রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ করুনঃ বিশ্বনেতাদের প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

1337

Published on নভেম্বর 5, 2017
  • Details Image

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোকে রোহিঙ্গা নাগরিকদের উপর নির্যাতন বন্ধ করতে এবং বলপ্রয়োগের মাধ্যমে বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমার সরকারের উপর চাপ প্রয়োগের আহবান জানিয়েছেন।

প্রধানমন্ত্রী কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর উদ্দেশ্যে বলেন, ‘মিয়ানমারকে তার নাগরিকদের উপর নির্যাতন বন্ধ করতে এবং বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে চাপ প্রয়োগ করুন।’

(পুরো ভাষণটি দেখুনঃ https://youtu.be/Ed_DR0FVsyM)

প্রধানমন্ত্রী এবং সিপিএ ভাইস পেট্রন শেখ হাসিনা রোববার সকালে জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় ৬৩ তম কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি কনফারেন্স’র (সিপিসি) উদ্বোধনকালে প্রধান অতিথির ভাষণে একথা বলেন।

শেখ হাসিনা বলেন, ‘মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে সাময়িকভাবে আমরা এই বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা নাগরিককে আশ্রয় দিয়েছি।’

তিনি বলেন, তাঁর সরকার ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’- এই নীতির ভিত্তিতে প্রতিবেশি দেশসমূহের সঙ্গে সব সময়ই সুসম্পর্ক জোরদার করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। এরফলে ভারতের সঙ্গে গঙ্গা নদীর পানি-চুক্তি এবং স্থল সীমানা চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে দীর্ঘদিনের বিরোধের শান্তিপূর্ণ নিষ্পত্তি সম্ভব হয়েছে। একইভাবে মিয়ানমার এবং ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারণ করাও সম্ভব হয়েছে।

শেখ হাসিনা বলেন, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উপর অমানবিক নির্যাতন এবং তাদের জোরপূর্বক বিতাড়িত করে দেওয়া শুধু এ অঞ্চলে নয়, এর বাইরেও অস্থিরতা তৈরি করছে।

সাম্প্রতিককালে মিয়ানমার সরকারের প্রতিহিংসার শিকার হয়ে সে দেশের ৬ লাখ ২২ হাজারেরও বেশি নাগরিক বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। ১৯৭৮ সাল থেকে বিভিন্ন সময়ে আরও প্রায় ৫ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠি সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে পালিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছে।

তিনি বলেন, ‘আপনাদের অনুরোধ জানাবো রোহিঙ্গা ইস্যুটি বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা করুন। মিয়ানমারকে তার নাগরিকদের উপর নির্যাতন বন্ধ করতে এবং বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে চাপ প্রয়োগ করুন।’

জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস নির্মূলে একযোগে কাজ করার জন্য প্রধানমন্ত্রী কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর প্রতি তাঁর সরকারের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, ‘কিছু মানুষের অপরিণামদর্শী কর্মকান্ডের ফলে নিরীহ মানুষের প্রাণ যাচ্ছে। জঙ্গিবাদ আজ আর কোন নির্দিষ্ট দেশের সমস্যা নয়, এটি বৈশ্বিক সমস্যায় পরিণত হয়েছে।’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘কয়েকদিন আগেই নিউইয়র্কের রাস্তায় ট্রাক উঠিয়ে ৮ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। আমাদের সকলকে ঐক্যদ্ধভাবে জঙ্গিবাদ সমস্যার মোকাবিলা করতে হবে।’

সিপিএ চেয়ারপার্সন এবং জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন।

সিপিএ মহাসচিব আকবর খান, কমনওয়েলথের যুব প্রতিনিধি আইমান সাদিক এবং সিপিএ কোষাধ্যক্ষ ভিকি ডানও অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন।

অনুষ্ঠানে কমনওয়েলথ’র প্রধান হিসেবে সিপিএ পেট্রন রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের বাণী পড়ে শোনান কমনওয়েলথ সচিবালয়ের মহাসচিব প্যাট্রিসিয়া স্কটল্যান্ড।

অনুষ্ঠানে শিল্পকলা একাডেমী এবং নৃত্যাঞ্চল শিল্পীগোষ্ঠীর সৌজন্যে বাংলাদেশের ইতিহাস ও কৃষ্টি, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, পরিবেশ এবং সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশকে তুলে ধরে বেশ কিছু বর্ণাঢ্য প্রামাণ্য চিত্র প্রদর্শন করা হয়।

জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব মোকাবিলার জন্য উন্নত দেশগুলোর পক্ষ থেকে যেসব সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে সেগুলোর দ্রুত বাস্তবায়ন প্রত্যাশা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবের ফলে আমরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছি। এ বছর অতিবৃষ্টিসহ কয়েক দফা বন্যার ফলে আমাদের বিশাল জনপদ ভেসে গেছে। ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে ফসলের। জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব মোকাবিলার জন্য যেসব সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, সেগুলোর দ্রুত বাস্তবায়ন প্রত্যাশা করছি।

প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে বলেন, এই ঐতিহাসিক নগরী ঢাকায় কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি এসোসিয়েশনের ৬৩তম সম্মেলনের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পেরে আমি অত্যন্ত আনন্দিত।

বাংলাদেশের জনগণ, সরকার এবং তাঁর নিজের পক্ষ থেকে সকল অতিথিকে স্বাগত জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, এ ধরণের আন্তর্জাতিক সম্মেলন গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও চর্চার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

তিনি বলেন, জনপ্রতিনিধি হিসেবে আমাদের প্রথম ও প্রধান নৈতিক দায়িত্ব হচ্ছে গণতন্ত্র এবং সংসদীয় গণতান্ত্রিক রীতিনীতি ও প্রতিষ্ঠানকে আরও শক্তিশালী করা এবং এসব রীতিনীতি ও প্রতিষ্ঠানের প্রতি জনগণের পূর্ণ আস্থা তৈরি করা।

সিপিএ এবং বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ যৌথভাবে ‘কনটিনিউয়িং টু এনহান্স দ্যা হাই স্ট্যান্ডার্ডস অব পারফরমেন্স অব পার্লামেন্টারিয়ানস’ এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে এই কনফারেন্সের আয়োজন করেছে।

এতে ৫২টি দেশের ১৪৪টি জাতীয় ও ৪৪টি প্রাদেশিক সংসদের স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার, সংসদ সদস্যসহ ৫৫০ এর অধিক প্রতিনিধি অংশ নিচ্ছেন।

শেখ হাসিনা বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিচক্ষণ ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ১৯৭৩ সালে সিপিএ-এর সদস্য হিসেবে অন্তর্ভূক্ত হয় বাংলাদেশ। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৪ সালে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী সিপিএ-এর নির্বাহী কমিটির চেয়ারপার্সন নির্বাচিত হন।

তিনি বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী কমনওয়েলথভূক্ত দেশগুলোর সংসদ সদস্যগণের প্রদত্ত এই স্বীকৃতি বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক চর্চা ও মূল্যবোধের স্বীকৃতির একটি প্রামাণিক দলিল।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা কায়েমের যে আকাক্সক্ষা এ ভূখণ্ডের জনগণ লালন করেছিলেন, বহু ত্যাগ তিতীক্ষার বিনিময়ে তা বাস্তবায়িত হয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অগ্রভাগে থেকে এই সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এজন্য তাঁকে পাকিস্তান শাসনামলের ২৪ বছরের মধ্যে প্রায় অর্ধেকটা সময় কারাগারে অন্তরীণ থাকতে হয়েছে।

তিনি বলেন, যুদ্ধ বিধস্ত বাংলাদেশকে পুনর্গঠনের কাজে যখন বঙ্গবন্ধু নিমগ্ন ছিলেন, ঠিক তখনই পরাজিত শক্তির দোসররা ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে।

শেখ হাসিনা বলেন, তিনি এবং তাঁর ছোটবোন শেখ রেহানা বিদেশে অবস্থান করায় প্রাণে বেঁচে যান। তাদের দেশে ফিরে আসার পথ রুদ্ধ করা হয়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার সঙ্গে সঙ্গে হত্যা করা হয় গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা। শুরু হয় সামরিক স্বৈরশাসনের যুগ।

প্রবাসে থাকাবস্থাতেই তিনি গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে লিপ্ত হন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ৬ বছর নির্বাসিত জীবন কাটিয়ে ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে আসি। জনগণের শাসন ফিরিয়ে আনার সংগ্রামে আমাকেও কম নির্যাতন সহ্য করতে হয়নি। গৃহবন্দী, জেলখানায় আটক থেকে শুরু করে জীবননাশের প্রচেষ্টা করা হয়ে বার বার।

গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে তাঁর দলের হাজার হাজার নেতাকর্মী নির্যাতনের শিকার হওয়া সত্বেও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম থেকে বিচ্যুত হননি উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, আমরা মনে করি একমাত্র গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থাই মানুষের মৌলিক অধিকারসমূহ ভালোভাবে পূরণ করে উন্নত জীবন নিশ্চিত করতে পারে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, দীর্ঘ ২১ বছর পর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পায়। আমরা শাসক নই, জনগণের সেবক হিসেবে সাধারণ মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণে আত্মনিয়োগ করি।

তিনি বলেন, মাঝখানে ৮ বছর বিরতির পর আমার দল আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে আবারও রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পায়।

শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের মূল লক্ষ্য গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার ভিত শক্তিশালী করার মাধ্যমে ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলা। সে লক্ষ্যে আমরা রূপকল্প-২০২১ প্রণয়ন করি। সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার ভিত্তিতে আমরা আমাদের কর্মসূচিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।

বাংলাদেশে তাঁর সরকার একটি দারিদ্র্য ও ক্ষুধামুক্ত, অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক সমাজ গড়ে তোলার জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতীয় সংসদ, বিভিন্ন স্তরের স্থানীয় সরকারসহ আমরা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করেছি। ইউনিয়ন পর্যায় থেকে শুরু করে উপজেলা, পৌরসভা, সিটি কর্পোরেশন ও জেলা পরিষদে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিগণ দায়িত্ব পালন করছেন। নারীর ক্ষমতায়ন ও লিঙ্গ বৈষম্য নিরসনে আমাদের অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষে।

শেখ হাসিনা বলেন, গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার অতন্দ্র প্রহরী স্বাধীন এবং শক্তিশালী গণমাধ্যম। বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশের গণমাধ্যম ব্যাপকভাবে বিকশিত হয়েছে। নিশ্চিত করা হয়েছে তাদের অবাধ স্বাধীনতা। মানুষের তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে।

এমডিজি বাস্তবায়নের সাফল্যের ধারাবাহিকতায় আমরা এসডিজি বাস্তবায়ন করছি উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের চলমান সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় এসডিজি’র বিষয়সমূহ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

তিনি বলেন, বাংলাদেশ শান্তি, গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথ ধরে এগিয়ে চলেছে। ইতোমধ্যে আমরা নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদা লাভ করেছি। আমাদের প্রত্যাশা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ২০২১ সালে বাংলাদেশ ‘‘মধ্যম আয়ের দেশ’’ এবং ২০৪১ সালে ‘উন্নত সমৃদ্ধ দেশ’ হিসেবে বিশ^ মানচিত্র মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে।

তিনি কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর প্রতি পৃথিবীকে বিশ্ববাসীর জন্য সুখময়, শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ বাসভূমিতে পরিণত করার উদাত্ত আহবান জানান এবং বাংলাদেশে আগত অতিথিদের অবস্থান আনন্দময় এবং এ সম্মেলনের সাফল্য কামনা করেন।

ছবিঃ সাইফুল ইসলাম কল্লোল

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত