স্বাধীনতার প্রেক্ষাপট ও ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যাঃ ফজলুল হক খান

5439

Published on মার্চ 24, 2019
  • Details Image

বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম ও স্বাধীনতাযুদ্ধ হঠাৎ ঘটে যাওয়া কোন বিষয় নয়। ভারতবর্ষে উনিশ শতকে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে জনগণের যে মুক্তির আকাক্সক্ষা গড়ে উঠেছিল তাতে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাংলার সূর্যসেন, ক্ষুদিরাম, প্রীতিলতা, শান্তি, সুনীতি, বাঘা যতীন, বিনয়, বাদল, দীনেশসহ অসংখ্য বিপ্লবীরা অকাতরে জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন। সমগ্র ভারতবর্ষ জেগে উঠেছিল এবং স্বাধীনতা সংগ্রাম ছড়িয়ে পড়েছিল বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো। ইংরেজরা বিদায় নিল। ভারতবর্ষ দি¦খ-িত হলো দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে। ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদীদের ইন্ধনে ভারতবর্ষে যে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিল তার ভিত্তিতে মুসলমানদের জন্য আলাদা রাষ্ট্রের স্লোগান তুলে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর নেতৃত্বে আদমজী, বাওয়ানী, ইস্পাহানির মতো মুসলিম পুঁজিপতিরা পাকিস্তান আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। ফলে স্বতন্ত্র বাঙালী জাতীয়তাবাদী আন্দোলন মার খায় দ্বিজাতি তত্ত্বের কাছে। অবিভক্ত ভারতে কেন্দ্রীয় কংগ্রেসের অবাঙ্গালী হাইকমান্ডের কাছ থেকে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস এবং নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু যেমন ব্যবহার পেয়েছেন তৎকালীন মুসলিম লীগের অবাঙালী হাইকমান্ডের কাছ থেকেও শেরে বাংলা ও সোহরাওয়ার্দী অনুরূপ ব্যবহারই পেয়েছেন। এর কারণ অবিভক্ত ভারতে আর্থিক খুঁটির জোর ছিল অবাঙালী ব্যবসায়ীদের। কংগ্রেসের টাকা যোগাতেন টাটা, বিড়ালা, ডালমিয়া প্রমুখ। মুসলিম লীগের টাকা যোগাতেন ইস্পাহানি আদমজী, আহম্মদ ভাই পাগড়িওয়ালা প্রমুখ। কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগ নেতাদের মধ্যে যতই রাজনৈতিক মতো পার্থক্য থাক না কেন অবাঙালী রাজনৈতিক নেতারা এবং অবাঙালী বিজনেসম্যানরা একটি বিষয়ে একমত ছিলেন যে কোন অবস্থাতেই তৃতীয় ধারার রাজনীতির কোন সুযোগ দেয়া যাবে না, বাঙালীদের মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে দেয়া যাবে না। কারণ বাঙালীদের ছিল হাজার বছরের জাতিগত ঐতিহ্য, স্বতন্ত্র রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয়। তারা সুযোগ পেলে অবাঙালী রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং বিগ বিজনেসম্যানদের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। তাই স্বাধীন সেক্যুলার বাংলাদেশ এবং সেক্যুলার বাঙালী জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে দিল্লী ও ইসলামাবাদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল অভিন্ন। ১৯৪৭ সালে এই উপমহাদেশে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটো স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হলো। ভারতের মুসলিম পুঁজিপতিরা পাড়ি জমালো পশ্চিম পাকিস্তানে। ধর্মের নামে ধোঁকা দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানকে করা হলো পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশ। পশ্চিম পাকিস্তানের পুঁজিপতিরা পূর্ব পাকিস্তানকে সস্তা শ্রম ও পণ্যের বাজারে পরিণত করে এখান থেকে পুঁজি পাচার করে নিয়ে যেত। যদিও সমগ্র পাকিস্তানে আমরাই ছিলাম সংখ্যাগরিষ্ঠ।

পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী শোষণের পাশাপাশি উপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থা বজায় রাখার দুরভিসন্ধি থেকে বাঙালী সংস্কৃতি ও কৃষ্টিকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে আমাদের মুখের ভাষা কেড়ে নিতে চেয়েছিল, চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে। পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর এই দুরভিসন্ধি বাঙালীরা মেনে নিতে পারেনি। প্রতিবাদে ‘৫২-এর ভাষা আন্দোলনের ভেতর দিয়ে বাঙালী জাতীয়তাবাদের চেতনার প্রথম উন্মেষ ঘটে এবং তার জোরালো বহির্প্রকাশ ঘটে ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে। ’৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে বাঙালী জাতির গণরায়ের কাছে নতি স্বীকার করে পূর্ব পাকিস্তানে শেরে বাংলা একে, ফজলুল হক ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অখ- বাংলা বাঙালী জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে আবেগপূর্ণ মন্তব্য করলে পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানের জনপ্রিয় মন্ত্রিসভা বাতিল করে মুখ্যমন্ত্রীকে গৃহবন্দী করে এবং শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে কারাগারে নিক্ষেপ করে। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারির মাধ্যমে এদেশের মানুষের গণতান্ত্রিক ও মৌলিক অধিকার করে। ১৯৬২ সালে গড়ে উঠে ব্যাপক আইয়ুববিরোধী ছাত্র আন্দোলন। সে সময়ও আইয়ুব শাহী সরকার কর্তৃক জননিরাপত্তা অডিন্যান্স বলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে গ্রেফতার করা হয় এবং বিনা বিচারে ছয় মাস আটক রাখা হয়। ১৯৬৪ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে সম্মিলিত বিরোধীদলীয় প্রার্থী মোহতারেমা ফাতেমা জিন্নাহর পক্ষে বঙ্গবন্ধু নির্বাচন অভিযান শুরু করলে সরকার কর্তৃক বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয় এবং তাঁকে লাঞ্ছিত করা হয়। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধ মূলত: পাকিস্তানের পশ্চিম ফ্রন্টে সংঘটিত হলেও পূর্ব পাকিস্তান ছিল সম্পূর্ণ অরক্ষিত এবং দেশের পশ্চিমাঞ্চলসহ সারাবিশ্ব হতে ছিল সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। যুদ্ধকালীন অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বায়ত্তশাসন এবং এ প্রদেশকে সামরিক প্রতিরক্ষার ব্যাপারে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তোলার জন্য বঙ্গবন্ধু প্রেসিডেন্টের কাছে আবেদন জানান।

১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু জাতির সামনে হাজির করলেন বাঙালী জাতির মুক্তির সনদ, ঐতিহাসিক ছয়দফা। কেঁপে উঠল পাকিস্তানী স্বৈরাশাসকের ভিত। ১৯৬৬ সালের মে মাসে বঙ্গবন্ধুকে প্রতিরক্ষা আইনে গ্রেফতার করা হয় এবং দীর্ঘ একুশ মাস কারাবাসের পর তথাকথিত মুক্তিলাভের সঙ্গে সঙ্গে কেন্দ্রীয় কারাগারের ফটক হতে কতিপয় সামরিক ব্যক্তি দৈহিক বলপ্রয়োগ করে বঙ্গবন্ধুকে ঢাকা সেনানিবাসে নিয়ে যায় এবং দীর্ঘ পাঁচ মাস একটি রুদ্ধদ্বার কক্ষে আটকিয়ে রাখে। নির্জন সেলে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কাউকে সাক্ষাত করতে দেয়া হয়নি এবং সকল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় তাঁর উপর অমানবিক নির্যাতন চালানোর পর তাঁর বিরুদ্ধে ভারতের যোগসাজশে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন করার চক্রান্তের অভিযোগ আনা হয়। যা পরবর্তীতে তথাকথিত ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ নামে পরিচিত। সামরিক আদালতে এ মামলার বিচারকার্য চলাকালে ঐতিহাসিক ছয়দফা, ছাত্রদের এগার দফা ও আগরতলা মিথ্যা মামলায় গ্রেফতারকৃত বঙ্গবন্ধুসহ সকল রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মুক্তির দাবিতে পূর্ববাংলায় প্রবল গণআন্দোলন গড়ে উঠে। ফলে সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে বঙ্গবন্ধুসহ সকল রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।

’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে আইয়ুব শাহীর পতনের পর আরেক সামরিকজান্তা ইয়াহিয়া খান ক্ষমতায় এসে ১৯৭০ সালে পাকিস্তানে অবাধ সাধারণ নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দানের মাধ্যমে পূর্ববাংলার বিস্ফোরণোম্মুখ পরিস্থিতিকে আয়ত্তে আনেন। ১৯৭০ সালের ৩০ মার্চ ইয়াহিয়া খান লিগ্যাল ফ্রেম ওয়ার্ক অর্ডার (এলএফও) নামক একটি আদেশ জারি করেন। এটা ছিল মূলত: পাকিস্তানের শাসনতন্ত্রের খসড়া চিত্র। এই আদেশ বলে ইয়াহিয়া খান ঐতিহাসিক ছয় দফা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর হাত অনেকটা বেঁধে ফেলেন। কিন্তু ঐতিহাসিক ছয় দফা বাস্তবায়ন এবং স্বাধিকার আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু ছিলেন আপোসহীন। এমতাবস্থায় বঙ্গবন্ধু অপেক্ষা করছিলেন একটি অবাধ নির্বাচন এবং জনগণের ম্যান্ডেটের জন্য। জনগণের ম্যান্ডেট পাওয়ার পর এলএফও এর ভাগ্য নির্ধারিত হবে বঙ্গবন্ধুর হাতে। বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা ছিল, ‘আমার লক্ষ্য হচ্ছে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা। নির্বাচন শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি এলএফও টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলব। নির্বাচন শেষ হওয়ার পর আমাকে চ্যালেঞ্জ করবে কে? (জিডব্লিউ চৌধুরী, লাস্ট ডেজ অব ইউনাইটেড পাকিস্তান)।

ঐতিহাসিক ছয় দফা থেকে স্বাধিকার, স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার যে স্বপ্ন বঙ্গবন্ধু অন্তরে লালন করতেন তা বাস্তবায়নের জন্য দেশের সর্বস্তরের জনগণকে সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে দীর্ঘ ২২ বছর নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন। বঙ্গবন্ধুর সে স্বপ্ন, সে সাধনা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন ছিল একটি গণরায়। আর ঐতিহাসিক ছয় দফার পক্ষে গণরায় লাভের আশায় অবিচল স্থিরচিত্তে বঙ্গবন্ধু এগিয়ে গেলেন ’৭০-এর নির্বাচনের দিকে। নির্বাচন হলো, পূর্ব বাংলার জনগণ অত্যন্ত স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঐতিহাসিক ছয় দফার পক্ষে তাদের রায় দিলেন। সমগ্র পূর্ব বাংলায় ১৬২ জন জনপ্রতিনিধির মধ্যে ১৬০ জনই আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত হলো। তার সঙ্গে যুক্ত হলো পূর্ব পাকিস্তানের জন্য সংরক্ষিত আরও সাতটি মহিলা আসন। সুতরাং জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগের মোট আসন সংখ্যা দাঁড়াল ১৬৭ যা সমগ্র পাকিস্তানের সরকার গঠনে যথেষ্ট। নির্বাচনের এ অবিস্মরণীয় ফলাফল হতভম্ব করে দেয় সামরিকজান্তা ইয়াহিয়া খানকে, আতঙ্কিত হয়ে উঠে সামরিক প্রশাসনসহ তাদের দোসর পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো। শুরু হলো ক্ষমতা হস্তান্তর না করার ষড়যন্ত্র। বাঙালীদের মাঝে বিভ্রান্তি সৃষ্টির জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ এক ঘোষণায় ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেন। অথচ তার দুদিন আগে অর্থাৎ ১১ ফেব্রুয়ারি এক গোপন বৈঠকে পূর্ব বাংলায় সামরিক হামলার সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়। ১৯৭১ এর ১১ ফেব্রুয়ারি রাওয়ালপিন্ডির সেনাবাহিনীর সদর দফতরে জেনারেল হামিদ, লে. জে. পীরজাদা, লে. জে. গুল হাসান, লে. জে. টিক্কা খান, মেজর জেনারেল ওমর, মেজর জেনারেল আকবর ও পাকিস্তান গোয়েন্দা সংস্থার উপ-প্রধান এসএ সউদের উপস্থিতিতে সামরিক হামলার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক আইন প্রশাসক এবং পাকিস্তান পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক কমান্ড প্রধান লে. জে. সাহেবজাদা ইয়াকুব খান পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যাকে রাজনৈতিকভাবে সমাধানের পক্ষে ছিলেন বিধায় সেদিনের বৈঠকে তাকে সরিয়ে বেলুচিস্তানের কসাই বলে পরিচিত লে. জে. টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গবর্নর ও সামরিক আইন প্রশাসক হিসাবে নিয়োগ দানের সিদ্ধান্তও গৃহীত হয়। সামরিক ষড়যন্ত্রের অংশ হিসাবে ১ মার্চ ১৯৭১ দুপুরে রেডিও পাকিস্তানের বিশেষ অনুষ্ঠানে পঠিত এক বিবৃতিতে ৩ মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় সংসদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করা হয়। এ ঘোষণা প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিক্ষোভ প্রতিবাদে ফেটে পড়ে বাংলার মানুষ। ঢাকা শহর পরিণত হয় মিছিলের শহরে। ছাত্র-শিক্ষক, শ্রমিক, চাকরিজীবী, আইনজীবী, বুদ্ধিজীবীসহ সর্বস্তরের মানুষ নেমে আসে রাস্তায়। ঐতিহাসিক ছয় দফা ও ছাত্রদের এগার দফা পরিণত হয় এক দফায়, ‘বীর বাঙালী অস্ত্র ধর বাংলাদেশ স্বাধীন কর।’ সেদিন থেকেই শুরু হলো ’৭১-এর মার্চের অগ্নিঝরা দিনগুলোর রোজনামচা। সারা মার্চ মাস চললো রাজনৈতিক কর্মসূচী, অসহযোগ আন্দোলন, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর গুলিবর্ষণ। ৩ এবং ৪ মার্চ ঢাকায় অন্তত ২৩ জন নিহত ও ৩০০ জনেরও বেশি আহত এবং চট্টগ্রামে ১২১ জন নিহত ও অসংখ্য মানুষ আহত হয়। ৪ মার্চ বঙ্গবন্ধু যে সরকারী ও বেসরকারী অফিসে বেতন দেয়া হয়নি পরবর্তী দুদিন সেসব অফিসে বেতন দেয়ার জন্য দুই ঘণ্টা করে খোলা রাখার নির্দেশ দেন। স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানসহ সকল ব্যাংক ৫ ও ৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে দুই ঘণ্টা খোলা রাখা হয়। এভাবেই অসহযোগ আন্দোলনের দিনগুলোতে সমগ্র পূর্ব বাংলার প্রশাসন, সচিবালয়, ব্যাংক, বীমা, অফিস আদালত, সকল কলেজ, সকল ক্ষেত্রেই বঙ্গবন্ধু নিয়ন্ত্রণ ভার গ্রহণ করতে থাকেন।

পরিস্থিতি সামরিকজান্তার বাইরে চলে যেতে থাকলে ৬ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এক বেতার ভাষণে ঘোষণা দেন যে, জাতীয় পরিষদ এখন ২৫ মার্চ অধিবেশনে মিলিত হবে। ভুট্টো সাহেবও ঘোষণা দিলেন তার দল এ অধিবেশনে যোগদান করবে। আসলে এ সবই ছিল কালক্ষেপণ এবং গোপনে সামরিক প্রস্তুতি গ্রহণ। তার প্রমাণ সেদিনই কুখ্যাত লে. জে. টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গবর্নর হিসাবে নিয়োগের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়। পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ ১৯৭১ রেসকোর্স ময়দানে তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদানের বিষয়ে ৪টি শর্ত আরোপ করেন। ১. মার্শাল ‘ল’ তুলে নিতে হবে, ২. জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে, ৩. সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিতে হবে এবং ৪. বাঙালীদের হত্যার কারণ খুঁজে বের করার জন্য বিচার বিভাগীয় তদন্ত করতে হবে। পাশাপাশি সামরিক জান্তার সম্ভাব্য হামলার মোকাবেলার জন্য বাঙালী জাতিকে যার যা আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দিলেন।

৮ মার্চ থেকে সারা বাংলায় অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয় এবং বঙ্গবন্ধু কর্তৃক জারিকৃত নির্দেশনামা অক্ষরে অক্ষরে পালিত হয়। মূলত: অসহযোগ আন্দোলনের শুরু থেকেই সারা বাংলায় শাসনযন্ত্র পরিচালিত হতে থাকে ধানম-ির ৩২ নম্বর থেকে। একমাত্র গবর্নর হাউস এবং ক্যান্টনমেন্ট ব্যতীত সেদিন পূর্ব বাংলার কোথাও পাকিস্তানের অস্তিত্ব ছিল না। অবস্থা বেগতিক দেখে সমঝোতার নামে ইয়াহিয়া খান ১৫ মার্চ ঢাকা আসেন। সঙ্গে নিয়ে আসেন জেনারেল হামিদ, লে. জে. গুলহাসান, লে. জে. পীরজাদা, মেজর জেনারেল ওমর, মেজর জেনারেল আকবর এবং পাকিস্তান গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান এন এ রিজভী। এছাড়া বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের জন্য নিয়ে এলেন কমান্ডো বাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল টিক্কা খানকে।

১৬ মার্চ বেলা এগারোটায় বঙ্গবন্ধু ও ইয়াহিয়া খানের মধ্যে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকটি ছিল মূলত: বাংলার মানুষকে বিভ্রান্ত করা এবং কালক্ষেপণ করা। বৈঠকের অন্তরালে ইয়াহিয়া খান সামরিক অভিযান চালানোর প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু ইয়াহিয়া খানের এ চক্রান্ত বাধ সাধলেন চট্টগ্রাম বন্দরের শ্রমিকরা। তারা চীন থেকে আনা অস্ত্র ও গোলাবারুদ জাহাজ থেকে খালাস করতে অস্বীকৃতি জানায়। ১৯ মার্চ সেনাবাহিনী জয়দেবপুরে বেসামরিক লোকদের উপর গুলিবর্ষণ করলে অন্তত ২০ জন নিহত হয়। ১৯ মার্চ সন্ধ্যায় ঢাকায় সান্ধ্য আইন জারি করলে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটে। ২১ মার্চ ভুট্টো ঢাকায় এলে বিক্ষুদ্ধ জনতা বিমানবন্দর ও হোটেলের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। ২২ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ২৫ মার্চ অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় সংসদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন। নতুন করে বিক্ষোভ শুরু হলো, জয়বাংলা ধ্বনিতে প্রকম্পিত হলো নগরীর রাজপথ। স্বাধীনতাকামী মানুষ এবার প্রতিরোধে রাস্তায় নেমে এলো। ২৩ মার্চ সারা বাংলায় পাকিস্তান দিবসের পরিবর্তে প্রতিরোধ দিবস পালিত হলো, উত্তোলন করা হলো বাংলাদেশের পতাকা। ছাত্রলীগ ঢাকার পল্টন ময়দানে আনুষ্ঠানিক কুচকাওয়াজের মাধ্যমে ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’ জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে বাংলাদেশের পতাকা আনুষ্ঠানিকভাবে উত্তোলন করে। সেদিন প্রায় সব বিদেশী দূতাবাসেও বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়।

২৪ মার্চ, বঙ্গবন্ধু ও ইয়াহিয়ার মধ্যে সর্বশেষ বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়। পাকিস্তান প্ল্যানিং কমিশনের চেয়ারম্যান এমএস আহমদ, সামরিক জান্তার মুখ্য আলোচক, খসড়া ঘোষণাপত্রের সংশোধনী অনুমোদন করিয়ে নেন এবং এ ঘোষনাপত্রটি লে. জে. পীরজাদার সঙ্গে বৈঠকের পর চূড়ান্ত হওয়ার কথা। পরবর্তী বৈঠকের দিন, তারিখ ও সময় জানানোর কথা ছিল লে. জে. পীরজাদার। কিন্তু সে সময় আর আসেনি। ২৫ মার্চ সকালে এমএম আহমদ বিনা নোটিসে করাচীর উদ্দেশে রওনা হন। সেদিন সকাল থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ পিআইএর বিমান ধরার জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েন এবং বিকেল ৫টা নাগাদ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানও গোপনে ঢাকা ত্যাগ করেন।

২৫ মার্চ সকাল এগারোটায় টিক্কা খানের কাছ থেকে নির্দেশ গেল ঢাকা সেনানিবাসের জিওসি লে. জে. খাদেম হোসেন রাজার কাছে। ২৬ মার্চ রাত ১টায় হামলা পরিচালনার জন্য। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের দেড় ঘণ্টা আগেই অর্থাৎ ২৫ মার্চ রাত সাড়ে এগারোটায় খাদেম হোসেন রাজা খুলে দিলেন ঢাকা সেনানিবাসের গেট। ট্যাংক, কামান, মেশিনগানসহ অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে বেরিয়ে এলো পাকহানাদার বাহিনী। ঝাঁপিয়ে পড়ল নিরস্ত্র বাঙালীর ওপর। নির্বিচারে হত্যা শুরু করল ছাত্র-শিক্ষক, শ্রমিক, নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ-যুবাসহ সর্বস্তরের মানুষকে। সেদিন রাতে সাত হাজার মানুষকে হত্যা করা হলো, গ্রেফতার করা হলো আরও তিন হাজার মানুষকে। দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকল ঢাকা শহর। লুট হলো ঘরবাড়ি, দোকানপাট। রাস্তায় রাস্তায় পড়ে থাকা মৃতদেহগুলো শিয়াল-শকুনের খাবারে পরিণত হলো। সমস্ত ঢাকা শহর হয়ে উঠল শকুন তাড়িত শ্মশানভূমি।

 

সৌজন্যেঃ জনকণ্ঠ ... 

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত