অর্জনে-অনুভবে আইভি রহমান - দিল মনোয়ারা মনু

2395

Published on আগস্ট 18, 2018
  • Details Image

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের জনসভায় এক নৃশংস বোমা হামলায় গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিত্সাধীন অবস্থায় ২৪ আগস্ট প্রয়াত হলেন আইভি রহমান। ৬০ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। প্রায় অর্ধ শতাব্দীর উদ্যমী ও সংগ্রামী জীবনের এই মানুষটি একাধিক কারণে স্মরণীয়। একাধারে তিনি ছিলেন সমাজকর্মী, রাজনীতিবিদ এবং অন্যদিকে সংসৃ্কতি ও বিজ্ঞানমনস্ক রুচিশীল মানুষ। আমাদের মুক্তিযুদ্ধসহ সকল গণ আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছেন তিনি। সব মিলিয়ে তাঁর অনেক কৃতিত্ব, কিন্তু সবচেয়ে বেশি কৃতিত্ব তাঁর এদেশের অসহায় সুযোগ বঞ্চিত নারীদের পাশে দাঁড়ানো এবং তাদের উঠে দাঁড়ানোর জন্য পথ তৈরির ক্ষেত্রে। এ ক্ষেত্রে তিনি এক নন্দিত নাম, নান্দনিক মানুষ। স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে এক গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে আপওয়াকে বাংলাদেশ মহিলা সমিতিতে রূপান্তর করা হয়। সেই গেজেটে ড. নীলিমা ইব্রাহিমকে সভানেত্রী এবং আইভি রহমানকে সাধারণ সম্পাদিকা করে কার্যকরী সংসদ গঠন করা হয়। পরবর্তী সময়ে দীর্ঘদিন তিনি অসাধারণ প্রজ্ঞা ও দক্ষতা নিয়ে এই সংগঠনের সহ-সভানেত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০০১ সালে সভানেত্রী নীলিমা ইব্রাহিমের মৃত্যুর পর তিনি সভানেত্রী হন। এই সমিতির একটি কর্মসূচিতে ১৯৭৪ সালে তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা। সমিতির উদ্যোগে দুঃস্থ শিশুদের মধ্যে দুধ বিতরণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বিতরণ করেছেন আইভি রহমান। আমার সুযোগ হয়েছিল সাংবাদিক হিসেবে সেই অনুষ্ঠানে থাকার। আইভি আপা অফ হোয়াইট রংয়ের লাল পাড় শাড়ি পরা। চোখে সানগ্লাস, লাবণ্য মণ্ডিত স্নিগ্ধ চেহারা। অপূর্ব লাগছিল তাকে। শিশুরা দুধ নিতে গিয়ে অবাক হয়ে দেখছিল তাঁকেই। এই তন্ময়তার কারণে তাদের অনেকের বরাদ্দ দুধ ছলকে নিচে পড়ে যাচ্ছিল। এরপর মহিলা সমিতির নানা প্রোগ্রামে তাঁকে দেখার সুযোগ হয়েছে। সর্বশেষ দেখেছি তাকে নীলিমা ইব্রাহিমের মৃত্যুর পর। গভীর আন্তরিকতা নিয়ে তার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্যে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন। নীলিমা ইব্রাহিমের সুযোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে এদেশের মঞ্চ নাটককে গণমানুষের কাছে তুলে ধরার জন্য মহিলা সমিতি মিলনায়তন ব্যবহারের বন্দোবস্ত করার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছিলেন।

১৯৭৬ সালে জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসন বিরোধী সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনেই তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। ’৮১ সালের ৩০ মে জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর দিনে তাঁকে কারাবন্দি করা হয়। তিনি কুমিল্লা সেনানিবাসে বেশ কয়েকদিন বন্দি থাকেন। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনেও তাঁর ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। ১৯৮৪ সালের ২৬ মার্চ এরশাদের জারি করা ১৪৪ ধারা ভঙ করে জাতীয় স্মৃতিসৌধে মালা দেওয়ার সময় গ্রেফতার হন। ১৯৯০-এর গণ- আন্দোলনে জননেত্রী শেখ হাসিনা, বেগম মতিয়া চৌধুরীর সঙ্গে তিনি পুনরায় গ্রেফতার হয়ে কারাবরণ করেন। আইভি রহমান ১৯৬২ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা রেখে গেছেন। এদেশের অসচেতন নারী সমাজকে রাজনৈতিকভাবে উদ্বুদ্ধ করা, আইনের শাসন কায়েম এবং নারীর ক্ষমতায়ন ও অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়।

আইভি রহমান সারা জীবন মাঠের রাজনীতি করেছেন। রাজনৈতিক সভায় মঞ্চে উঠে ভাষণ দিয়েছেন খুব কম। কর্মীদের সঙ্গে মঞ্চের পাশে বসে শুনতে এবং মুহুর্মুহু শ্লোগান দিতেই পছন্দ করতেন বেশি। কিন্তু পোশাকে ছিলেন অত্যন্ত রুচিশীল এবং পরিপাটি। স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই রাজনীতি করতেন কিন্তু তারপরও তাদের সংসারের রুচি, স্নিগ্ধতা ও পরিপাট্য সকলকে মুগ্ধ করত।

মৃত্যুর কয়েক মাস আগে নারী আসন নিয়ে তখন নারী সংগঠনগুলোর প্রচণ্ড তত্পরতা চলছে পঁয়তাল্লিশ আসন নারীদের জন্য নির্ধারিত হলে প্রতিবাদে ফেটে পড়ল নারী সমাজ। জাদুঘরের সামনে সমাবেশ করা হলো। বক্তৃতা চলছে। বেশ কিছুক্ষণ পরে এলো মহিলা আওয়ামী লীগ, আইভি রহমানের নেতৃত্বে। মুহূর্তেই প্রকম্পিত হলো জনপদ, মুহুর্মুহু শ্লোগানে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন ছাত্রলীগের কর্মী নামধারী কিছু ছাত্র ধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্ত তখন আইভি রহমান চিত্কার করে বলেছিলেন, তোমাদের এই নিন্দনীয় কাজে আমি যে এককালে ছাত্রলীগ করেছি সে কথা ভাবতেও লজ্জা হচ্ছে। অকপটে সত্য ভাবতে ও বলতে তাঁর কোনো দ্বিধা ছিল না।

ইডেন গার্লস কলেজ থেকে স্নাতক আইভি রহমান ১৯৪৪ সালে ৭ জুলাই ভৈরবের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় এম.এ ক্লাসে যোগদান করেন কিন্তু ডিগ্রি সমাপ্ত করেননি। বাবা ঢাকা কলেজের এক সময়ের জাঁদরেল অধ্যক্ষ ও শিক্ষাবিদ প্রয়াত জালাল উদ্দিন আহমেদ ও মা হাসিনা বেগম। ১৯৫৮ সালের ২৭ জুন জিল্লুর রহমানের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। জনাব রহমান আওয়ামী লীগের প্রথম সারির নেতা এবং পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগ সরকারের স্থানীয়, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী নিযুক্ত হন। তখনকার জেবুন্নাহার আইভি বিয়ের পর আইভি রহমান নামে সমধিক পরিচিতি পান। স্কুলের এক ফাংশনে নাচতে দেখে জিল্লুর রহমান তাঁকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেন। আইভি রহমানের বাবার কাছে একাই ভয়ে ভয়ে বিয়ের প্রস্তাব দেন। দু’দিন পর তিনি সম্মতি জানালে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের গাড়িতে শেখ মুজিব ও আতাউর রহমান খানকে সঙ্গে নিয়ে বিয়ে করতে যান। এ দু’জনই ছিলেন তাদের বিয়ের সাক্ষী। আট বোনের ও তিন ভাইয়ের মধ্যে আইভি রহমান ছিলেন চতুর্থ। বড় বোন বিশিষ্ট সমাজসেবী শামসুন্নাহার সিদ্দিকী।

আইভি রহমান তাঁর কাজের স্বীকৃতি হিসেবে আমেরিকান বায়োগ্রাফি ইনস্টিটিউট থেকে ‘ওমেন অব দি ইয়ার ২০০০’ নির্বাচিত হন। নাগরিক নাট্যাঙ্গন এবং সোনার বাংলা যুব কল্যাণ পরিষদ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য পদক প্রদান করে এবং স্বাধীনতার রজত জয়ন্তীতে বাংলাদেশ মহিলা সমিতিও সংবর্ধনা দেয়।

নির্মম নিষ্ঠুর ঘাতকদের গ্রেনেড হামলায় মারাত্মক আহত হয়ে হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে শেষ পর্যন্ত আমাদের মাঝ থেকে অকালে হারিয়ে গেলেন। নয়ন সম্মুখে তিনি আজ নেই। কিন্তু তিনি ঠাঁই করে নিয়েছেন এদেশের সকল গণতন্ত্রমনা মানুষের মনে। তিনি বেঁচে থাকবেন তাঁর কাজ ও আদর্শের মধ্যে। বেঁচে থাকবেন আমাদের সকল অর্জনে, চিন্তা চেতনায় ও বুদ্ধির অনুভবে।

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত