সমুদ্রসীমা নিয়ে নিষ্ক্রিয়তায় পঁচাত্তর-পরবর্তী সরকারের তীব্র সমালোচনা করলেন প্রধানমন্ত্রী

437

Published on জুলাই 13, 2014
  • Details Image

তিনি বলেন, দুই প্রতিবেশী দেশের সংগে মামলা করে সমুদ্র সীমা বিজয় সহজ কাজ ছিল না। ভারত এবং মিয়ানমার বাংলাদেশের নিকট প্রতিবেশী দেশ। বন্ধুত্বপূর্ণ সর্ম্পক বজায় রেখে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করে বিজয়ী হওয়া সহজ ছিল না। ’৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকাকালে আওয়ামী লীগ সরকার অনেকগুলো কাজ এগিয়ে রেখে যায়। পরবর্তি সময়ে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিলে মহীসোপানে বাংলাদেশের অধিকার প্রতিষ্ঠা হতো।

একুশ বছর যারা ক্ষমতায় ছিল সমুদ্রসীমা নিয়ে তারা কেন উদ্যোগ নেয়নি প্রশ্ন রেখে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আসলে দেশের ভালো এবং ভবিষ্যত নিয়ে তাদের কোন চিন্তা ভাবনাই ছিল না। শুধু ক্ষমতা দখল এবং ভোগ এটাই ছিল তাদের প্রধান কাজ।’

২০০৮ সালে নির্বাচনে বিজয়ের পর তাঁর সরকার এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার আর্ন্তজাতিক আদালতে দাবি না তুলে সমুদ্রসীমায় বাংলাদেশ তার অধিকার হারাতো ।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, সমুদ্রে অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালে সমুদ্রসীমা আইন করে যান। সে সময় জাতসংঘও এই আইন করেনি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘জাতির পিতার দূরদর্শিতার কারণেই মিয়ানমার এবং ভারতের সাথে সমুসীমা মামলায় আমরা বিজয়ী হয়েছি।’

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ সচিবালয়ে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় পরিদর্শনকালে কর্মকর্তা কর্মচারিদের উদ্দেশ্যে ভাষণে একথা বলেন।

অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন ডাক, টেলি যোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী ও তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক।

অন্যান্যের মধ্যে ডাক ও টেলি যোগাযোগ সচিব আবু বকর সিদ্দিক, তথ্যপ্রযুক্তি সচিব নজরুল ইসলাম খান এবং প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব এ কে এম শামীম চৌধুরী এ সময় উপস্থিত ছিলেন।

ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নে ডাক, টেলি যোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মিন্ত্রনালয়ের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উদ্দেশ্যে বলেন, জাতির পিতা স্বপ্ন দেখতেন বাংলাদেশ হবে প্রাচ্যের সুইজারল্যান্ড। পচাঁত্তরে তাকে হত্যার পর সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি। যে আদর্শ এবং লক্ষ্য নিয়ে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে তা বাস্তবায়নই সবার দায়িত্ব।

সরকারের সময় আছে আর ৪ বছর ৫ মাস উল্লেখ করে তিনি সংশ্লিষ্ট সবাইকে জনগণের ভাগ্য উন্নয়নে দায়িত্বশীলতার সংগে কাজ করার আহবান জানিয়ে বলেন, ‘৫ জানুয়ারীর নির্বাচনে জয়ী হয়ে আবার এসেছি বলেই কাজের ধারাবাহিকতা রাখতে পেরেছি। আমরা আশাবাদী বাকী কর্মসূচিও আমরা বাস্তবায়ন করতে পারবো।’

শেখ হাসিনা বলেন, বিএনপি আন্দেলনের নামে মানুষ হত্যা এবং ধংসযজ্ঞ শুরু করেছিল। তারপরেও বাংলাদেশের ইতিহাসে আওয়ামী লীগ সরকারেই পেরেছে ৯৬ ভাগ বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে- আর কেউ তা পারেনি।

তিনি বলেন, ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নির্বাচনী ইশতেহারে প্রযুক্তিভিত্তিক ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ার একটি সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা দেশবাসীর সামনে তুলে ধরে। বিপুল জনসমর্থন নিয়ে নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ২০০৯ সালে সরকার গঠন করার পর আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কাজে হাত দেই। সেসময় আমাদের পরিকল্পনাকে অনেকে অবাস্তব হিসেবে আখ্যা দিয়েছিলেন। কিন্তু ৫ বছর পর ডিজিটাল বাংলাদেশ আর অবাস্তব কিছু নয়। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনগণও এর সুফল ভোগ করছেন।

স্বাস্থ্যখাতে তথ্য প্রযুক্তির সফল ব্যবহারের অবদান স্বরূপ ২০১১ সালে বাংলাদেশ মর্যাদাপূর্ণ ‘সাউথ সাউথ এওয়ার্ড’ লাভ করে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে জনগণের দোরগোড়ায় সরকারি সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ আই টি ইউ বাংলাদেশকে ২০১৪ সালের ‘ওয়ার্ল্ড সামিট অন ইনফরমেশন সোসাইটি’ পুরস্কারে ভূষিত করেছে।

টেলিযোগাযোগ ও আইসিটি খাতের কার্যক্রমকে সমন্বিতভাবে সম্পাদনের লক্ষ্যে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় এবং তথ্য ও যোগাযোগ তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়কে একীভূত করে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় হিসেবে পুনর্গঠন করায় মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম আরও গতিশীল হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি বিজ্ঞান যে ভাবে বিকষিত হচ্ছে আমরা তাকে ব্যাবহার করে অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবো। জাতির পিতার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পারবো । সেই লক্ষ্যে নিয়েই আমরা কাজ করছি’।

১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকার মোবাইল ফোনের মনোপলি ভেঙ্গে দেয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, এরফলে টেলিযোগাযোগ খাতে এক ব্যাপক পরিবর্তনের ধারা সূচিত হয়। তখন মাত্র একটি মোবাইল ফোন কোম্পানি ছিল। বর্তমানে দেশে সরকারি একটিসহ মোট ৬টি কোম্পানি অপারেট করছে। বর্তমানে ১১ কোটি ৬২ লাখ সিম ব্যবহৃত হচ্ছে। যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৭৮শতাংশ।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, সুষ্ঠু ও প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ সৃষ্টির ফলে ২০০১ সালে মোবাইলের কলচার্জ যেখানে প্রতিমিনিট ছিল প্রায় ৯ টাকা ৬০ পয়সা, বর্তমানে তা গড়ে প্রতি মিনিট ৮৩ পয়সায় নেমে এসেছে।

তিনি বলেন, বর্তমানে দেশব্যাপী ২০ হাজার ৪০৩ কিলোমিটার অপটিক্যাল ফাইবার নেটওয়ার্ক রয়েছে। মোবাইল কোম্পানীসমূহের প্রায় ৪৫ হাজার বিটিএস রয়েছে। দেশে বর্তমানে ৭ হাজার তথ্যসেবা কেন্দ্র এবং ১০৪টি রেডিও ও টিভি সম্প্রচার কেন্দ্র রয়েছে। বিটিআরসি বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ১ হাজার ৮৮১টি লাইসেন্স প্রদান করেছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর সরকার ৫টি মোবাইল কোম্পানিকে বহু কাঙ্ক্ষিত ৩জি লাইসেন্স প্রদান করেছে। ৩জি’র কাজ সমাপ্তির পর অচিরেই ৪জি’র কার্যক্রম শুরু হবে।

আন্তর্জাতিক যোগাযোগ নিরবচ্ছিন্ন ও দ্রুততর করার জন্য বিদ্যমান সাব-মেরিন কেবল-এর সঙ্গে আরও একটি কেবল সংযুক্ত করার জন্য সম্প্রতি বাংলাদেশ চুক্তি স্বাক্ষর করেছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, পটুয়াখালীর কুয়াকাটায় এর ল্যান্ডিং স্টেশনের কাজ ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। এরফলে ব্যান্ডউইথ ক্যাপাসিটি ১৩০০ এনঢ়ং বৃদ্ধি পাবে।

তিনি বলেন, সরকার দ্বিতীয় সাবমেরিন কেবল স্থাপন করতে যাচ্ছে। তথ্য লুকানো যাবেনা এবং সব তথ্য বাইরে চলে যাবে এই অজুহাতে ১৯৯১-৯৬ মেয়াদে বিএনপি সরকার বিনা খরচে সাবমেরিন কেবল নেয়নি। পরবর্তীকালে আমাদের টাকা দিয়ে সেটা নিতে হয়েছে। সে সময় সাবমেরিন কেবল নিলে আমরা অনেক আগেই দ্বিতীয় কেবল স্থাপন করতে পারতাম।

তিনি বলেন, দেশের ২ হাজার ৭৫০টি পোস্ট অফিসে ইলেকট্রনিক মানি অর্ডার সার্ভিস চালু করা হয়েছে। ৮ হাজার পাঁচশত ডাকঘরকে পোস্ট-ই- সেন্টার এ রূপান্তরের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে ১৪৮টি ডাকঘরকে পোস্ট-ই-সেন্টার এ রূপান্তর করা হয়েছে। সরকার ২০১০ সালে কুরিয়ার সার্ভিস-কে আইনী কাঠামোর মধ্যে আনার জন্য ‘মেইলিং অপারেটর ও কুরিয়ার সার্ভিস লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষ’ গঠন করে।

দেশে বর্তমানে প্রায় ১১০০ টি কুরিয়ার সার্ভিস প্রতিষ্ঠান রয়েছে এবং এ খাতে প্রায় ১৫ লাখ জনবলের কর্মসংস্থান হয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে এডুকেশন লাইন, টেলি হেলথ, কৃষি জিজ্ঞাসা, ইউটিলিটি বিল পেমেন্ট, মোবাইল রেমিটেন্স সার্ভিস, রেলওয়ে টিকেট ক্রয়, বিবিসি জানালা, মোবাইল ব্যাংকিং, হজ্জ্ব তথ্য ইত্যাদি সেবা প্রদান করা হচ্ছে। এছাড়া, এসএমএস ও ইন্টারনেট-এর মাধ্যমে পরীক্ষার ফল প্রকাশ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আবেদনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

শেখ হাসিনা বলেন, তার সরকারের নেয়া পদক্ষেপগুলোর লক্ষ্য দুটি। একটি প্রযুক্তির ব্যাবহার এবং অপরটি কর্মসংস্থান।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০১৫ সালের মধ্যে দেশের সকল ইউনিয়ন পরিষদ পর্যন্ত অপটিক্যাল ফাইবার নেটওয়ার্ক স্থাপনের কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে। দেশে স্মার্ট ফোন তৈরিরও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি ২৫ হাজার ওয়েবসাইট নিয়ে বিশ্বের বৃহত্তম ওয়েব পোর্টাল ‘জাতীয় তথ্য বাতায়ন’ চালু করা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই নামটি তিনি দিয়েছেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আইটি শিক্ষা সম্প্রসারণের জন্য ৩ হাজার ৫১২টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার ল্যাব স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়াও ভারত সরকারের সহায়তায় প্রতিটি জেলায় একটি করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মোট ৬৪টি ল্যাব স্থাপিত হয়েছে ।

দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে জনসেবা পৌঁছে দেওয়ার জন্য বিদ্যুৎ বিহীন ১ হাজার ১৩ টি ইউনিয়নে সৌর বিদ্যুৎ এবং ইউনিয়ন তথ্যসেবা কেন্দ্র স্থাপনসহ উপজেলা পর্যায়ে ১৪৭টি কমিউনিটি ই-সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে।

এছাড়াও সার্কের সহায়তায় ২০০টি ইউনিয়ন তথ্যসেবা কেন্দ্রকে ল্যাপটপ, প্রিন্টার, স্ক্যানার ও মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর সরবরাহ করা হয়েছে। ইউনিয়ন তথ্য সেবা কেন্দ্র থেকে এখন প্রতি মাসে প্রায় ৪০ লাখ মানুষ সেবা গ্রহণ করছেন।

তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে আউটসোর্সিং-এর ক্ষেত্রে বিশ্বে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থান তৃতীয় উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, সফটওয়্যার এবং আইটি সেবা রপ্তানি করে বাংলাদেশ বছরে প্রায় ১২৫ মিলিয়ন ইউএস ডলার আয় করছে। এক্ষেত্রে তিনি আরো ব্যাপক ভাবে ট্রেনিং এবং ভাষা শিক্ষার উপর গুরুত্বারোপ করেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আউটসোর্সিং-এর মাধ্যমে মহিলাদের কর্মসংস্থান ও নারীর ক্ষমতায়ন সৃষ্টির লক্ষ্যে ‘বাড়ী বসে বড় লোক’ কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এ কর্মসূচির আওতায় ২৭৬টি উপজেলায় ১২ হাজার ৪ শত ২০ জন নারীকে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হবে। ইতোমধ্যে ৬ হাজার ২৭৫ জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।

ঢাকার মহাখালী, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও বরিশালে আইসিটি ভিলেজ স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আমরা দেশের প্রতিটি জেলায় ১টি আইটি ভিলেজ সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক স্থাপনের পরিকল্পনা নেয় হয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী এ সব কাজ সফল ভাবে করার জন্য কর্মকর্তাদের সততা, কর্মদক্ষতা এবং আন্তরিকতা কামনা করেন।

তিনি ২০২১ সাল নাগাদ বাংলাদেশকে একটি ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত মধ্যম-আয়ের দেশে পরিণত করার জন্য ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস চালাবার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।

TAGS:

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত