গাজীপুর নির্বাচন নিয়ে একটি বিশ্লেষণ

11036

Published on জুন 28, 2018
  • Details Image
  • Details Image
  • Details Image
  • Details Image

গাজীপুর নির্বাচনের মোট ৪২৫টি কেন্দ্রের মধ্যে ৪১৬টি কেন্দ্রের প্রাপ্ত ফলাফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী অ্যাডভোকেট মো. জাহাঙ্গীর আলম বিপুল ভোটের ব্যবধানে জিতেছেন। তিনি মোট ভোট পেয়েছেন ৪ লাখ ১০ ভোট অপর দিকে তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি মনোনীত প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকার পেয়েছেন ১ লাখ ৯৭ হাজার ৬১১ ভোট। আওয়ামী লীগ প্রার্থীর নিরঙ্কুশ বিজয়ের কারণ বিশ্লেষণ নিয়েই এই লেখা।

গাজীপুরের কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিসংখ্যান:

২৬শে জুন ২০১৮ তারিখ সারাদিন ৬ লাখ ৪৮ হাজার ৭৪৯ জন ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের পরবর্তী নগরপিতা নির্বাচনের জন্য। এই নির্বাচনে মূলত প্রতিদ্বন্দ্বীতা হয় আওয়ামী লীগ মনোনীত অ্যাডভোকেট মো. জাহাঙ্গীর আলম এবং বিএনপি মনোনীত প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকারের মধ্যে। ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্যে দিয়ে সকাল ৮টা থেকে শুরু হওয়া ভোট উৎসব চলে বিকেল ৪টা পর্যন্ত। কোন বিরতি ছাড়াই ৪২৫টি কেন্দ্রে গাজীপুরবাসী তাদের নগরপিতার পাশাপাশি ৫৭টি ওয়ার্ডের জন্য তাদের পছন্দের কাউন্সিলরও বেছে নিতে ভোট দেন। এর আগে দুই সপ্তাহব্যাপী প্রতিটা প্রার্থী তাদের নির্বাচনী প্রচারণা চালান।

রির্টানিং অফিসারের তথ্য অনুযায়ী গাজীপুর সিটি নির্বাচনে ভোট পড়েছে ৫৭ দশমিক ০২ শতাংশ। এর আগে ২০১৩ সালে সর্বশেষ নির্বাচনে সেখানে ভোট পড়েছিল ৬৩ দশমিক ৬৯ শতাংশ। মোট ভোটের মধ্যে ৬ লাখ ৩০ হাজার ১১১ ভোট বৈধ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে এবং ১৮ হাজার ৬৩৮ ভোট বাতিল হয়েছে।

নির্বাচন উপলক্ষে গাজীপুরে তিনস্তর বিশিষ্ট নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল। পুলিশের পাশাপাশি র‌্যাব, আনসার, বিজিবির ১০ হাজার ৫০০ সদস্য মোতায়েন ছিল। ২৯ প্লাটুন বিজিবি, র‌্যাবের ৫৮টি টিম, ৫৭টি ভ্রাম্যমান দল এবং ২০টি স্ট্রাইকিং ফোর্স মোতায়েন ছিল নির্বাচন উপলক্ষে।

অনিয়মের অভিযোগ এবং বাস্তবতা:

গাজীপুর সিটি নির্বাচনে মোট কেন্দ্র সংখ্যা ছিল ৪২৫টি এবং সেখানে অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে ৯টিতে। সেই ৯টি কেন্দ্রই নির্বাচন কমিশন ভোট গ্রহণ স্থগিত করে। নির্বাচন পর্যবেক্ষক এবং গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলোতে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে, সার্বিকভাবে গাজীপুরের নির্বাচন সুষ্ঠু, স্বাভাবিক এবং ভালো পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়েছে। আর যে ৯টি কেন্দ্রে অনিয়মের অভিযোগ আনা হয়েছিল সেই কেন্দ্রগুলোতে মোট ভোটার সংখ্যা ছিল ২৩ হাজার ৯৫৯ জন। প্রায় সাড়ে ১১ লাখ ভোটারের জায়গাতে এই সংখ্যা নিতান্তই অপ্রতুল। আর প্রাপ্ত ভোটের ফলাফলের দিকে তাকালে দেখা যাবে দুই নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর ভোটের প্রার্থক্য ২ লাখ ২৩ হাজার ৯৯ ভোট। এই বিশাল ব্যবধানে মাত্র প্রায় ২৪ হাজার ভোট কোন প্রভাব ফেলে না এটা স্পষ্টতই বোঝা যায়। তার পরেও এটা বলা যায়, যদি বাতিল হওয়া ওই ৯টি কেন্দ্রের সব ভোটও বিএনপি প্রার্থী পেতেন তার পরেও এই বিশাল ব্যবধানে কোন প্রভাব পড়তো না। 

বিতর্ক তৈরীর প্রচেষ্টা:

সম্প্রতি ফাঁস হওয়া বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা মিজানুর রহমান মিজানের একটি অডিও ক্লিপ থেকে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে, বিএনপি গাজীপুরের নির্বাচনে সহিংসতা সৃষ্টির একটি ছক আঁকছিল। পরে এই দায় যাতে তারা সরকারের উপর চাপাতে পারে তার সকল আয়োজন প্রায় তারা সম্পন্ন করে রেখেছিল। ফাঁস হওয়া ফোনালাপ থেকে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে, বিএনপি নেতাদের পরিকল্পনা ছিল, তারা আওয়ামী লীগের ব্যাজ পরে নির্বাচনে বিতর্কিত কিছু করবে এবং সেই দায় তারা আওয়ামী লীগের উপর দিয়ে পুরো নির্বাচন ব্যবস্থাকেই বিতর্কিত করবে।

বিএনপির পোলিং এজেন্ট বিষয়ে অভিযোগ:

নির্বাচনের দিন বিএনপির প্রধান একটি অভিযোগের মধ্যে ছিল, তাদের পোলিং এজেন্টদেরকে বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে আওয়ামী লীগের কর্মীরা বের করে দিয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা বলে সাংবাদিকদের প্রতিবেদনেই উঠে এসেছে যে, বিভিন্ন কেন্দ্র ঘুরে ঘুরে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত এমন কোন ঘটনাই ঘটেনি। কারণ বিএনপি অধিকাংশ কেন্দ্রে তাদের কোন পোলিং এজেন্টই পাঠায়নি। আওয়ামী লীগ সদ্য নির্বাচিত মেয়র অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর আলম বিএনপির ওই অভিযোগের বিষয়ে তখন বলেছিলেন, 'বিএনপির পোলিং এজেন্টরা কেন্দ্রে যায়নি। এ বিষয়ে আমার কাছে অনেক প্রমাণ আছে। সেগুলো এখন দিতে পারবো না, কারণ নির্বাচনি আচরণ বিধি লঙ্ঘন করা হবে। তবে ভোট গণনার পর আমি এগুলোর প্রমাণ দিতে পারবো।' বাংলা ট্রিবিউনের এক সাংবাদিক গাজীপুরের ১২টি ভোট কেন্দ্রে যেয়ে দেখেন মাত্র ২টিতে বিএনপি তাদের পোলিং এজেন্ট পাঠিয়েছে আর বাকিগুলোতে কাউকে পাঠায়নি। এই অবস্থা সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত একই ছিল।

ভোটের ফলাফলে অপ্রত্যাশিত ছিল না:

আওয়ামী লীগ প্রার্থীর নিরঙ্কুশ বিজয় মোটেও অপ্রত্যাশিত ছিল না। গাজীপুরে আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে বিজয়ী করতে দল থেকে যেমন ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা ছিল তেমনি প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলমও গাজীপুরে সর্বাধিক জনপ্রিয় নেতাদের একজন তাই তিনি সকল শ্রেণী-পেশার মানুষের মন জয় করতে পরেছিলেন। অপরদিকে বিশ্লেষক এবং পর্যবেক্ষকদের ধারণা বিএনপির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, সাংগঠনিক দুর্বলতা এবং অজনপ্রিয় প্রার্থী বাছাই গাজীপুর সিটি নির্বাচনে বিএনপির এই ভরাডুবির মূল কারণ। গাজীপুরে বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দল কতটা ভয়াবহ তার প্রমাণ তারা প্রতিটি কেন্দ্রে তাদের পোলিং এজেন্ট পর্যন্ত দিতে পারেনি নির্বাচনের দিনেও। গতবারের বিএনপির নির্বাচিত মেয়র অ্যাডভোকেট আব্দুল মান্নানের অনুপস্থিতিই প্রমাণ করে বিএনপি গাজীপুরে কতটা অন্তর্কোন্দলে জর্জরিত। তারা সাংগাঠনিকভাবে দলীয় প্রার্থীর জন্য মাঠে নামতে ব্যর্থ হয়েছে। আওয়ামী লীগের তরুণ,উদ্যোমী এবং সক্রিয় প্রার্থীর বিপরীতে বিএনপির প্রার্থী ছিল একেবারেই পিছিয়ে। যা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে আলোচিত ছিল। গাজীপুরে মূলত তরুণ ভোটররাই পার্থক্য গড়ে দিয়েছে। কিন্তু তরুণদেরকে আকর্ষণ করার ক্ষেত্রে অনেকটাই পিছিয়ে ছিল বিএনপির প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকার। সেখানে তরুণদের কাছে খুব সহজেই পৌঁছে গেছেন আওয়ামী লীগের তরুণ প্রার্থী মো. জাহাঙ্গীর আলম।

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত