1016
Published on জুলাই 31, 2022গঠনমূলক ছাত্র রাজনীতি করতে হলে, বঙ্গবন্ধুর ছাত্র জীবন সম্পর্কে জানতে হবে। অখণ্ড ভারতবর্ষের অখণ্ড বাংলার ছাত্ররাজনীতির কেন্দ্রভূমি ইসলামিয়া কলেজে স্নাতকের ছাত্র অবস্থায় তরুণ শেখ মুজিবুর রহমান কীভাবে নেতা হলেন? তিনি ছাত্রনেতা হিসেবে কী ভূমিকা পালন করতেন? তৎকালীন পূর্ববঙ্গ থেকে গিয়ৈও তিনি কলকাতার নামকরা প্রতিষ্ঠানের নামকরা ছাত্রনেতা হয়ে উঠেছিলেন-ভৌগলিক অবস্থানও বলে দিচ্ছে এটি কোনো সহজ ঘটনা নয়। নীতি, ন্যায্যতা, কঠোর পরিশ্রম, মানুষের জন্য ভালোবাসাই বঙ্গবন্ধুকে আঞ্চলিকতার প্রতিবন্ধকতা ছিন্ন করে বাংলার তরুণ নেতা প্রতিষ্ঠিত করেছিল দেশভাগেই আগেই। এসব ঘটনা হয়তো সবার জানা নাই। তবে জানা উচিৎ।
‘পরীক্ষা দিয়ে কলকাতায় যাই। সভা–সমাবেশে যোগদান করি। আবার পড়তে শুরু করলাম। পাস তো আমার করতে হবে। শহীদ সাহেবের (হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী) কাছে এখন প্রায়ই যাই।... এই বৎসর আমি দ্বিতীয় বিভাগে পাস করে কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হয়ে বেকার হোস্টেল থাকতাম।’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে কলকাতার বেকার হোস্টেলে ওঠার বর্ণনা এসেছে এভাবে। বইয়ের নানা জায়গায় এই হোস্টেলের বর্ণনা এসেছে ঘুরেফিরে। সেই বর্ণনায় এক তরুণ মুজিবের ক্রমেই রাজনৈতিক নেতা হয়ে ওঠার নানা প্রমাণ মেলে। সেই মুজিব একদিন বঙ্গবন্ধু ও জাতির জনক হয়েছিলেন। সেই মুজিবই প্রতিষ্ঠা করেছেন স্বাধীন বাংলাদেশ, ঘুচিয়ে দিয়েছেন বাঙালির হাজার বছরের দাসত্বের ইতিহাস।
কিন্তু আমরা কী জানি, আমাদের জাতির পিতার ছাত্রজীবনও অনেকটা আমাদের মধ্যবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীদের মতোই ছিল। জীবন-সংসার-সমাজের সব গতানুগতিক প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করেও দেশ ও দশের কাজে আত্মনিয়োগ করতে পেরেছিলেন তিনি। ছাত্র জীবনে উচ্চ শিক্ষার জন্য অবিভক্ত বাংলায় (অবিভক্ত ভারতে) তরুণ মুজিব গিয়েছিলেন তৎকালীন অন্যতম সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে। ছিলেন বেকার হোস্টেলে। কলকাতার তালতলা থানার বেকার হোস্টেলটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯১০ সালে। ৮ স্মিথ লেনের এই হোস্টেলে বাস করেই বন্ধবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কলকাতার ইসলামিয়া কলেজ থেকে স্নাতক পাস করেন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পরবর্তী পরিস্থিতে এখন সেই ইসলামিয়া কলেজের নাম হয়েছে মৌলানা আজাদ কলেজ। বেকার হোস্টেলটি এখন হয়েছে সরকারি হোস্টেল। একসময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া মুসলিম ছাত্রদের থাকার জন্য এটি তৈরি হয়েছিল।
১৯৪১ থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু ইসলামিয়া কলেজে পড়েন। এই সময় বেকার হোস্টেলের ২৪ নম্বর কক্ষে ছিলেন তিনি। ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন বঙ্গবন্ধু। এখনো কলেজের ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদকের বোর্ডে নাম রয়েছে বঙ্গবন্ধুর। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে তার সাধারণ সম্পাদক হওয়ার ঘটনার ঘটনাওও আছে। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘এই সময় আমি বাধ্য হয়ে কিছুদিনের জন্য ইসলামিয়া কলেজের স্টুডেন্ট ইউনিয়নের (ছাত্র সংসদের) সাধারণ সম্পাদক পদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হই। অনেক চেষ্টা করেও দুই পক্ষের মধ্যে আপস করতে পারলাম না। দুই গ্রুপই অনুরোধ করল, আমাকে সাধারণ সম্পাদক হতে, নতুবা তাদের ইলেকশন করতে দেওয়া হোক। ইলেকশন আবার শুরু হলে বন্ধ করা যাবে না। মিছামিছি গোলমাল, লেখাপড়া নাই, টাকা খরচ হতে থাকবে। আমি বাধ্য হয়েই রাজি হলাম এবং বলে দিলাম, তিন মাসের বেশি আমি থাকব না।’
বঙ্গবন্ধুর বেকার হোস্টেল জীবনের বর্ণনায় সেই সময়ের সামাজিক পরিস্থিতিরও পরিচয় উঠে এসেছে। শেখ মুজিবুর রহমান তার তারুণ্যের স্মৃতিচারণা করে নিজের জীবনীতে লিখেছেন, ‘বেকার হোস্টেলের কতগুলো রুম ফ্রি ছিল, গরিব ছাত্রদের জন্য। তখনকার দিনে যার প্রয়োজন তাকেই তা দেওয়া হতো। আজকালকার মতো টেলিফোনে দলীয় ছাত্রদের রুম দেওয়ার জন্য অনুরোধ আসত না।’
বর্তমানে আজাদ কলেজ নামে পরিচিত তৎকালীন ইসলামিয়া ককলেজের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা বাঙালির জাতির অবিসংবাদিত এই নেতার স্মৃতিকে ধারণ করতে পেরে এখনও গর্ববোধ করেন। আজাদ কলেজের অধ্যাপক জামিল আহমেদ এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু আমাদের কলেজে ছিলেন, তা নিয়ে আমরা গর্ববোধ করি। সারা দুনিয়া তাকে চেনে, এই প্রতিষ্ঠানের প্রাক্তন শিক্ষার্থী হিসেবে। উনি এখানে পড়েছেন। এখানকার ছাত্র সংসদে তিনি ছিলেন। এখানে সংগঠন তৈরি করেছেন। সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে পরে একটি দেশ নির্মাণ করেছেন।’
১৯৯৮ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উদ্যোগে বেকার হোস্টেলের ২৩ ও ২৪ নম্বর কক্ষ নিয়ে গড়া হয় বঙ্গবন্ধু স্মৃতিকক্ষ। এই স্মৃতিকক্ষে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর ব্যবহৃত খাট, চেয়ার, টেবিল ও আলমারি। তৎকালীন বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধে পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতিবসু ২৪ নম্বরের পাশের ২৩ নম্বর কক্ষটিকে যুক্ত করে স্মৃতিকক্ষ গড়ার উদ্যোগ নেন। সেখানে বঙ্গবন্ধুর একটি ভাস্কর্যও স্থাপন করা আছে।
কলকাতায় বাংলাদেশের উপহাইকমিশনার তৌফিক হাসান বাংলাদেশের গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বেকার হোস্টেলে ছিলেন ২৪ নম্বর কক্ষে। বেকার হোস্টেলের বঙ্গবন্ধুর কক্ষটি আমরা তার লেখা কিছু বই এবং তাকে নিয়ে লেখা কিছু বই দিয়ে সাজিয়েছি। বঙ্গবন্ধু ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তার নেতৃত্বের যে গুণ তার বিকাশ হয় সেই সময় থেকে। তাই ইসলামিয়া কলেজ বা মৌলানা আজাদ কলেজ এবং বেকার হোস্টেলের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি ওতপ্রোতভাবে জড়িত।’
তরুণ মুজিবের রাজনৈতিক জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় কেটেছে কলকাতায়। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিচিহ্নগুলো এখনো সগর্ব টিকে আছে সেই নগরে। আমাদের দেশের নতুন প্রন্মের প্রতিটি সন্তানের বঙ্গবন্ধুর ইতিহাস জানা উচিৎ। কারণ বঙ্গবন্ধুর ছাত্র রাজনীতি ও যুব রাজনীতি সম্পর্কে না জানলে, শুধু সংক্ষেপে জাতীয় পরিসরের ঘটনাগুলোকে কয়েক লাইনে মুখস্ত করে বঙ্গবন্ধুকে ধারণ করা অসম্ভব। বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়কে বুঝতে হলে শেখ মুজিবের বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠা ও জাতির পিতা হয়ে ওঠার ধাপগুলো বুঝতে হবে, তাহলেই আমরা আমাদের পূর্বপ্রজন্মের মানুষের রক্তের স্পন্দন বুঝতে পারবো। আর তাহলেই আমাদের এই স্বাধীনতা একদিন পূর্ণতা পাবে, আর তাহলেই হাজার বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে আমাদের পূর্বপুরুষদের গভীর দীর্ঘশ্বাসের শব্দ অনুধাবন করতে পারবো আমরা। তা যদি পারি, তাহলেই নতুন প্রজন্ম বুঝতে পারবে যে- এই স্বাধীনতা কেনো জরুরি ছিল আর কোন কোন লক্ষ্য অর্জনের জন্য আপামর বাঙালি বঙ্গবন্ধু ডাকে সাড়া দিয়ে মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন।