819
Published on মার্চ 17, 2016প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি আমাদের শিশুদের বলবো, জীবনের সব থেকে বড়ো সম্পদ হচ্ছে শিক্ষা। কাজেই তোমরা পড়াশোনা কর। খেলাধুলা,সংস্কৃতি এবং পড়াশোনা এইসব দিকে তোমাদেরকে আরও আত্মনিবেদন করতে হবে। যাতে ভবিষ্যতের জন্য সুনাগরিক হিসেবে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করতে পার।’
তিনি বিদ্যাশিক্ষাকে জীবনের সবচেয়ে বড়ো অর্জন বলে আখ্যায়িত করেন। তিনি এবং তাঁর বোন শেখ রেহানা তাদের সন্তানদেরকেও সে শিক্ষাই দিয়েছেন উল্লেখ করে বলেন,‘আমরা তোমাদেরকে একটাই সম্পদ দিয়ে যাব- যা আমাদের পিতা-মাতার কাছ থেকেও আমরা পেয়েছি। যতদূর পর্যন্ত পার লেখাপড়া কর।এই সম্পদ কেউ কোনদিন তোমাদের থেকে ছিনতাই করে নিতে পারবে না। আমি আগামীর নাগরিকদেরকে সে সম্পদ অর্জনেই মনোযোগী হতে বলব।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৃহষ্পতিবার গোপালগঞ্জের টুঙ্গীপাড়ায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৯৭তম জন্মদিবস এবং জাতীয় শিশু দিবস-২০১৬ উদযাপন উপলক্ষে আয়োজিত শিশু সমাবেশ, আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে এ কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা আমাদেরকে স্বাধীন বাংলাদেশ দিয়েছেন। বাংলাদেশকে যেন আমরা উন্নত সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে পারি।
বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বাস্পরুদ্ধ কন্ঠে বলেন, ‘আজকে জাতির পিতা আমাদের মাঝে নেই, অল্প বয়সেইতো তাকে চলে যেতে হয়েছিল। আজ যখন আমি তাঁর ছবির দিকে তাকাই তখন ভাববার চেষ্টা করি আজকে তিনি বেঁচে থাকলে দেখতে কেমন হতেন? আমার মা,ছোট্ট রাসেল কেমন হত দেখতে? জানি এই প্রশ্নের উত্তর আমি কোনদিনও পাব না। তারপরেও আমার দায়িত্ব- কাজ করে যাওয়া। সে চেষ্টাই করে যাচ্ছি।’
তিনি বলেন,‘আর সে কাজের মধ্যে সবচেয়ে বড়ো কাজ হলো আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎকে উপযুক্ত করে গড়ে তোলা।’
জাতির পিতার সমাধি কমপ্লেক্সে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানের পূর্বে রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিসৌধে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করেন।
ছোট্ট শিশু রাবেয়াতুজ্জামানের সভাপতিত্বে এদিনের অনুষ্ঠানে শিশু জিসান স্বাগত বক্তৃতা করে। বিশেষ অতিথির বক্তৃতা করেন-মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ এবং মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব নাসিমা বেগম।
অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা,মন্ত্রী পরিষদ সদস্যবৃন্দ,সংসদ সদস্যবৃন্দ,সামরিক ও বেসামরিক পর্যায়ের উর্ধ্বতন কর্মকতৃাবৃন্দ,কূটনৈতিক মিশনের সদস্যবৃন্দ,আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতৃবৃন্দসহ বিভিন্ন বিদালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকা উপস্থিত ছিলেন। কোমলমতি শিশুগণও অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিল।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা শিশুদের খুব ভালবাসতেন। তাই তাঁর জন্মদিনকে শিশুদের জন্য উৎসর্গ করে আমরা জাতীয় শিশু দিবস পালন করছি।
শেখ হাসিনা বলেন, এই টুঙ্গীপাড়তেই দৌড়-ঝাঁপ করে, এই মধুমতি নদীতে ডুবসাঁতার কেটে বড়ো হয়েছেন বঙ্গবন্ধু। তিনি শিশু-কিশোর বয়স থেকেই মানুষের দু:খ কষ্ট,হাহাকার অনেক কাছ থেকে দেখেছেন। ব্যথায় তাঁর মন কেঁদে উঠতো, অনাহারী-অর্ধাহারী মানুষদের জন্য কিছু একটা করতে হবে-ছোট্ট বেলাতেই সেই সংকল্প নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাঙালি জাতির অধিকার আদায়ের আন্দোলন-সংগ্রাম করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে বার বার জেলে যেতে হয়েছে। এ জাতির জন্য একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে তিনি সামনে এগিয়ে গেছেন। আর এ লক্ষ্য তার মাঝে ছোটবেলা থেকেই দেখা গেছে। তিনি ছোটবেলা থেকেই অত্যন্ত বন্ধু বৎসল ও পরোপকারী ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, বঙ্গবন্ধু নিজের গায়ের চাদর পর্যন্ত অন্যদের দিয়ে দিতেন। বই দিয়ে দিতেন। যখন স্কুলে পড়তেন, তখনই তিনি মুষ্ঠি,মুষ্ঠি চাল সংগ্রহ করে, সমিতি করে দুস্থ শিক্ষার্থীদের সাহায্য করতেন। গরিবের প্রতি যে ভালোবাসা, মানুষের প্রতি যে ভালোবাসা, তা ছোটবেলা থেকেই ছিল বঙ্গবন্ধুর। আর এ ভালোবাসাই তাকে ধীরে ধীরে জাতির জনকে পরিণত করেছে ।
প্রধানমন্ত্রী স্মৃতি রোমন্থনে আরও বলেন, ‘আমার দাদী বলতেন, আমার খোকার জন্য বার বার ছাতা, বই, জুতা কিনতে হতো। কারণ, খোকা এসব দরিদ্র শিক্ষার্থীদের দিয়ে দিত। বাবা স্কুল থেকে ফেরার পথে অনেক ছাত্রকে নিয়ে আসতেন। এ কারণে বাবার জন্য বেশি করে খাবার রাখতেন দাদী। একবার দেশে দুর্ভিক্ষ হলে নিজের গোলার ধান নিয়ে গরিব মানুষের মধ্যে বিলিয়ে দিলেন বাবা।’
শেখ হাসিনা বলেন, বাবা অনেক ভাগ্যবান ছিলেন, কারণ তার বাবা-মা জনগণকে সাহায্য করার ব্যাপারে কোনো বাধা দিতেন না।
প্রধানমন্ত্রী শিশু-কিশোরদের উদ্দেশে বলেন, আমি চাই তোমরাও জাতির পিতার আদর্শকে ধারণ করে সবসময়ই দরিদ্র, অসহায় ও প্রতিবন্ধী শিশুদের পাশে দাঁড়াবে।
তিনি নিজের শৈশবের স্মৃতিচারণ করে বলেন, আর দশজন সাধারণ শিশুর মতো শৈশব তাদের ছিল না। অন্য শিশুদের মত বাবার হাত ধরে স্কুলে যাবার সৌভাগ্য হয়নি। বাঙালি জাতির অধিকার আদায়ে জাতির জনককে বারবার কারাবরণ করতে হয়েছে। ফলে বাবার সঙ্গে সাক্ষাৎ হতো জেল গেটে।
তিনি বলেন স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেও বহুবার বাবার সঙ্গে জেলগেটেই সাক্ষাৎ করতে হয়েছে।
শেখ হাসিনা তাঁর ছোট ভাই ও বঙ্গবন্ধুর বড়ছেলে শেখ কামালের সঙ্গে তাঁর একটি বেদনাক্লিষ্ট অতীত অভিজ্ঞতার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আবেগাপ্লুত কন্ঠে বলেন, ‘কামাল তখন অল্প অল্প কথা বলা শিখেছে। কিন্তু আব্বাকে ও কখনও দেখেনি, চেনেও না। আমরা জেলগেটে বাবার সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে যখন বার বার আব্বার কাছে ছুটে যাচ্ছি, আব্বা আব্বা বলে ডাকছি ও শুধু অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখতো। ও হঠাৎ আমাকে জিজ্ঞাসা করল-হাসু আপা তোমার আব্বাকে আমি একটু আব্বা বলি।’ আর রাসেল, ৬ দফা আন্দোলনের সময়তো বয়স ছিল মাত্র দুই বছর-বলেন প্রধানমন্ত্রী।
শেখ হাসিনা বলেন, আমি উত্তর খুঁজে পাই না, আমার ছোট্ট দশ বছরের ভাই রাসেল,তার বয়েসি ছোট্ট আরিফ,সুকান্ত বাবুকে কেন হত্যা করা হল? আমার মা,ভাই-ভাইয়ের স্ত্রী এমনকি নিরীহ পঙ্গু একমাত্র চাচাকে কেন হত্যাকান্ডের শিকার হতে হল? আমাদের পরিবারসহ আরও কয়েকটি পরিবারের ১৮জন সদস্যকে একসঙ্গে প্রাণ দিতে হল। আমি রেহানাকে নিয়ে দেশ ছাড়ার ১৫দিনের মাথায় একরাতে জানলাম,সব শেষ।
তিনি আরও বলেন, যে অশুভ শক্তি একাত্তরে পরাজিত হয়েছিল তারাই পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। শুধু জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করেই ঘাতক দল ক্ষান্ত হয়নি, জাতির পিতার অনুপস্থিতিতে যে জাতীয় চারনেতা মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন তাদেরকেও কারাগারের অভ্যন্তরে হত্যা করেছে। পঁচাত্তরের পরে জাতির গৌরবের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে তারা ভুলিয়ে দিতে উঠেপড়ে লাগে। আমাকে দীর্ঘদিন দেশে ফিরতে দেয়া হল না। ’৮১ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হবার পর দেশে ফিরি।
ষড়যন্ত্রকারীরা এখনও সক্রিয়- এ কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, তারা এখনও সক্রিয় থাকলেও আজকে অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার আমরা করেছি। তাদের রায় কার্যকর করেছি, দেশ কলঙ্কমুক্ত হয়েছে। একইসঙ্গে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হচ্ছে। দেশ ক্রমেই অভিশাপ মুক্ত হচ্ছে। একাত্তরের পরাজিত শক্তি এখনও ষড়যন্ত্র করছে। কিন্তু এ ষড়যন্ত্রে আর বাংলার মানুষের কোন ভাবান্তর হয় না। তাদের ষড়যন্ত্র আর কোন কাজে আসবে না।
প্রধানমন্ত্রী বলেন,‘জাতির পিতা চেয়েছিলেন, বাংলাদেশ একটি সমৃদ্ধশালী দেশ হবে, ক্ষুধামুক্ত দারিদ্র্যমুক্ত দেশ হবে। আমাদের কাজ হচ্ছে, বঙ্গবন্ধুর সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করা। আমরা সেই কাজই করে যাচ্ছি’।
প্রধানমন্ত্রী পুনরায় শিক্ষার প্রতি গুরুত্বারোপ করে বলেন, জাতির পিতা চেয়েছিলেন, এ দেশের প্রতিটি শিশু শিক্ষিত হবে। সেজন্য শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষাকে অবৈতনিক করেছিলেন। প্রত্যেক শিশুর মাঝে সুপ্ত প্রতিভা রয়েছে, তা বিকাশের সুযোগ আমরা করে দিচ্ছি।
প্রধানমন্ত্রী এ সময় শিশু-কিশোরদের মা-বাবার কথা শোনা, শিক্ষকদের কথা শোনা, বড়দের মান্য করার আহ্বান জানিয়ে তাদের বলেন,জীবনে শৃঙ্খলার বড়ো প্রয়োজন রয়েছে।
শেখ হাসিনা তাঁর ভাষণে বলেন, একবার বিদেশি সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্ট বঙ্গবন্ধুর কাছে জানতে চেয়েছিলেন, ‘হোয়াট ইজ ইউর কোয়ালিফিকেশন?’ উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি আমার জনগণকে অত্যন্ত ভালোবাসি’ (আই লাভ মাই পিপল)। আপনার দুর্বলতা কী জানতে চাইলে বাবা বলেছিলেন, ‘মানুষকে বেশি ভালোবাসাই আমার দুর্বলতা’ (আই লাভ দেম টু মাচ)।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জীবদ্দশায় জাতির পিতার প্রতিটি দিন, মাস আর প্রতিটি বছর পরাধীন বাঙ্গালী জাতির মুক্তি সংগ্রামের বাক পরিবর্তন ও অগ্রগতির ইতিহাসসমৃদ্ধ। একটি অসহায়, ঘুমন্ত, শোষিত, নিস্পেষিত জাতিকে তিনি মুক্তির মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছিলেন। বাঁচার অধিকার আদায়ের কৌশল শিখিয়েছিলেন। তিনিই দিয়ে গেলেন লাল-সবুজের পতাকা, একটি স্বাধীন দেশ ও পৃথিবীর মানচিত্রে সার্বভৌম ভূ-খন্ড। বাঙ্গালীর ইতিহাসে তিনিই মহানায়ক।
শিশু-কিশোররাই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত সোনার বাংলা গড়ার প্রধান শক্তি-এ কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী তাদেরকে জাতির পিতার আদর্শ নিয়ে এগিয়ে চলার আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, এ আদর্শ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে আমরা উন্নত সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ গড়ে তুলবো, বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবো।
অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী জাতীয় শিশু দিবস উপলক্ষে আয়োজিত সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণ করেন এবং বঙ্গবন্ধুর উপর নির্মিত একটি আলেখ্যানুষ্ঠানও উপভোগ করেন।
পরে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর ৯৭ তম জন্মদিন ও জাতীয় শিশু দিবস উপলক্ষে বইমেলার উদ্বোধন করেন এবং বিভিন্ন স্টল ঘুরে দেখেন।