প্রতিরোধেই রেহাই মিলবে

3156

Published on এপ্রিল 3, 2020
  • Details Image

বর্তমান কোভিড-১৯ ভাইরাসটি করোনাভাইরাসের একটি extreme mutant form। ভাইরাসটি অত্যন্ত ছোঁয়াচে, অধিক সংক্রমণ শক্তিসম্পন্ন ও অধিকতর ক্ষতিকারক। ভাইরাসটির ইনকিউবেশন (ছড়ানোর) সময়কাল ১ থেকে ১৪ দিন, সর্বোচ্চ ২১ দিন।

ভাইরাসটি সাধারণত সর্দি-কাশির মাধ্যমে ছড়ায় এবং ইনফ্লুয়েঞ্জা জ্বরের মতো লক্ষণ দেখা দেয়। বয়স্ক ও অসুস্থ রোগীদের ক্ষেত্রে জটিলতা বেশি দেখা দেয়। রোগটি চিকিৎসার ক্ষেত্রে কোনো নির্দিষ্ট ওষুধ নেই।

ভাইরাসটি অত্যন্ত ছোঁয়াচে, তাই আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে সংক্রমণ রোধ করাই মূল বিষয়। যেহেতু ভাইরাসটি স্বল্প সময়ে অনেক ব্যক্তিকে সংক্রমিত করতে পারে, সেহেতু এটি অনেক জটিল এবং প্রাণহানির কারণ হতে পারে। তাই প্রতিরোধই এ রোগ থেকে রেহাই পাওয়ার প্রধান উপায়।

প্রতিকারের উপায়

ভাইরাসটির বিরুদ্ধে কোনো ভ্যাকসিন এ পর্যন্ত আবিষ্কার হয়নি। তাই ব্যক্তিগত, সামাজিক, এমনকি রাষ্ট্রীয়ভাবে বিভিন্ন মাধ্যমে ভাইরাসটির সংস্পর্শ এড়ানোই এর সংক্রমণ থেকে মুক্তি পাওয়ার একমাত্র উপায়। তাই ব্যক্তিগত, সামাজিক, এমনকি রাষ্ট্রীয়ভাবে সংক্রমণ এড়ানোর লক্ষ্যে বর্তমানে বিভিন্ন পদ্ধতি ও উপদেশ মানার জন্য প্রয়োজনীয় গাইডলাইন ও নির্দেশমালা দেয়া হয়েছে, যাতে আক্রান্ত রোগী থেকে সমাজে সুস্থ রোগীদের মাঝে ভাইরাসটির ট্রান্সমিশন এড়ানো যায়।

গাইডলাইনে ব্যক্তিগতভাবে করণীয়

১. ব্যক্তিগত সচেতনতা বৃদ্ধি করা; ২. ব্যক্তিগতভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা; ৩. হাঁচি-কাশি যখন-তখন না করা ও যত্রতত্র না ফেলে নির্দিষ্ট স্থানে ফেলা; ৪. হাঁচি-কাশির সময় টিস্যু বা রুমাল ব্যবহার করা এবং ব্যবহৃত টিস্যু নির্দিষ্ট স্থানে ফেলা এবং সম্ভব হলে পুড়িয়ে ফেলা; ৫. বিশ সেকেন্ড সময় নির্দিষ্ট করে হাত ধোয়া। হাত, মুখ দিয়ে নাক না ঘষা; ৬. কোলাকুলি বা করমর্দন না করা; ৭. গণজমায়েত এড়িয়ে চলা এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলাফেরা করা; ৮. বাড়ির বাচ্চাদের কোলে না নেয়া; ৯. বাড়িতে আক্রান্ত গৃহপালিত পশুপাখি থাকলে দূরে রাখা; ১০. খাবার পরিপূর্ণ রান্না করে খাওয়া।

সামাজিক বিস্তার রোধে করণীয়

গণজমায়েত বন্ধ করা- এ লক্ষ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক, ধর্র্মীয়, সামাজিক কর্মসূচি বন্ধ করা বা সীমিত করা। হাট-বাজার, মার্কেট, স্কুল-কলেজ, গণপরিবহন, রেল, নৌযান, বিমান পথ ইত্যাদি বন্ধ রাখা। সমাজে প্রতিটি মানুষের মধ্যে রোগটির বিস্তার রোধে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা, যেমন- কোয়ারেন্টিনে থাকা, চলাচল সীমিত করা ইত্যাদি।

কোয়ারেন্টিন এবং এর উপযোগিতা কী

কোয়ারেন্টিনের শাব্দিক অর্থ হল সঙ্গরোধ। অর্থাৎ একে অপর থেকে আলাদা থাকা। নিচে উদাহরণের মাধ্যমে এ ভাইরাসটির ক্ষেত্রে কোয়ারেন্টিনের উপযোগিতা বোঝা যেতে পারে।

আগেই বলেছি, ভাইরাসটি extreme mutant হওয়ায় এটি অত্যন্ত ছোঁয়াচে ও সংক্রমণক্ষম। মনে করুন, একজন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি তিন থেকে পাঁচজনকে সংক্রমিত করেছে, ওই তিন থেকে পাঁচজন রোগী পরবর্তী সময়ে আরও দশ থেকে পনেরজন সুস্থ ব্যক্তিকে সংক্রমণ করতে পারে।

এভাবে একজন রোগী থেকে ভাইরাসটি জ্যামিতিক হারে স্বল্প সময়ে অনেক সুস্থ ব্যক্তিকে সংক্রমিত করতে পারে। কোয়ারেন্টিনের মাধ্যমে আক্রান্ত ব্যক্তিদের আলাদা করে এই ট্রান্সমিশন চেইনটি ভেঙে দেয়া সম্ভব।

অন্যথায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বাড়তে থাকবে। সম্ভবত বিভিন্ন দেশে প্রাথমিক পর্যায়ে এই কোয়ারেন্টিন পলিসিটি শক্তভাবে বাস্তবায়ন না করার কারণে রোগীর সংখ্যা বেড়ে চলেছে। চীন সম্ভবত এ পদ্ধতিই খুবই শক্তভাবে বাস্তবায়ন করে রোগটি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে।

কোয়ারেন্টিনের মেয়াদ

এ ভাইরাসের ক্ষেত্রে ১৪ দিন, মতভেদে সর্বোচ্চ ২১ দিন। সাধারণত ভাইরাসটি শরীরে ঢোকার পর সর্বোচ্চ এ সময়ের মধ্যে শরীরের Host Immune Defiance Mechanism ভাইরাসটিকে ধ্বংস করে ফেলে। ফলে ভাইরাসটি নিষ্ক্রিয় হওয়ায় ওই ব্যক্তিকে আর সংক্রমিত করতে পারে না।

কোয়ারেন্টিন কত ধরনের

কোয়ারেন্টিন ব্যক্তিগতভাবে, পারিবারিকভাবে, সামাজিকভাবে করা যায়, যার মূল উদ্দেশ্য হল ভাইরাস ট্রান্সমিশন রোধ করা।

১. সেলফ কোয়ারেন্টিন অর্থাৎ স্বেচ্ছায় কোয়ারেন্টিনে যাওয়া। সুস্থ লোকদেরও কোয়ারেন্টি যাওয়ার নির্দেশনা রয়েছে। কারণ সে হঠাৎ করে কোনো উপসর্গ ছাড়া সংক্রমিত ব্যক্তির বা রোগীর সংস্পর্শে আসতে পারে। তাছাড়া সে নিজেও হয়তো জানে না যে ভাইরাসটি তার মধ্যে উপসর্গ ছাড়া অবস্থায় রয়েছে। সেক্ষেত্রে তার নিজেকে বা অন্যকে সংক্রমিত করার আশঙ্কা থাকে।

২. হোম কোয়ারেন্টিন : এ পদ্ধতিতে দেশের প্রত্যেক ব্যক্তিকে কোয়ারেন্টিনের আওতায় আনা সম্ভব। এর মূল উদ্দেশ্য হল প্রতিটি বাড়ির প্রত্যেক সদস্যের নিজ বাড়িতে আলাদা থেকে ব্যক্তিগত কোয়ারেন্টিনের বিধিমালা মেনে চলা। এ পদ্ধতিতে সহজভাবে বাড়ির পরিবেশে স্বাচ্ছন্দ্যে এবং খাবার-দাবারের সুবিধাসহ কোয়ারেন্টিনের বিধিমালা মেনে চলা সম্ভব হয়। ফলে বিষয়টি অনেক দিক থেকেই সুবিধাজনক। কেউ অসুস্থ হলে আইইডিসিআর হটলাইন অথবা অন্য মাধ্যমে যোগাযোগ করে চিকিৎসা নিতে পারেন এবং প্রয়োজন বোধে প্রাতিষ্ঠানিক সেবা নিতে পারেন।

হোম কোয়ারেন্টিনে থাকা অবস্থায় নিুবর্ণিত নিয়মগুলো মেনে চলার নির্দেশ রয়েছে।

১. বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া বাইরে না যাওয়া। ২. বিশেষ দরকার হলে বাইরে যাওয়ার সময় মাস্ক ব্যবহার করবেন। বাইরে ঘোরাফেরার সময় সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখবেন। ৩. ফেরার সময় দরজার হাতল টিস্যু ব্যবহার করে খুলবেন, বাসায় ঢুকে সরাসরি ওয়াশরুমে গিয়ে কাপড়-চোপড় খুলে পরিষ্কার হয়ে নতুন কাপড় ব্যবহার করা। কোনোভাবেই বাড়ির বাচ্চাদের এভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন না হয়ে কোলে নেয়া যাবে না। ৪. বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিদের সম্পূর্ণ আলাদা রাখতে হবে এবং তাদের কোনো উপসর্গ দেখা দেয় কিনা খেয়াল রাখতে হবে। ৫. ব্যবহার্য থালাবাসন, গ্লাস, চামচ আলাদা করা বাঞ্ছনীয়। ৬. ঘরের মধ্যে চলাচলের ক্ষেত্রে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে কমপক্ষে তিন ফুট দূরত্ব বজায় রাখা। ৭. ঘরে বসে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা।

কোয়ারেন্টিন সেন্টার

সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন হাসপাতাল, প্রতিষ্ঠান, খেলার মাঠ, স্কুল-কলেজ, হোটেল, কমিউনিটি সেন্টার ইত্যাদি জায়গা কোয়ারেন্টিন সেন্টার হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। প্রয়োজনবোধে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এই সেন্টার স্থাপন করা যেতে পারে। এখানে সাধারণত সংক্রমণের সন্দেহজনক যেমন, বিদেশ ফেরত অনেক ব্যক্তিকে একসঙ্গে কোয়ারেন্টিন করা যেতে পারে।

প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিন

এখানে ভাইরাস পজিটিভ অথবা আক্রান্ত জটিল রোগীদের নির্দিষ্ট হাসপাতালে আইসোলেশন করে চিকিৎসা করা হয়।

আইসোলেশন

এখানে অত্যন্ত সন্দেহভাজন যেমন, বিদেশ ফেরত থার্মাল টেস্ট পজিটিভ রোগী অথবা ভাইরাস পজিটিভ রোগীদের আলাদা করা হয়।

আমাদের সরকার কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপগুলো

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ এবং বিভিন্ন দেশের গৃহীত পদক্ষেপ অনুসরণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সমন্বিত পদক্ষেপ বাস্তবায়নের নির্দেশ দিয়েছেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর সব অনুষ্ঠান এবং স্বাধীনতা দিবসের সব কর্মসূচি বাতিল করেছেন।

এছাড়া সামাজিক বিস্তার রোধে ইতিপূর্বে উল্লেখিত সব কর্মসূচি বাস্তবায়নের ঘোষণা করেছেন। জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য বিভিন্ন প্রচারমাধ্যম যেমন- রেডিও, টেলিভিশন, সংবাদপত্র, মাইকিং ইত্যাদির মাধ্যমে সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান প্রচার করা হচ্ছে।

স্থানীয় প্রশাসনকে কর্মসূচি বাস্তবায়নের নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং সহায়তার জন্য সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন জায়গায় কোয়ারেন্টিন সেন্টার স্থাপন করা এবং বিদেশ প্রত্যাগতদের হোম কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এছাড়া করোনা পরীক্ষার জন্য দেশের বিভিন্ন জায়গায় সেন্টার খোলা হইয়াছে।

করোনাভাইরাস নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। কারণ এটি একটি ভাইরাল রোগ। আক্রান্ত রোগীর ৮০-৯০ শতাংশ আপনাআপানি সেরে যায়। তবে ভাইরাসটি অত্যন্ত ছোঁয়াচে হওয়ায় এর বিস্তার রোধে আমরা সচেতন না হলে দ্রুত ও জ্যামিতিক হারে তা ছড়িয়ে অনেক প্রাণহানি ঘটাতে পারে।

আশার কথা, আমাদের দেশে সংক্রমণটি অন্যান্য দেশের তুলনায় এখনও সামাজিকভাবে সীমিত পর্যায়ে রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তাই ভাইরাসটির বিস্তার রোধে প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক যেসব কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে, তাতে দলমত নির্বিশেষে সবার অংশগ্রহণ করে বাস্তবায়ন করা উচিত। এ কর্মসূচির সফলতার মাধ্যমে আমরা এই মহারণে জয়ী হতে পারব।

লেখকঃ সহযোগী অধ্যাপক, হেপাটোলজি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়

সৌজন্যেঃ দৈনিক যুগান্তর (২ এপ্রিল ২০২০)

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত