ড. কামাল হোসেন সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র করছেন!

18104

Published on সেপ্টেম্বর 23, 2018
  • Details Image

চিররঞ্জন সরকার:

ড. কামাল হোসেনের বিরুদ্ধে সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনেছেন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক। তিনি বলেছেন, আওয়ামী লীগ সরকারকে উৎখাত করতে বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার আহ্বায়ক ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন ষড়যন্ত্র করছেন।

আইনমন্ত্রীর এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে ড. কামাল হোসেনকে নিয়ে আবারও রাজনৈতিক মঞ্চে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। প্রশ্ন হলো, সত্যিই কি কামাল হোসেন সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র করছেন? ড. কামালের মতো একজন আগাগোড়া ব্যর্থ রাজনীতিবিদের আদৌ কী ষড়যন্ত্র করার সক্ষমতা রয়েছে? আর বর্তমান বাংলাদেশের রাজনীতিতে মার্কিন রাষ্ট্রদূতেরই কী ‘ষড়যন্ত্র’ করে ‘সরকার ফেলে’ দেবার মতো প্রভাব রয়েছে? কিছুই যদি না হয়, তাহলে আনিসুল হকের মতো দায়িত্বশীল মন্ত্রীই বা এমন অভিযোগ আনবেন কেন?

ড. কামাল হোসেন সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র করেছেন কি করেননি, আমরা সেই আলোচনায় যাব না। এ অভিযোগের সত্যাসত্য প্রমাণের দায়িত্ব সরকারের। আমরা বরং ড. কামালের রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কে খানিকটা আলোকপাত করতে পারি।

ড. কামাল হোসেন নিঃসন্দেহে আমাদের দেশের শ্রেষ্ঠ গুণী ব্যক্তিদের একজন। যুবক বয়সেই একজন কৃতি আইনজীবী হিসেবে তিনি খ্যাতি লাভ করেন। মেধা ও যোগ্যতার কারণেই তিনি তরুণ বয়সে বঙ্গবন্ধুর নজর কাড়েন। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে তিনি মাত্র ৩৫ বছর বয়সে আইনমন্ত্রী হন। এরপর পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং সবশেষে পেট্রোলিয়াম ও খনিজ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন। ড. কামালের নেতৃত্বেই স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে প্রথম সংবিধান রচিত হয়। ১৯৭২ সালে প্রণীত সেই সংবিধান ছিল এই দেশের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রকৃত দলিল।

এত যোগ্যতা ও মেধা থাকা সত্ত্বেও তিনি গণমানুষের নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেননি। বঙ্গন্ধুকে হত্যার পর দেশের রাজনীতিতে যে অন্ধকার নেমে আসে সেই অন্ধকারে আলোর পথ দেখাতে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। বিপন্ন আওয়ামী লীগকেও তিনি পুনর্গঠন করতে পারেননি। এক সময় আওয়ামী লীগকে রক্ষা করতে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া রাজনীতিতে অনভ্যস্ত বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত অবশ্য তিনি আওয়ামী লীগেও স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেননি। আওয়ামী লীগ ছেড়ে বিভিন্ন দলছুট ‘হাঁটুভাঙ্গা’ রাজনীতিকদের নিয়ে গঠন করলেন গণফোরাম।

আওয়ামী লীগ বিএনপির ‘নষ্ট রাজনীতির’ বিপরীতে গড়ে তুলতে চাইলেন তৃতীয় ধারা বা মূলধারা। কিন্তু না, কোনো রকম ধারা সৃষ্টিতে তিনি শোচনীয় রকম ব্যর্থ হলেন। বক্তব্য-বিবৃতির ক্ষীণ ধারায় এখন ড. কামালকে মাঝে মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায়। যে মহীরুহের সম্ভাবনা নিয়ে ড. কামাল হোসেন এক সময় এদেশের রাজনীতির উদ্যানে আবির্ভূত হয়ে চমক সৃষ্টি করেছিলেন, শেষ পর্যন্ত তিনি সেই রূপে প্রতিষ্ঠিত হতে পারলেন না। ‘বনসাই’ হয়েই থেকে গেলেন!

ড. কামাল হোসেন আমাদের দেশের রাজনীতিতে সত্যিই একজন বিস্ময় পুরুষ। তিনি আইনজীবী হিসেবে খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছেছেন। তার অসাধারণ জ্ঞান-প্রজ্ঞা নিয়ে কারও মধ্যে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। তবু তিনি রাজনীতিতে সফল হতে পারলেন না। আওয়ামী লীগে তার ঠাঁই হলো না। গণফোরামেও তিনি প্রাণসঞ্চার করতে পারলেন না। তিনি একাধিকবার সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে নির্বাচিত হতে ব্যর্থ হয়েছেন। যেখানে রাজনীতিতে ‘অর্বাচীন’ খালেক, হাজি সেলিম, ‘পাজি’ বদিরা বিপুল ভোটে জয়লাভ করে এমপি হন, সেখানে ড. কামালের মতো ব্যক্তিরা শোচনীয়ভাবে হেরে যান। এটা জনগণের ‘মানিক’ চেনার ব্যর্থতা, নাকি ড. কামালের ‘মানিক’ হিসেবে নিজেকে জনগণের কাছে পরিচিত করতে না পারার ব্যর্থতা সেটা একটা জটিল ধাঁধা।

ড. কামাল হোসেন যে শুধু আমাদের হতাশ করেছেন, তাই নয়, বিস্মিতও করেছেন। গণফোরাম গঠনকালে তার মতো সৎ, যোগ্য, প্রাজ্ঞ, বিজ্ঞ ব্যক্তি যখন মোস্তফা মহসিন মন্টুকে সঙ্গে নিয়েছিলেন, তখন সবাই একযোগে চোখ কপালে তুলেছিল। রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জহুরুল হক হল, ও কেরানীগঞ্জে পুরো আশির দশক ধরে মন্টু ও তার বাহিনীর ত্রাসের রাজত্ব কায়েমের ইতিহাস কে না জানে?

ড. কামাল হোসেনের রাজনৈতিক ভূমিকা পর্যালোচনা করতে গিয়ে এবার একটু পেছনে তাকানো যাক। ভারতবর্ষের স্বাধীনতার রুদ্ধদ্বারে প্রথম যিনি করাঘাত করেছিলেন, তিনি হলেন মোহন দাস করমচাঁদ গান্ধী। গুজরাট-তনয় গান্ধীজী নতুন ভারতবর্ষের ভূমিকা রচনার ভার নিতে আহ্বান জানিয়েছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশকে, তখনও তিনি দেশবন্ধু নন, লিডার অফ দ্য বার। ব্যারিস্টার সি আর দাশ। সি আর দাশকে ডাকলেন গান্ধীজী। সি আর দাশের রোজগার তখন কুবেরের ঈর্ষাযোগ্য। তিনি মাহাত্মাজীকে বললেন, নিন কত টাকা লাগে আমার কাছ থেকে নিন। সি আর দাশ ব্যারিস্টার হলে কি হবে, সামান্য বাঙালি। কিন্তু গান্ধীজী ব্যারিস্টার হিসেবে তার কাছে কিছুই না হলে কি হবে, ব্যবসাবুদ্ধিতে ঝানু বানিয়া। তিনি বললেন, চিত্তরঞ্জন, তোমার টাকা চাই না। তোমাকে চাই।

গান্ধীজীর ডাকে সাড়া দিয়ে সি আর দাশ বিসর্জন দিলেন আইন ব্যবসা। মুহূর্তমাত্র দ্বিধা না করে ঝাঁপিয়ে পড়লেন দেশের কাজে। প্রতিজ্ঞা করলেন, মামলা লড়বেন না আর, দেশের মুক্তিযুদ্ধে লড়বেন। এদিকে তদানীন্তন ভারত সরকারের হয়ে একটি মামলা চালানোর জন্য আগের থেকেই তিনি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন। চিঠি লিখলেন কর্তৃপক্ষকে, মামলা চালানোর দায় থেকে আমাকে অব্যাহতি দিন। আমি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ; মামলা আমি, আপনি ছুটি না দিলে চালাতে বাধ্য। যদিও আমি প্রতিজ্ঞা করেছি, দেশের কাজের জন্য ত্যাগ করেছি আইন ব্যবসা। তবুও সত্যবদ্ধ আমি, এই মামলা আমাকে লড়তেই হবে, কারণ সত্য দেশের চেয়েও বড়! তবে এই মামলায় আমার মন থাকবে না। কাজেই সত্য না রক্ষার অপরাধে আমি অপরাধী হব। তাই ছুটি চাইছি আপনার কাছে। যার কাছে তিনি এই আবেদন করেছিলেন, তিনি লিখে গেছেন, পৃথিবীর ইতিহাসে চিত্তরঞ্জনের মতো এত বড় ‘সত্যপ্রিয়’ মানুষ বিরল।

হ্যাঁ, সেই চিত্তরঞ্জন খুব দ্রুতই দেশবন্ধুতে পরিণত হয়েছিলেন। মুক্তিসংগ্রামের পথে এগিয়ে নিয়েছিলেন দেশকে। তার অকাল-প্রয়াণ না ঘটলে হয়তো ভারতবর্ষের ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হতো!

চিত্তরঞ্জন! তার মৃত্যুর পর এ ভারতবর্ষে অনেক ঘটনা ঘটেছে। ভারত ভেঙ্গে পাকিস্তান হয়েছে। পাকিস্তান নামক নিপীড়ণকারী রাষ্ট্রটির জুলুম-নির্যাতনের শেকল ভেঙ্গে গড়ে উঠেছে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। এ অঞ্চলে কত আইনজীবী এসেছে, গেছে। বদলেছে কত শত বিচারপতি। পাল্টেছে কত না আইনের ধারা। কিন্তু বেঁচে রয়েছে চিত্তরঞ্জনের সেই বিখ্যাত উক্তি: ইফ লাভ অব কান্ট্রি ইজ এ ক্রাইম, দ্যান আই অ্যাম এ ক্রিমিনাল!

গান্ধীজীর ডাকে যেমন দেশবন্ধু সাড়া দিয়েছিলেন, বঙ্গবন্ধুর ডাকেও ড. কামাল হোসেন সাড়া দিয়েছিলেন। কিন্তু দেশবন্ধু যা পেরেছেন, ড. কামাল হোসেন তার ছিঁটেফোঁটাও পারলেন না। ড. কামাল হোসেন কি একবারও ভেবে দেখেছেন, কেন তিনি ব্যর্থ হলেন? কোথায় তার সীমাবদ্ধতা, কোথায় তার ঘাটতি? এত জ্ঞান, এত গুণ থাকা সত্ত্বেও কেন তিনি দুর্দিনে দেশের হাল ধরার সুযোগ পেলেন না?

সকল যোগ্যতা থাকার পরও কী এক অজ্ঞাত কারণে কামাল হোসেন বাংলাদেশের রাজনীতিতে ১৯৭৫ সালের পর থেকে কেবল পার্শ্বচরিত্রের ভূমিকায় অভিনয় করে গেলেন! তার বিরুদ্ধে রাজনীতিসচেতন মানুষের কেবল অভিযোগ আর আর অভিযোগ! প্রয়োজনের সময় অর্থাৎ জাতির দুঃসময়ে তিনি দেশে থাকেন না। আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের কোনো আন্দোলনে তাকে ধারাবাহিক ও সাহসী ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়নি। হঠাৎ হঠাৎ তিনি দেশে আসেন। এসেই কিছু ভালো ভালো কথা বলেন। বক্তৃতা বিবৃতি দেন। তারপর হারিয়ে যান।

অনেকেই তার সমালোচনা করে বলেন, তিনি জন্মেছেন কলকাতায়, বেড়ে উঠেছেন ঢাকায়, বিয়েশাদি করেছেন পাকিস্তানে। একাত্তরের নয় মাস সেই পাকিস্তানে ছিলেন শ্বশুর বাড়িতে। গত চার দশক ধরে তিনি দেশের রাজনীতিতে কেবল ‘সৌখিন’ ভূমিকাই পালন করছেন।

তার সম্পর্কে বলা হয়, তিনি এদেশের এমন একজন নক্ষত্র, যিনি আলোকিত হতে চান অপরের আলোয়। নিজস্ব কোনো আলো তার কাছ থেকে বিচ্ছুরিত হয় না। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর উদারতায় তাঁরই ছেড়ে দেয়া আসনে ১৯৭০ ও ১৯৭৩ সালে। মন্ত্রীও হন বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার। আইনমন্ত্রী হিসেবে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের কাজে নেতৃত্বদানের কৃতিত্ব ছাড়া, তার ঝোলাতে আর কোনো ‘অবদান’ এর কথা শোনা যায় না। দেখাও যায় না। একজন দক্ষ আন্তর্জাতিক আইনজীবী হিসেবে দেশে-বিদেশে তিনি প্রচুর রোজগার করেন। কিন্তু বিপুল এই অর্থ সম্পদ ব্যক্তিগত ভোগবিলাস ছাড়া আর অন্য কোনো খাতে ব্যয় হতে দেখা বা শোনা যায়নি। সামাজিক কোনো খাতে কখনও সামান্য অর্থ দান করার নজিরও রাখেননি।

অক্সফোর্ডে পড়া আইনজীবীটি তাই রাজনৈতিক মহলে বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছেন। তিনি ধূমকেতুর মতো আবির্ভূত হন। আবার উল্কার মতো হারিয়ে যান। গণতন্ত্রের জন্য হাহাকার করা কামাল হোসেন গত প্রায় তিন দশক ধরে গণফোরাম নামক দলটির প্রধান হয়ে বহাল তবিয়তে রয়েছেন। দলে গণতন্ত্রের চর্চা না থাকায় অনেকেই সটকে পড়েছেন। বছরদুয়েক আগে তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, আর রাজনৈতিক দলে থাকছেন না। কিন্তু অন্য অনেকের মতো তিনিও কথা রাখেননি। এখনও গণফোরামের নামে সভা, সেমিনার আয়োজন করেন। সভাপতির ভাষণও দেন।

রাজনীতিতে তিনি নিজে ‘এতিম’ হয়ে আরও ‘এতিম’দের নিয়ে নানা সময়ে জোট গঠনের চেষ্টা চালিয়েছেন। তার পর খেই হারিয়ে আবার ‘পলাতক’ হয়ে গেছেন। ইদানিং তার সহযোগী হিসেবে জুটেছে ‘দল ও কর্মী’ হারা কিছু ব্যক্তি। যারা তাকে নেতা মানেন। অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী বিকল্পধারা নামক একটি দলের মালিক। তিনি ও তার পুত্রের ঘরোয়া দলটির নেতা কামাল হোসেনকে পেয়ে মাঝে মাঝেই হুঙ্কার ছাড়েন।

এই সমবেত হুঙ্কারে আসম আবদুর রব, মাহমুদুর রহমান মান্না, কাদের সিদ্দিকীও আছেন ড. কামালের সঙ্গে। তারা একটি নতুন রাজনৈতিক জোট গঠনের চেষ্টা চালাচ্ছেন। নিন্দুকরা একে বলছেন রাজনৈতিক ‘এতিমখানা’। লক্ষ্য সংসদ নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াতকে ক্ষমতায় আনা এবং নিজেরাও ক্ষমতার অংশীদার হওয়া। তাদের সঙ্গে ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরী নামক খালেদার পরার্মশদাতা ও আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত সুলতান মনসুরও মাঝে মাঝে সুর মেলান। এই হচ্ছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ড. কামাল হোসেনের অবস্থান!

অপার সম্ভাবনাময় এই মানুষটি আমাদের রাজনীতিতে এক দীর্ঘশ্বাস হয়ে রইলেন। প্রশ্ন হলো, আমরা কি সত্যিই এমন একজন কামাল হোসেনকে চেয়েছিলাম?

সৌজন্যেঃ bdnews24.com

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত