প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা- দুর্দিনের অভিযাত্রী, সুদিনের নির্মাতাঃ ড. এ এইচ এম মোস্তাফিজুর রহমান

4114

Published on ফেব্রুয়ারি 26, 2019
  • Details Image

পিপলু খান নির্মিত ‘হাসিনা : আ ডটারস টেল’ এবং আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ও গোলাম রব্বানী নির্মিত ‘শেখ হাসিনা : দুর্গম পথযাত্রী’ চলচ্চিত্র দুটি দেখার পর থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘অপমানিত’ কবিতার ‘যারে তুমি নিচে ফেলো সে তোমারে বাঁধিবে যে নিচে/পশ্চাতে রেখেছ যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে’—চরণগুলো মনের অজান্তেই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। আর সম্প্রতি হয়ে যাওয়া নির্বাচনের ফলাফল এবং নতুন সরকার গঠনে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার বিচক্ষণতা সম্পর্কে ভাবতে গেলেও মনে মনে আওড়াতে থাকি রবিঠাকুরের এই চরণ দুটি। ভাবতে অবাক লাগে, বাংলাদেশের একসময়ের জিঘাংসাময় রাজনীতিতে কোন গিরিখাতে ফেলে দেওয়া হয়েছিল তাঁকে! ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, কতটা পাহাড়সম প্রতিকূল পথ পেরিয়ে দেশে আজ অবিসংবাদিত-অবিকল্প নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন তিনি। অবারিত এই তথ্যপ্রবাহের যুগে তাঁর রাজনৈতিক সংগ্রাম ও প্রজ্ঞা, দৃঢ়চেতা ও মনোবল এবং কার্যকর সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিচক্ষণতাই বিশ্বের অন্যতম সেরা রাজনীতিক হিসেবে, অন্যতম রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে তাঁকে প্রতিষ্ঠা এনে দিয়েছে।

আশির দশকে স্বৈরাচারবিরোধী রাজনৈতিক আন্দোলন ও সাংস্কৃতিক সংগ্রামের যে ইতিহাস, তার প্রতিটি পাতায় তাঁর অবদান ও সাহসিকতা স্পষ্ট অক্ষরে লেখা রয়েছে ইতিহাসের পাতায়। তাঁর জীবনের দীর্ঘ রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামের এ পর্যায়ে এসে বলা যায়, তাঁর যে কষ্টার্জিত ভাবমূর্তি, তা হঠাৎ পাওয়া কোনো আশ্চর্য প্রদীপ নয়, তিলে তিলে করা সাধনার ফসল। স্বজন হারানোর পাহাড়সম বেদনায় ভেঙে না পড়ে টিকে থাকাই যেখানে ছিল দুর্বিষহ, সেখানে তিনি প্রতিকূলতার স্রোতকে উল্টো দিকে প্রবাহিত করাতে সক্ষম হন এবং নতুনভাবে শুরু করেন জীবনসংগ্রাম। এ সংগ্রাম শুধু দেশের সাধারণ মানুষের জন্যই উৎসর্গিত। কেননা এমন মানুষের ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষা বলে যেমন কিছু নেই, তেমনি হারানোরও কিছু নেই। তাই যে বাংলাদেশের বেশির ভাগ নাগরিক তারুণ্যে টগবগ করছে, সে তরুণরা প্রতিবছর নির্বাচনের ক্ষমতার পালাবদল ঘটাতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে—তাদের প্রথম ও প্রধান পছন্দের নেতার নাম শেখ হাসিনা। এবারও এক কোটি ২৩ লাখ তরুণ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ ও সমর্থনের মাধ্যমে শেখ হাসিনার নেতৃত্বকেই মেনে নিয়েছে। কারণ শুধু তো দেশে নন, তাঁর গ্রহণযোগ্যতা এখন বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত।

সম্প্রতি প্রকাশিত হওয়া বিশ্বের সেরা চিন্তাবিদের তালিকায় গুরুত্বপূর্ণ স্থানে উঠে এসেছে শেখ হাসিনার নাম। যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী সাময়িকী ‘দ্য ফরেন পলিসি’ বিশ্বের সেরা ১০০ চিন্তাবিদের একটি তালিকা তৈরি করেছে। সেখানে জায়গা করে নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর তাঁর এই সুসংহত হওয়ার প্রধান কারণ, গণহত্যা ও নির্যাতনের শিকার হয়ে মিয়ানমারের মৃত্যুমুখ থেকে পালিয়ে আসা ১০ লাখ রোহিঙ্গা নাগরিককে বসবাসের জায়গা করে দেওয়া। এই তালিকার ‘প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা’ বিভাগের নির্দিষ্ট মানদণ্ডে করা ১০ জনের সংক্ষিপ্ত তালিকায়ও স্থান পেয়েছেন শেখ হাসিনা। এ তালিকায় শেখ হাসিনার অবস্থান নবম।

সুতরাং শেখ হাসিনার তিলে তিলে গড়া ভাবমূর্তি, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, ব্যক্তিত্বের আলোকশিখা ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বব্যাপী। এমন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নেতৃত্বের ওপর যদি দেশ পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করে জনগণ, তবে এর চেয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত জনগণের পক্ষে আর কী হতে পারে!

এ দেশের মানুষের নিশ্চয়ই মনে আছে, দ্বিতীয়বার (২০০৯ সালে) ক্ষমতায় এসেই কী অপূর্ব কুশলতায় মিয়ানমার আর ভারতের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সালিসি আদালতে মামলা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। বাংলাদেশই পৃথিবীর প্রথম এবং একমাত্র দেশ, যে দেশ সমুদ্রসীমার বিষয়ে সুচিন্তিত মামলা করে বিজয় লাভ করেছে। এই দুই দেশের বিরুদ্ধে সমুদ্রসীমার জয় লাভের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মোট আয়তনের প্রায় সমপরিমাণ আয়তন বৃদ্ধি পেয়েছে। এই বিজয় বিশ্বের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পশ্চিম পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে আমরা এক লাখ ৪৪ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের সার্বভৌম বাংলাদেশ পেয়েছি। ৪০ বছরের ব্যবধানে আরেক মার্চে (মার্চ ২০১২) শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার জাতিকে প্রায় একই আয়তনের এক নতুন ভাসমান বাংলাদেশ নিশ্চিত করেছে। এর প্রথম ১২ নটিক্যাল মাইলের ওপর নিরঙ্কুশ সার্বভৌমত্ব এবং অবশিষ্ট জলরাশির ওপর ‘সার্বভৌম অধিকার’ প্রতিষ্ঠিত হয়। একইভাবে ভারতের বিরুদ্ধে করা মামলার রায় হয় ২০১৪ সালের জুলাইয়ে। সেখানেও বিপুলভাবে লাভবান হয় বাংলাদেশ। বিরোধপূর্ণ ২৫ হাজার ৬০২ বর্গকিলোমিটারের মধ্যে ১৯ হাজার ৪৬৭ বর্গকিলোমিটার আয়তন লাভ করে বাংলাদেশ। একজন আধুনিকমনস্ক এবং অহিংসাপরায়ণ নেতার পক্ষেই তা সম্ভব, প্রতিবেশীর সঙ্গে কোনো ধরনের বিরোধে না জড়িয়ে, সম্পর্কের কোনো অবনতি না ঘটিয়ে, সব কূটনৈতিক সৌজন্য বজায় রেখে নিজের স্বার্থের দিকে শতভাগ অবিচল থেকে এবং চূড়ান্ত বিজয় পর্যন্ত মাথা ঠাণ্ডা রেখে বিচক্ষণতার সঙ্গে আইনি লড়াই চালিয়ে যাওয়া। এ জন্যই তিনি আজ বিশ্বনেতা, এ জন্যই তিনি আজ বিশ্বের সেরা রাজনীতিক শুধু নন, সেরা চিন্তাবিদেরও একজন, এ জন্যই তিনি বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য উত্তরসূরি। মেধা, অক্লান্ত শ্রম আর সাধনায় ক্রমেই তিনি বঙ্গবন্ধু ঘোষিত ‘সবার সঙ্গে বন্ধুতা, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়’ পররাষ্ট্রনীতির শতভাগ বাস্তবায়ন ঘটাতে সক্ষম হয়েছেন।

এমন একজন নেতাকে দেশের তরুণ প্রজন্ম, দেশের ভবিষ্যতের কর্ণধাররা তাদের পছন্দের শীর্ষে ধরে রেখেছে। এটা আমাদের জন্য, আমাদের দেশের রাজনীতি ও অর্থনীতির জন্য যে কত বড় নিয়ামক, তা অচিরেই দৃশ্যমান হবে। গত ১০ বছরে যেভাবে ডিজিটাল প্রযুক্তির কার্যকর ব্যবহারের মাধ্যমে দেশ বদলে গেছে, তার থেকে অনেক দ্রুত বদলে যাবে আগামী পাঁচ বছর। সম্প্রতি তিনি যে সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ নিয়েছেন মাদকমুক্ত দেশ গড়তে, সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতি মোকাবেলা করতে, চিকিৎসকদের গ্রামের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে; তাতে দেশে বৈষম্যহীন সমাজ গড়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।

একসময় এ দেশে জেঁকে বসেছিল বিচারহীনতার সংস্কৃতি, একসময় যুদ্ধাপরাধীদের গাড়িতে পতাকা তুলে দেওয়া হয়েছিল। দুঃখজনক হলেও সত্যি, যারা এ দেশের অস্তিত্বই মানেনি, তারাও ছিল ক্ষমতার ভাগীদার। বর্তমান নতুন প্রজন্ম সৌভাগ্যবান, তারা এখন গর্ব করে বলতে পারে যে এ দেশের মাটি যেমন ৩০ লাখ শহীদের রক্তে ভেজা, তেমনি এ দেশের মাটি এখন কুখ্যাত রাজাকার ও স্বাধীনতাবিরোধীদের পদভার থেকে মুক্ত। কারণ বহু প্রতিকূলতা, দেশি-বিদেশি বহু বাধা উপেক্ষা করে সুদৃঢ় হাতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করা হয়েছে। কেননা এ দেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মানুষকে সেই প্রতিশ্রুতি দিয়ে ২০০৯ সালে সরকার গঠন করেছিলেন। আর তাঁর নিজের প্রাণনাশের উদ্দেশ্যে পরিচালিত একুশে আগস্ট হত্যা মামলার বিচারও সম্প্রতি সম্পন্ন হয়েছে; যে মামলাটি চলেছে ১০ বছর ধরে। পৃথিবীর ইতিহাসে এটিও বিরল ঘটনা যে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচার হয়েছে একজন সাধারণ নাগরিকের হত্যা মামলা যেভাবে চলে—আইনের নিজস্ব গতিতে, তেমনি একুশে আগস্ট শেখ হাসিনা হত্যাচেষ্টা মামলার কার্যক্রমও চলেছে আইনের নিজস্ব গতিতে—কোনো ধরনের রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ ছাড়া। এভাবেই শেখ হাসিনা নিজেকে নিয়ে গেছেন আত্মমর্যাদার এক অন্যূন উচ্চতায়। এভাবেই তিনি দুর্দিনের যাত্রী হয়েও, দুর্গম পথযাত্রী হয়েও বিরল সব উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারেন সারা দুনিয়ার বুকে। আর নানা ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করেও সুখী-সমৃদ্ধিশালী-বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে, জাতির সুদিনের পথ নির্মাণে, নির্ভুল উপায়ে নিরলসভাবে কাজ করে যেতে পারেন ।

লেখক : উপাচার্য, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় ত্রিশাল, ময়মনসিংহ

সৌজন্যেঃ কালের কণ্ঠ

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত