স্যাটেলাইট যুগে বাংলাদেশঃ রুশো তাহের

10515

Published on এপ্রিল 22, 2018
  • Details Image

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বপ্নদর্শী নেতৃত্বে সমুদ্রজয়ের পর এবার মহাকাশ জয়- অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ। মহাকাশে স্থাপন করতে যাচ্ছে কৃত্রিম উপগ্রহ 'বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১'। এটি একটি জিও-স্টেশনারি স্যাটেলাইট বা ভূস্থির উপগ্রহ। এর মাধ্যমে বিশ্বের ৫৭তম স্যাটেলাইট ক্ষমতাধর দেশের তালিকায় যুক্ত হবে বাংলাদেশ। প্রাকৃতিক কোনো বিপর্যয় না ঘটলে ৪ মে, ২০১৮ 'বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১' মহাকাশে উৎক্ষেপণ করা হবে। ওইদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকায় ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে 'বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১' মহাকাশে উৎক্ষেপণ উদ্বোধন করবেন।

১৯৭৫ সালের ১৪ জুন বেতবুনিয়ায় দেশের প্রথম ভূউপগ্রহ কেন্দ্র উদ্বোধনের মাধ্যমে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের মহাকাশজয়ের সূচনা করে গেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যাকাণ্ডের পর ওই যাত্রা থেমে যায়। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে দীর্ঘ ৪২ বছর পর লাল-সবুজের পতাকা নিয়ে কক্ষপথে স্থাপিত হতে যাচ্ছে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১। যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা স্পেসএক্সের 'ফ্যালকন-৯' রকেট স্যাটেলাইটটি ফ্লোরিডার কেপ কার্নিভাল থেকে মহাকাশে উৎক্ষেপণ করবে। এটি নির্মাণ করেছে ফ্রান্সের থ্যালেস অ্যালেনিয়া স্পেস। উল্লেখ্য, ১৯৯৭ সালে মহাকাশে স্যাটেলাইট স্থাপনের কাজ শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার নিয়েছিল। বিষয়টি তৎকালীন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রীর দৃষ্টিতে নেওয়া হলে তিনি এতে খুব আগ্রহী হয়ে ওঠেন। স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণে চলতে থাকে ওই মন্ত্রণালয়ের জোর তৎপরতা। স্পারসোর তৎকালীন চেয়ারম্যানকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয় সে প্রচেষ্টায়। তখন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের একটি উন্নয়ন প্রকল্প হিসেবে 'বাংলাদেশের ভূস্থির উপগ্রহ প্রেরণের প্রকল্প' গৃহীত হয় আর পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় কর্তৃক বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে এ প্রকল্প খাতে অর্থ বরাদ্দও রাখা হয়। পুরো বিষয়টি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সার্বিক তত্ত্বাবধানেই এগোচ্ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় এসে 'বঙ্গবন্ধু' নাম থাকার কারণে মহাকাশে স্যাটেলাইট স্থাপনের প্রকল্পটি বাতিল করে দেয়। সাবমেরিন অপটিক্যাল ফাইবার কেবল স্থাপনের প্রস্তাব নাকচের মতোই মারাত্মক ওই পশ্চাৎমুখী ওই সিদ্ধান্তের মূল হোতা ছিলেন তৎকালীন মন্ত্রী ড. মঈন খান। ওই পশ্চাৎমুখিন সিদ্ধান্তের জন্যই বাংলাদেশ মহাকাশে অরবিটাল প্লট হারিয়েছে। তাই 'বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১' মহাকাশে উৎক্ষেপণের জন্য বাংলাদেশকে রাশিয়ার উপগ্রহ কোম্পানি ইন্টারস্পুটনিকের কাছ থেকে ২১৯ কোটি টাকায় ১৫ বছরের জন্য কক্ষপথ বা অরবিটাল প্লট ক্রয় করতে হয়েছে। 

মহাকাশে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের প্রক্রিয়া দেশের বাইরে সম্পন্ন হলেও এটি নিয়ন্ত্রণ করা হবে বাংলাদেশ থেকেই। আর এ জন্য গাজীপুরের জয়দেবপুর ও রাঙামাটির বেতবুনিয়ায় দুটি গ্রাউন্ড স্টেশন নির্মাণের কাজ শেষ পর্যায়ে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটে ৪০টি ট্রান্সপন্ডার থাকবে, যার ২০টি বাংলাদেশ ব্যবহার করবে। বাকি ২০টি অন্যান্য দেশকে ভাড়া দেওয়া হবে। দেশের ৩৭টি স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলের কাছে ফ্রিকোয়েন্সি বিক্রির মাধ্যমে বছরে প্রায় ১২৫ কোটি ডলার আয় হবে। এসব চ্যানেল এখন বিদেশের বিভিন্ন স্যাটেলাইট থেকে ফ্রিকোয়েন্সি কিনে অনুষ্ঠান প্রচার করছে। এতে অনেক বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে। তাছাড়া উচ্চগতির ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথ, দেশের দুর্গম দ্বীপ, নদী ও হাওর এবং পাহাড়ি অঞ্চলে স্যাটেলাইট প্রযুক্তিতে নিরবচ্ছিন্ন টেলিযোগাযোগ সেবা চালুও সম্ভব হবে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ স্থাপনের মাধ্যমে। মোদ্দাকথা, 'বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১' মহাকাশে স্থাপনের মধ্য দিয়ে উন্নত-সমৃদ্ধ-প্রযুক্তিনির্ভর ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণ ত্বরান্বিত ও টেকসই হবে বৈকি।

জিও-স্টেশনারি স্যাটেলাইট বা ভূস্থির উপগ্রহের বিষয়টা বেশ চমৎকার। এর গতিপথ এমন যে, প্রত্যেকটি উপগ্রহ ভূপৃষ্ঠের পরিপ্রেক্ষিতে স্থির; একেকটি ভূস্থির উপগ্রহের আপাত অবস্থান একেক নির্দিষ্ট স্থানের ঠিক ওপরে, ভূপৃষ্ঠ থেকে ৩৫,৭৯৪ কিলোমিটার উচ্চতায়। আপাতদৃষ্টিতে ব্যাপারটা খুবই অদ্ভুত বটে। শূন্যে এমন উঁচুতে কোনো বস্তুরই তো স্থির দাঁড়িয়ে থাকার কথা নয়। বরং মাধ্যাকর্ষণের প্রভাবে সেটির ধরাপৃষ্ঠে পতিত হওয়াই স্বাভাবিক। এ আশ্চর্য আপাত স্থির অবস্থানের কারণ হলো ভূস্থির উপগ্রহের কক্ষপথটি হচ্ছে ক্লার্কের কক্ষপথ। স্যার আর্থার সি ক্লার্কের নামানুসারে এর নামকরণ।

যে কোনো সুস্থিত গতিপথে আবর্তক গতির জন্য শর্ত হলো কেন্দ্রমুখী বল ও কেন্দ্রাতিগ বলের সাম্য। পৃথিবীকে বৃত্তপথে প্রদক্ষিণরত যে কোনো উপগ্রহের ক্ষেত্রে কেন্দ্রমুখী বলনির্ভর করবে ভূকেন্দ্র থেকে ওই উপগ্রহের দূরত্ব ও ভরের ওপর আর কেন্দ্রাতিগ বল নির্ভর করবে উপগ্রহটির কৌণিক বেগ (মানে, কত দ্রুত সেটি পাক খাচ্ছে) ও ভরের ওপর। অতএব, পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে ভিন্ন ভিন্ন দূরত্ব বজায় রেখে প্রদক্ষিণরত উপগ্রহগুলোর কৌণিক বেগ ভিন্ন ভিন্ন হবে এবং সে জন্য আবর্তনকালও ভিন্ন ভিন্ন হবে। যেহেতু পৃথিবীর নিকটতর বস্তুর ওপর পৃথিবীর আকর্ষণ দূরবর্তী বস্তুর ওপর প্রযুক্ত আকর্ষণ থেকে বেশি, তাই স্থির দূরত্বে থেকে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণরত পৃথিবীর নিকটতর উপগ্রহের কৌণিক বেগ দূরবর্তী উপগ্রহের কৌণিক বেগ থেকে বেশি হতে হবে। একটি বিশেষ দূরত্বে থেকে কোনো উপগ্রহ পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করলে এর আবর্তনকাল হবে পৃথিবী তার নিজের অক্ষে ঘূর্ণনকালের সমান অর্থাৎ ২৪ ঘণ্টা। সে দূরত্ব ভূকেন্দ্র থেকে ৪২,১৬৫ কিলোমিটার। এখন এমন দূরত্বের কক্ষপথটি যদি ঠিক বিষুবরেখার বরাবর ঊর্ধ্বে হয় এবং যদি সে কক্ষপথে পরিভ্রমণরত উপগ্রহটির গতি পশ্চিম থেকে পূর্বদিকে হয়, তবে উপগ্রহটি বিষুবরেখার যে স্থানের ওপর থেকে এমন গতিতে আবর্তনের জন্য স্থাপিত হবে, সব সময় ঠিক সে স্থানের ৩৫,৭৯৪ কিলোমিটার ওপরেই সেটি অবস্থান করবে। পৃথিবীপৃষ্ঠের যে কোনো স্থানের পরিপ্রেক্ষিতে সেটি স্থির বলে প্রতিভাত হবে; যদিও তার 'বিরাম নেই আকাশের মাঝে'। যেহেতু পৃথিবী তার নিজ অক্ষে পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে যতক্ষণে একপাক ঘুরবে (প্রায় ২৪ ঘণ্টা), ততক্ষণে সে উপগ্রহটিও পৃথিবীকে একবার প্রদক্ষিণ করবে। পৃথিবীপৃষ্ঠের যে কোনো স্থান যতক্ষণ পৃথিবীর অক্ষের পরিপ্রেক্ষিতে যতটুকু দূরত্ব অতিক্রম করবে, উপগ্রহটিও ততক্ষণে ততটুকুই কৌণিক দূরত্ব অতিক্রম করবে। তাই উপগ্রহটি আবর্তনশীল হলেও পৃথিবীর যে কোনো স্থানের পরিপ্রেক্ষিতে সেটির কোনো আপেক্ষিক গতি থাকবে না। এ ধরনের কক্ষপথের কথা স্যার আর্থার সি ক্লার্ক বলেছিলেন। তিনি বর্ণনা করলেন যে, সে কক্ষপথে ১২০ ডিগ্রি ব্যবধানে প্রদক্ষিণরত মাত্র তিনটি উপগ্রহের সাহায্যে সারা পৃথিবীর সব জায়গা একটি বেতার-যোগাযোগ ব্যবস্থার আওতায় আনা সম্ভব। সেখানে পাহাড়-পর্বতের বাধা তো নয়ই, এমনকি পৃথিবীর গোলত্বের বাধাও কোনো সমস্যা নয়। তাই তার নামে ভূস্থির উপগ্রহের কক্ষপথটির নাম ক্লার্কস অরবিট রাখা হয়েছে। বস্তুত কক্ষপথে স্থাপিত ভূস্থির উপগ্রহের কার্যক্রমের ক্লার্কের কক্ষপথের মাধ্যমেই ব্যাখ্যা করা সম্ভব- এই বিবেচনায় 'বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১'র কার্যক্রমও।

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত