ষমতায়নে অসামান্য অবদান রাখার জন্য তাকে এ পুরস্কার দেওয়া হয়। ওই বছরই নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদরদপ্তরে এক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে ইউএন উইমেন প্রধানমন্ত্রীকে ‘প্লানেট ৫০-৫০ চ্যাম্পিয়ন’ পুরস্কার এবং গ্লোবাল পার্টনারশিপ ফোরাম তাকে ‘এজেন্ট অব চেঞ্জ’ পুরস্কার প্রদান করেন।
আমাদের বিশ্বাস জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের যোগ্য উত্তরসুরী হিসেবে শেখ হাসিনা তাঁর সততা, আত্মত্যাগ, দূরদর্শিতা ও দেশপ্রেমের মাধ্যমে বিশ্বনেতৃত্বের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন- তা বলাই যায়। তাঁর নেতৃত্বেই উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছে মানুষ। জন্মদিনে মানবতার নেত্রী, জননেত্রী শেখ হাসিনার প্রতি গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি। শুভ জন্মদিন। আপতি শতবর্ষী হোন।
লেখক: উপাচার্য, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়