গ্রামীণ অর্থনীতির প্রসারেই উন্নত দেশ

2060

Published on মার্চ 11, 2019
  • Details Image

মুনতাকিম আশরাফঃ

বাংলাদেশে এখন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চলছে জোরেশোরে। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণসহ বাস্তবায়িত হচ্ছে বেশ কয়েকটি মেগাপ্রকল্প। পিছিয়ে নেই গ্রামীণ বা তৃণমূলের উন্নয়নও। গ্রাম এলাকায় স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা নির্মাণ করা হচ্ছে নতুন নতুন, আগের ভবনগুলোর সংস্কার করে করা হচ্ছে বহুতল ভবন। গ্রামের কাঁচা-মেঠোপথও পাকা করা হচ্ছে। সারাদেশে এখন দেড় হাজারের বেশি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সরকার।

চলতি অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বরাদ্দ ছিল ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। ওই বরাদ্দ বাড়িয়ে ১ লাখ ৯৩ হাজার কোটি টাকা করা হচ্ছে। বাড়তি ১৩ হাজার কোটি টাকা বছরের মাঝপর্যায়ে নতুন করে বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে উন্নয়নের পরিধি বাড়ছে বলে। উন্নয়নযজ্ঞের এই অভিযাত্রায় নতুন সংযোজন ‘আমার গ্রাম আমার শহর’। গ্রামাঞ্চলের উন্নয়নের মাধ্যমে যে আগামী দিনে অর্থনীতির শক্ত ভিত গড়ে উঠবে, এ লক্ষ্যই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নতুন অভিপ্রায়। এর মাধ্যমে শহর ও গ্রামের বৈষম্য কমবে। মাথাপিছু আয় বাড়বে সারাদেশে সমানতালে।

১৯৭৩ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি সিরাজগঞ্জে এক জনসভায় পশ্চিম পাকিস্তানিদের বৈষম্যের বিরোধিতা ও স্বাধীনতার সংগ্রামের প্রেক্ষাপট টেনে ধরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরিতে তোমরা ৮৫ জন, আমরা ১৫ জন। সামরিক বিভাগে তোমরা ৯০ জন, আমাদের দিয়েছ ১০ জন। বৈদেশিক সাহায্যের তোমরা খরচ করেছ ৮০ ভাগ, আমাদের দিয়েছ ২০ ভাগ। মহাপ্রলয়ে দক্ষিণ বাংলার ১০ লাখ লোক মারা গেল। লাখ লাখ লোক অসহায় অবস্থায় রইল। রিলিফ কাজের জন্য বিদেশ থেকে হেলিকপ্টার এসে কাজ করে গেল। অথচ ঢাকায় একখানা মাত্র সামরিক বাহিনীর হেলিকপ্টার ছাড়া পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আর কোনো হেলিকপ্টার আসলো না। আমরা এসব বেইনসাফির অবসান করব।’ বঙ্গবন্ধু আমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন। কিন্তু অর্থনৈতিক মুক্তির স্বাদ আমাদের দিয়ে যেতে পারেননি তিনি। কারণ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট একদল বিপথগামী পাকিস্তানি হায়েনাদের প্রেতাত্মা তথা সেনাবাহিনীর একটি চক্রান্তকারী চক্র জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে আমাদের অর্থনৈতিক মুক্তির পথ রুদ্ধ করে দেয়।

পরিসংখ্যান অনুযায়ী আমাদের দেশে প্রায় সোয়া ৩ কোটি পরিবারের ৮০ শতাংশের বসবাস গ্রামে। এ গ্রামেই প্রায় ১৩ কোটি মানুষের ঠিকানা। গ্রামে বসবাসকারী অর্ধেকের বেশি মানুষের বয়স ২৫ বছরের কম। গ্রামে উপার্জন বেশ কম আমাদের দেশে। গড় পারিবারিক আয় শহরের তুলনায় মোটামুটি পাঁচ ভাগের তিন ভাগ। তাই আয় বৃদ্ধির মাধ্যমে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন, নতুন প্রজন্মের ভবিষ্যৎ গঠন ও নাগরিক জীবনযাপনে বৈষম্য দূর করার লক্ষ্যে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ একান্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। কারণ গ্রামের মানুষকে অবহেলিত রেখে উন্নত বাংলাদেশ গড়া সম্ভব নয়। এমন প্রেক্ষাপটেই ‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’ প্রতিপাদ্য নিয়ে অগ্রযাত্রা শুরু করেছে বাংলাদেশ। প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা আমাদের এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের অগ্রযাত্রায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

বর্তমান সরকারের উন্নয়নের মূলমন্ত্র হলো ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’ অর্থাৎ যার সুফল সবাই পাবে, আয়ের বৈষম্য কমবে, মানুষের কাজের ব্যবস্থা হবে। এর আগে ১৯৯৯ সালের ২০ মে শহরের বিভিন্ন স্থানে বসবাসকারী অবহেলিত, অসহায় ও ভাগ্য বিড়ম্বিত ছিন্নমূল মানুষকে গ্রামের আপন ঠিকানায় ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য ‘ঘরে ফেরা কর্মসূচি’ হাতে নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে আন্তর্জাতিক মহলের ষড়যন্ত্রের কারণে দেশরত্ন শেখ হাসিনাকে রাষ্ট্রের দায়িত্ব থেকে সরে যেতে হয়। স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির হাতে চলে যায় দেশ। রহস্যজনক কারণে বন্ধ হয়ে যায় ‘ঘরে ফেরা কর্মসূচি’। এর পর ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে আওয়ামী লীগ সভাপতি জাতির সামনে ‘দিনবদলের সনদ’ উপস্থাপন করে আবারও রাষ্ট্রের জনগণের সেবা করার সুযোগ ফিরে পায়। প্রতিশ্রুত এই সনদ তখন জনমনে নাড়া দিয়েছিল। বিশেষ করে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ার অঙ্গীকার লুফে নেয় তরুণ প্রজন্ম। সফলভাবে পাঁচ বছর দেশের জনগণের সেবা করার পর ২০১৪ সালে শেখ হাসিনার সরকার উন্নয়নমূলক কাজগুলোর ধারাবাহিকতা ধরে রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আবারও জনগণের সেবা করার সুযোগ পায়। ফলে ২০০৮ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত গত দশ বছরে সব সামাজিক সূচক উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় মাথাপিছু আয় বেড়েছে ১৪৯.০৭ শতাংশ। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে মাথাপিছু আয় ৭০৩ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১ হাজার ৭৫১ মার্কিন ডলারে দঁাঁড়িয়েছে।

এদিকে দেশের মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বন্যা, ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, খরায় শস্যহানি ও প্রাণহানি এবং নদীভাঙনে নিঃস্ব হয়ে বেঁচে থাকার তাগিদে প্রতিনিয়ত শহরমুখী হচ্ছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রায় ৫ কোটি মানুষ বর্তমানে শহরে বাস করে। সামনে ক্রমেই শহরে বাস করা মানুষের সংখ্যা বাড়বে। এটি শুধু বাংলাদেশের চিত্র নয়, বিশ্বব্যাপী এমন চিত্রই দেখা যাবে। ১৯৫০ সালে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার মাত্র ৩০ শতাংশ মানুষ শহরে বাস করলেও বর্তমানে এ হার ৫৫ শতাংশ। ২০৫০ সালে কমপক্ষে ৬৬ শতাংশ শহরে বসবাস করবে। বর্তমান শহরগুলোর উন্নয়ন করে অতিরিক্ত মানুষের বাসযোগ্য রাখা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। তাই নতুন নতুন শহর গড়ে তোলার কার্যক্রম শুরু এখন কালের দাবি। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আধুনিক ও যুগোপযোগী পদক্ষেপ হাতে নিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও দেশরত্ন শেখ হাসিনা। ২০১৮ সালে ‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’ শিরোনামে প্রতিশ্রুতির দলিলে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হতে পারলে গ্রাম হবে শহর। ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ এই ব্যতিক্রমধর্মী ধারণার জন্য একাদশ সংসদ নির্বাচনে জনমনে ব্যাপক সাড়া ফেলে। ফলে নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ অর্থ গ্রামবাংলার প্রাকৃতিক রূপ অটুট রেখে শহরের সুবিধা গ্রামে পৌঁছে দেওয়া। উন্নত রাস্তাঘাট, যোগাযোগ, সুপেয় পানি, আধুনিক স্বাস্থ্যসেবা ও সুচিকিৎসা, মানসম্পন্ন শিক্ষা, উন্নত পয়ঃনিষ্কাশন ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ বৃদ্ধি, কম্পিউটার ও দ্রুতগতিসম্পন্ন ইন্টারনেট সুবিধা, বৈদ্যুতিক সরঞ্জামসহ মানসম্পন্ন ভোগ্যপণ্যের বাজার সম্প্রসারণের মাধ্যমে প্রতিটি গ্রামে আধুনিক শহরের সব সুবিধা দেওয়ার মাধ্যমে বর্তমান সরকার প্রতিটি গ্রামকে শহরে উন্নীত করার কর্মসূচি বাস্তবায়ন করবে। গ্রামে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ আরও বাড়ানো এবং নির্ভরযোগ্য করার লক্ষ্যে গ্রুপ ভিত্তিতে বায়োগ্যাস প্লান্ট ও সৌরশক্তি প্যানেল বসানোর উৎসাহ এবং সহায়তা দেবে সরকার। গ্রামপর্যায়ে কৃষিযন্ত্র সেবাকেন্দ্র, ওয়ার্কশপ স্থাপন করে যন্ত্রপাতি মেরামতসহ গ্রামীণ যান্ত্রিকায়ন সেবা সম্প্রসারণ করা হবে। এসবের মাধ্যমে গ্রামীণ যুবক ও কৃষি উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে উৎপাদনশীল কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করবে শেখ হাসিনার সরকার। অকৃষি খাতের এসব সেবার পাশাপাশি হালকা যন্ত্রপাতি তৈরি ও বাজারজাত করতে বেসরকারি খাতের প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ঋণ সুবিধাও দেওয়া হবে। নতুন কর্মস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি প্রতিটি উপজেলা থেকে গড়ে এক হাজার যুব বা যুব নারীকে বিদেশে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হবে বঙ্গবন্ধুকন্যা ও আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই। গ্রামে শহরের নাগরিক সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির মাধ্যমে এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ। পাকা সড়কের মাধ্যমে সব গ্রামকে জেলা, উপজেলা শহরের সঙ্গে সংযুক্ত করা হবে। ছেলেমেয়েরা উন্নত পরিবেশে লেখাপড়ার সুযোগ পাবে। সুপেয় পানি ও উন্নতমানের পয়ঃনিষ্কাশনব্যবস্থা নিশ্চিত হবে। সুস্থ বিনোদন ও খেলাধুলার জন্য অবকাঠামো গড়ে উঠবে। কর্মসংস্থানের জন্য জেলা, উপজেলায় কলকারখানা গড়ে তোলা হবে। গ্রামপর্যায়ে পৌঁছে যাবে ইন্টারনেট ও তথ্যপ্রযুক্তির সুযোগ-সুবিধা। উন্নত জীবনব্যবস্থা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জীবিকার সন্ধানে এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের নামে উন্নত জীবনের জন্য গ্রামের মানুষ আর শহরে ভিড় করবে না। দেশের প্রতিটি ঘরে পৌঁছে যাবে বিদ্যুৎ। আধুনিক শিক্ষায় আলোকিত হবে প্রতিটি গ্রাম। অত্যাধুনিক চিকিৎসাসেবা পৌঁছে যাবে প্রতিটি গ্রামে। আমার গ্রাম হবে আমার শহর। এর মাধ্যমে আগামী ৫ বছরে জিডিপি ১০ শতাংশে উন্নীত হবে। ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করে বাংলাদেশ হবে মধ্যম আয়ের দেশ। ২০৩০ সালে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় হবে ৫ হাজার ৪৭৯ মার্কিন ডলারের বেশি। ২০৪১ সালে উন্নত দেশ হিসেবে বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়াবে বাংলাদেশ। দারিদ্র্যের হার নেমে যাবে শূন্যের কোঠায়।

লেখকঃ সহসভাপতি, এফবিসিসিআই

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত