আজও খুঁজি তাঁকে মানুষের ভিড়ে - এম নজরুল ইসলাম

6162

Published on আগস্ট 5, 2019
  • Details Image

কতদিন হয়ে গেল দেখি না তাঁকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণচঞ্চল ক্যাম্পাসে তিনি নেই। তিনি নেই ছাত্রলীগ কিংবা যুবলীগের অফিসে। প্রাণোচ্ছল সেই মানুষটির উপস্থিতি আজ আর চোখে পড়ে না। দীর্ঘ প্রবাস জীবনে নাড়ির টানে দেশে যাই। ঢাকার ব্যস্ত জনপদে খুঁজি তাঁকে। তিনি নেই। চোখের সামনে তিনি নেই। আজ যখন যোগাযোগ প্রযুক্তি উন্নতির শিখরে তখন তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ নেই। কেবল স্মৃতিতে ভাসে সেই দীপ্তিময় চোখ। সেই প্রশান্ত মুখ ভুলে থাকি কী করে? দৃষ্টির সম্মুখে তিনি নেই, এটা ঠিক। কিন্তু চোখ বন্ধ করলে এখনও দেখতে পাই সেই দীর্ঘ ঋজু দেহ। পুরু গোঁফের নিচে প্রশ্রয়ের স্মিত হাসি। চোখে কালো ফ্রেমের মোটা কাঁচের চশমা। পরিপাটি করে আঁচড়ানো চুল। এক উচ্ছল তরুণের প্রোফাইল আজও স্পষ্ট হৃদয়ের এ্যালবামে। ১৯৭২ সালের পর থেকে ১৯৭৫ সালের মধ্য আগস্ট পর্যন্ত এক প্রাণময় সময় কাটিয়েছি আমরা। তারুণ্যের সেই সূচনালগ্নে ভেসেছি প্রাণের উচ্ছ্বাসে। সদ্য স্বাধীন দেশে নিয়েছি বুক ভরে নিশ্বাস। ছাত্র রাজনীতি থেকে সাংস্কৃতিক কর্মকা-, খেলার মাঠ থেকে নাটকের মঞ্চ, সর্বত্রই ছিল আমাদের প্রাণোচ্ছল উপস্থিতি। সদ্য স্বাধীন দেশে আমরা ডানা মেলে উড়ছি তখন। এই আকাশ আমার। এই বাতাসে আমাদের অধিকার। এই আলো, এই হাওয়া- সব যেন নিজের মতো করে পাওয়া। স্টেডিয়াম থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠ, টিএসসি থেকে মধুর ক্যান্টিন- আমাদের কলরবে মুখর তখন। আমাদের মুখর তারুণ্যকে প্রাণপ্রাচুর্যে ভরিয়ে দেয়া সেই মানুষটি শেখ কামাল, আমাদের কামাল ভাই।

স্মৃতির সেলুলয়েডে আজও দেখতে পাই শিক্ষক প্রশিক্ষণ মহাবিদ্যালয়ের ঠিক উল্টোদিকে ৩০ মিরপুর রোডে ছিল ছাত্রলীগের অফিস। দোতলা বাড়ির নিচতলায় মহানগর ছাত্রলীগের, দোতলায় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের অফিসে আমারও নিত্য যাতায়াত ছিল। বয়সে কনিষ্ঠ হলেও ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছি তখন। ছাত্র রাজনীতির সাংগঠনিক পরিচয়ের গ-ি পার হয়ে তাঁর ঘনিষ্ঠ হতে সময় লাগেনি। আমার দিক থেকে সঙ্কোচ যে ছিল না তা নয়। সঙ্কোচ ও ভয় দুটোই ছিল। স্বাধীন দেশের প্রধানমন্ত্রীর ছেলে তিনি। স্বাভাবিকভাবেই একটি দূরত্ব তৈরি হওয়ার কথা। কিন্তু কামাল ভাইয়ের ব্যক্তিত্ব ও মানুষকে কাছে টেনে নেয়ার অসামান্য ক্ষমতা সেই দূরত্ব ঘুচিয়ে দিতে একটুও সময় নেয়নি। ব্যাপারটা শেষাবধি এমন হয় যে, প্রতিদিন একাধিকবার দেখা হওয়াটাই ছিল নিয়মিত রুটিন।

শেষ কবে দেখিছি তাঁকে? না, সে হিসাব করা নেই। হিসাব রাখারও তো কোন প্রয়োজন ছিল না। রোজ যাঁর সঙ্গে দেখা হচ্ছে, স্মিত হাসি দিয়ে পিঠের ওপর হাত রেখে কাজ করার সাহস যোগাচ্ছেন যিনি তাঁর সঙ্গে শেষ কবে দেখা হয়েছে এমন হিসাব কষার তো কোন প্রয়োজন নেই। কোথায় দেখিনি তাঁকে। সদ্য স্বাধীন দেশে তখন আমরা ডানা মেলে উড়ছি যেন। চারদিকে আনন্দের জোয়ার। সেই জোয়ারে তিনি দক্ষ এক সংগঠকের ভূমিকায়। গানের আসরে তাঁকে পাই। নাটকের মঞ্চে তাঁর সপ্রাণ উপস্থিতি। খেলার মাঠে তিনি তো আছেনই। রাজনৈতিক সংগঠনের কার্যালয়েও তিনি উপস্থিত। সকালে দেখছি তাঁকে। বিকেলেও সেই হাসিমুখে টেনে নিচ্ছেন কাছে। অসামান্য সাংগঠনিক দক্ষতার অধিকারী এই তরুণ যে কোন মানুষকে অনায়াসে কাছে টানার শক্তি রাখতেন। জানতেন কী করে সংগঠনকে প্রাণবন্ত রাখতে হয়।শৈশব থেকে ফুটবল, ক্রিকেট, হকি, বাস্কেটবলসহ বিভিন্ন খেলাধুলায় উৎসাহী শেখ কামাল স্বাধীনতার পর আবির্ভূত হন ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে। উপমহাদেশের অন্যতম ক্রীড়া সংগঠন ও আধুনিক ফুটবলের অগ্রদূত আবাহনী ক্রীড়াচক্রের প্রতিষ্ঠাতা তিনি। রাজনীতিতে তাঁর অবদান কম নয়। ছাত্রলীগের একজন নিবেদিতপ্রাণ কর্মী হিসেবে তিনি ছিলেন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য। শাহাদাতবরণের সময় ছিলেন বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের অঙ্গ-সংগঠন জাতীয় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। ১৯৬৯ সালের গণঅভুুুুুু্যুত্থান ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামাল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ওয়ার কোর্সে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। কমিশন লাভ করে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানীর এডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শাহাদাতবরণের সময় তিনি সমাজবিজ্ঞান বিভাগের এমএ শেষ পর্বের পরীক্ষা দিয়েছিলেন।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে অন্যরকম একটা জোয়ার আনার চেষ্টা করেছিলেন শেখ কামাল। বিশেষ করে ছাত্র রাজনীতির গুণগত মানের পরিবর্তনের চেষ্টা ছিল তাঁর। সরকারের প্রধান নির্বাহী ও রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ব্যক্তির ছেলে হয়েও দলের উঁচু পদের দিকে তাঁর কোন মোহ ছিল না। সাধারণ কর্মী হিসেবেই কাজ করতেন তিনি। ছিলেন উদ্যমী পুরুষ। সংস্কৃতি অঙ্গন থেকে খেলার মাঠ-সর্বত্র সমান দাপট।

এই প্রাণবন্ত তরুণ প্রতিভাকে যথার্থ মূল্যায়ন করা হয়নি। মূল্যায়ন তো দূরের কথা, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর তাঁর চরিত্র হননের চেষ্টা করা হয়েছে। অথচ তাঁর শিল্পী মনের পরিচয় ক’জনের জানা আছে? অনেকেই হয়ত জানেন না, শেখ কামাল চমৎকার সেতার বাজাতেন। ছায়ানটের শিক্ষার্থী ছিলেন তিনি। স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে দেশের সঙ্গীত জগতে পপ সঙ্গীতের যে উত্থান তার নেপথ্যেও শেখ কামালের অবদান খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। বন্ধু শিল্পীদের নিয়ে সেই সময়ে গড়ে তুলেছিলেন ‘স্পন্দন’ শিল্পীগোষ্ঠী- যে দলটি দেশের সঙ্গীত জগতে আধুনিকতার ছোঁয়া দিয়েছিল সেই সত্তরের দশকের প্রথমার্ধে। দেশের নাট্য আন্দোলনের ক্ষেত্রে শেখ কামাল ছিলেন প্রথম সারির সংগঠক। ছিলেন ঢাকা থিয়েটারের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতাও। অভিনেতা হিসেবেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যাঙ্গনে ছিলেন প্রতিষ্ঠিত। আজকের দিনে যখন নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চাইছে সাম্প্রদায়িক শক্তি, যখন স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃতির চেষ্টা করেই চলেছে একটি স্বার্থান্বেষী মহল তখন শেখ কামালের মতো একজন দক্ষ সংগঠকের অভাব বোধ করি। আজ তাঁর মতো নেতৃত্ব বড় প্রয়োজন এই দেশে।

জন্মেছিলেন আজকের বঙ্গতীর্থ টুঙ্গিপাড়ায় ১৯৪৯ সালের এই দিনে। মাত্র ২৬ বছরের জীবন। ঘাতকের বুলেটে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে নিহত হন ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। তাঁর মৃত্যু দেশের সংস্কৃতি ও ক্রীড়া ক্ষেত্রে তো বটেই, রাজনীতিতেও এক অসামান্য ক্ষতি।

তাঁর আদর্শ অনুসরণের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশকে সত্যিকার অর্থে অসাম্প্রদায়িক একটি দেশ হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব। রাজনীতি যখন কারও কারও কাছে ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি তখন শেখ কামালের দেখানো পথ ধরে রাজনীতিকে সত্যিকারের মানবকল্যাণে ব্যবহার করা সম্ভব। সব সম্ভবের দেশেও কেমন করে নির্মোহ থাকা যায় শেখ কামাল তারই অনন্য দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। সরকার ও রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তির সন্তান হওয়া সত্ত্বেও কেমন করে সাধারণ্যে মিশে যাওয়া যায় শেখ কামাল তার অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করে গেছেন।

আজ ৫ আগস্ট, জন্মদিনে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি সেই প্রাণময় তরুণকে, যাঁর প্রেরণা একদিন আমাদের মতো তরুণদের উজ্জীবিত করেছিল বাঙালী জাতীয়তাবাদের রাজনীতিতে। তিনিই তো আমাদের দীক্ষা দিয়েছিলেন দেশপ্রেমের মন্ত্রে। প্রাণময় সেই তরুণকে আজ কোথাও দেখি না। প্রবাস থেকে যখনই দেশে যাই খুঁজি তাঁকে মানুষের ভিড়ে। মিরপুর রোডের চেহারা পাল্টে গেছে। ধানমণ্ডি লেকও আজ অনেক আধুনিক। সেই আবাহনী মাঠ আছে, নেই সেই প্রাণপুরুষ। খুঁজি তাঁকে হাজার মানুষের ভিড়ে।

- এম নজরুল ইসলাম
সৌজন্যেঃ জনকণ্ঠ

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত