শেখ হাসিনার উদ্যোগ বাংলাদেশের স্বর্ণযুগ

9515

Published on জুন 3, 2018
  • Details Image

শাহাব উদ্দিন মাহমুদঃ

ক্ষুধা দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা গড়তে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দেশের প্রতিটি মানুষের খাদ্য, আশ্রয়, চিকিৎসা, শিক্ষাসহ সকল মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করে একটি সুখি ও উন্নত দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলেন তিনি। তাঁর সুদূরপ্রসারী চিন্তা-ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দারিদ্র্য বিমোচনে বহুমাত্রিক কর্মসূচী বাস্তবায়নসহ সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিয়েছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় প্রধানমন্ত্রীর ১০টি বিশেষ উদ্যোগসমূহের অন্যতম হলো ‘একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প’ প্রকল্পটি ইতোমধ্যে দারিদ্র্য বিমোচনে টেকসই মডেল হিসেবে দেশ বিদেশে প্রশংসিত হয়েছে। দেশের মোট জিডিপির ৫১ ভাগ আসছে কৃষি অর্থাৎ গ্রামীণ অর্থনৈতিক কর্মকা- থেকে। তাই কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে গ্রামীণ জনগণের কর্মসংস্থান সৃষ্টির প্রচেষ্টা বাদ দিয়ে কোনভাবেই দারিদ্র্য ও ক্ষুধামুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্ন কল্পনা করা যায় না। এই লক্ষ্যকে সামনে রেখেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক নেয়া দ্বিস্তর সমবায় পদ্ধতির মাধ্যমে গৃহীত ‘সমন্বিত পল্লী উন্নয়ন কর্মসূচি’র ধারাবাহিকতায় ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ১৯৯৮ সালে প্রকল্পের কার্যক্রম শুরু হলে ও ২০০৯ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হসিনার সরকার পুনরায় ক্ষমতায় আসার পর দারিদ্র্য বিমোচন ও গ্রাম উন্নয়নবান্ধব প্রকল্প ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ চূড়ান্ত গতি লাভ করে।

‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্পঃ

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার (১৯৯৬-২০০১) মেয়াদে থাইল্যান্ড সফরের অভিজ্ঞতার আলোকে ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্প চালু করেছিলেন। গ্রামের একটি বাড়িকে অর্থনৈতিক কর্মকা-ের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠা লাভ করে এ প্রকল্প। বহুমুখী দারিদ্র্য দূরীকরণ টেকসই ও সুষম উন্নয়ন, বৈষম্য নিরসনের পূর্বশর্ত। সরকার দারিদ্র্য ও অসমতা দূরীকরণের লক্ষ্যে এসডিজি-১ সহ অন্যান্য এসডিজিসমূহ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বাস্তবায়নের লক্ষ্য স্থির করেছে। দেশের ২ কোটি ৫৩ লাখ ৫০ হাজার গ্রামীণ পরিবারের ৮৪ শতাংশ ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক খামারী যাদের জমির পরিমাণ ৫ থেকে ২৩৫ শতাংশ। দেশের মোট কৃষিজ উৎপাদনের ৭০ শতাংশ উৎপাদন করে এই পরিবারগুলো। সংখ্যাগরিষ্ঠ এই গ্রামীণ পরিবারগুলো নিজেদের ও দেশের খাদ্য উৎপাদন ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নিরলস ভূমিকা পালন করছে। তাই, অধিক পরিমাণে খাদ্য উৎপাদন ও স্থায়িত্বশীল কৃষির জন্য একটি সঠিক উপায় হতে পারে দরিদ্র পরিবারগুলোর কৃষিজমির সর্বোত্তম ব্যবহার। এ কাজে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক খামারীদের উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়তা দিতে এইসব ক্ষুদ্র খামারে আরও অধিক বিনিয়োগ সরকারের একটি নীতিগতকৌশল। এ অঙ্গীকারের আলোকে বর্তমান সরকার স্থানীয় সম্পদ, বিশেষত: মানব সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার তথা জীবিকায়নের মাধ্যমে প্রতিটি বাড়িকে অর্থনৈতিক কর্মকা-ের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্প বাস্তবায়ন করে আসছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে সরকার দেশের লাখ লাখ প্রান্তিক গ্রামীণ পরিবার, যারা ৫ থেকে ১০০ শতাংশ জমির মালিক তাদেরকে সংগঠিত করে সঞ্চয়ে উৎসাহ প্রদান, সদস্য সঞ্চয়ের বিপরীতে সমপরিমাণ অর্থ বোনাস প্রদান, আত্মকর্মসংস্থানের মাধ্যমে স্বাবলম্বী করাসহ বহুমুখী কর্মকা- পরিচালনায় বিনিয়োগ করেছে। সদস্যদের প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে তাদের দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তোলা, অর্থনৈতিক কর্মকা- পরিচালনায় পুঁজি গঠনে সহায়তা প্রদান, আত্মকর্মসংস্থানের মাধ্যমে স্বাবলম্বী করার কার্যক্রমসহ বহুমুখী কর্মকা- পরিচালনা করা হচ্ছে। দেশের ৬৪টি জেলার ৪৯০টি উপজেলায় ৪৫০৩টি ইউনিয়নের ৪০৫২৭টি ওয়ার্ডে এ কার্যক্রম বাস্তবায়িত হচ্ছে। প্রতি ওয়ার্ডের একটি গ্রামে ৬০টি গরিব পরিবারের সমন্বয়ে একটি গ্রাম উন্নয়ন সমিতি গঠন করে তাদের আর্থসামাজিক উন্নয়নে কার্যক্রম গ্রহণ করা হচ্ছে। এ প্রকল্পের আওতাভুক্ত সদস্যরা হলো প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষক। এদেরকে কয়েকটি গ্রুপে ভাগ করা হয়। প্রতিটি গ্রুপ নিজেদের সুবিধা বা পছন্দ অনুযায়ী এবং যে এলাকায় যে ধরনের জীবিকা গ্রহণ করা সম্ভব তারা সেটা করতে পারে। এদের দুই-তৃতীয়াংশ মহিলা। বর্তমানে দেশে কৃষি উন্নয়ন ও গ্রামীণ দারিদ্র্য বিমোচনে একটি উল্লেখযোগ্য ও অভিনব সংযোজন হলো শেখ হাসিনার স্বপ্ন প্রসূত ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্প বাস্তবায়ন। আন্তর্জাতিক টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অনুসারে আগামী ২০৩০ সাল নাগাদ আমাদের দারিদ্র্যের হার শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে হবে। দূর করতে হবে ক্ষুধা ও পুষ্টিহীনতা। এ প্রকল্পটির মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন সহজ হচ্ছে, কারণ এটি একটি সমন্বিত খামার উন্নয়ন প্রকল্প। এর মাধ্যমে একটি বাড়িতে দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়ে থাকে। নির্বাচিত একটি বাড়ির জমিতে বিভিন্ন শাক-সবজি, ধানসহ অন্যান্য ফসল, পুকুরে মাছ, গোয়ালে গরু, ঘরে ছাগল, হাঁস-মুরগি, বাড়ির চারপাশে বনজ, ফলদ, ঔষধি গাছপালা রোপণ ইত্যাদি প্রত্যেকটি সেক্টরে সহযোগিতা দেয়া হয়ে থাকে। সেখানে এগুলোর পাশাপাশি বাড়িতে ছেলেমেয়েদের জন্য লেখাপড়া, বাড়িতে বেকার পুরুষদের জন্য ছোটখাটো ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে এবং মহিলাদের জন্য তাদের উপযোগী কাজ যেমন সেলাই, বাঁশ-বেতের কাজসহ অন্যান্য আরও অনেক ধরনের আয় বর্ধনমূলক কাজে ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করে দেয়া হয়। সমিতির সদস্যরা যে বাধ্যতামূলক সঞ্চয় করছে, সরকারের পক্ষ থেকে ঠিক সমপরিমাণ অর্থ সমিতিগুলোকে দিয়ে তহবিল গঠন করা হচ্ছে। একই সঙ্গে সরকার ঘূর্ণায়মান ঋণ হিসেবে সমপরিমাণ টাকা দিচ্ছে প্রতিটি সমিতিকে। প্রকল্পের ওয়েবসাইটে প্রদত্ত তথ্য অনুসারে মোট সঞ্চয়ের পরিমাণ হচ্ছে ৫৮৯ কোটি টাকা এবং সরকারের মেচিং ফান্ড ৫৮৯ কোটি টাকা। তাছাড়া সরকারের অনুদান হচ্ছে ৮২২ কোটি টাকা। তাতে মোট জমাকৃত অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় ২ হাজার কোটি টাকা। বর্তমানে এ প্রকল্পটির মাধ্যমে ৭১ হাজার ২১৯টি সমিতি গঠন করা হয়েছে। এ সমিতির মাধ্যমে ৩৪ লাখ ১৩ হাজার ৯৬৭টি পরিবার স্বাবলম্বী হয়েছে। ২০২১ সাল নাগাদ প্রকল্পটির মাধ্যমে ৭০ লাখ পরিবারকে স্বাবলম্বী করার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে এগিয়ে চলছে কার্যক্রম। সরকারী অনুদান এবং সঞ্চিত জমার সঙ্গে উৎসাহ বোনাস, ব্যাংক মুনাফা ও আবর্তক তহবিলসহ সর্বমোট ৩ হাজার ১৮৫ কোটি টাকার একটি স্থায়ী পুঁজি গঠন করে দেয়া হয়েছে যা দিয়ে সদস্যগণ নিজেদের মধ্যে নিজেরাই সমঝোতার ভিত্তিতে ঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। শেখ হাসিনা দেশ থেকে দারিদ্র্য হটানোর যে অঙ্গীকার করেছেন তা বাস্তবায়নে এই প্রকল্পের সুবিধা কাজে লাগবে। পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের বাস্তবায়নাধীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চিন্তাপ্রসূত ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্প দেশের প্রান্তিক মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। ক্ষুধা ও দারিদ্র্য বিমোচনের মধ্য দিয়ে আর্থ-সামাজিকভাবে স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলাই এ প্রকল্পের মূল লক্ষ্য। ইতোমধ্যে গ্রামীণ দেশের গ্রামসমূহে অর্থনৈতিক কর্মকা- বৃদ্ধি পেয়েছে স্বাবলম্বী হয়েছে প্রকল্প এলাকার প্রান্তিক মানুষ। প্রকল্পের উন্নয়নমূলক এ কর্মকা- চলমান রাখার জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক, যা উপকারভোগী সদস্যদের মাঝে সহজ শর্তে জামানতবিহীন ঋণ সুবিধা প্রদান করবে।

পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকঃ

একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের আওতায় গৃহীত কার্যক্রমের স্থায়িত্ব প্রদান ও দারিদ্র্য বিমোচন কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক স্থাপন করা হয়েছে। ২০১৪ সালে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে ‘পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক আইন- ২০১৪’ পাস হয়। উক্ত আইনের আওতায় গঠিত পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক ইতোমধ্যে কার্যক্রম শুরু করেছে। ২০২১ সালে একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প শেষ হওয়ার পর পর্যায়ক্রমে প্রকল্পের সকল কার্যক্রম, সম্পদ, দায় ইত্যাদি পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকে স্থানান্তরিত হতে থাকবে। প্রকল্পের সমিতিগুলো পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের আওতায় নিবন্ধিত হবে। এই ব্যাংকের মালিক যৌথভাবে গ্রামের সমিতিভুক্ত প্রান্তিক আয়ের নারী-পুরুষ ও সরকার। প্রাথমিকভাবে ১০০ উপজেলায় নিজস্ব ভবনে চালু করা হয় এই ব্যাংকের শাখা। ভবিষ্যতে ৪৮৫টি উপজেলায় এর শাখা খোলা হবে এবং কার্যক্রম চলবে। পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের বিশেষত্ব হলো ক্ষৃদ্র সঞ্চয়ের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা। ক্ষুদ্র ঋণের ওপর নয়। এটি ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের জন্য বিশেষায়িত ব্যাংক। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছোট ও ভূমিহীন কৃষকদের বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে এ ব্যাংক দক্ষ সেবাকর্মী তৈরির ব্যবস্থা নেবে। প্রতিটি বাড়িতে উন্নত খামারে রূপান্তরিত করে উৎপাদন বৃদ্ধি নিশ্চিত করবে এবং দক্ষ উদ্যোক্তা তৈরিতে ভূমিকা রাখবে। তাতে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে এবং দারিদ্র্য নিরসন হবে।

বঙ্গবন্ধুর ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নপূরণে বর্তমান সরকার কাজ করছে। একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের অর্জিত সফলতার আলোকে আগামী তিন বছরের মধ্যে ভিক্ষুক ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে এ প্রকল্পের আওতাভুক্ত করার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে সরকার। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে দেশে ৮২ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করতো। বর্তমানে দেশে দরিদ্র মানুষের হার ২২ দশমিক ৪ শতাংশ। বাংলাদেশ ছাড়া বিশ্বের অন্য কোন দেশে এখন পর্যন্ত এমন দরিদ্রবান্ধব কর্মসূচী সৃষ্টি হয়নি। সঠিকভাবে পরিচালনা এবং সমিতিভুক্ত সদস্যদের যথাযথ কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে এক সময় প্রতিটি সমিতি আর্থিকভাবে এতটাই স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে যে ঋণের জন্য অন্য কারও নিকট দ্বারস্থ হতে হবে না। এখন পর্যন্ত ৩৪ লাখ ১৩ হাজার ৯৬৭টি পরিবার এ প্রকল্পের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হয়েছে এবং দেড় কোটির বেশি মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এর সুফল পাচ্ছে। আশা করা যায়, ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্প ও পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক গ্রামীণ দরিদ্র্য মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে টেকসই কর্মসূচী নিয়ে এগিয়ে যাবে এবং দারিদ্র্য দূর করে দেশকে ২০২১ সালের মধ্যে একটি মধ্যম আয়ের দেশের কাতারে নিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে গ্রামের মানুষের জীবনযাত্রার মানের একটি গুণগত উত্তরণ নিশ্চিত করবে।

সৌজন্যেঃ দৈনিক জনকণ্ঠ

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত